শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা চায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। বিনিময়ে ২০১৩ সালের ৫ মে’র পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুই শতাধিক মামলা থেকে তাদের অব্যাহতির দাবি করছে সংগঠনটি।
ইতোমধ্যে এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। বৈঠক হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও। হেফাজতে ইসলাম, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। যদিও প্রকাশ্যে বিষয়টি নিয়ে কেউ মন্তব্য করতে রাজি নন।
গত কিছুদিন থেকেই আলোচনা চলছে, ২০১৩ সালের ৫ মে’র পর থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ নানা অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ২০৩টি মামলা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সমঝোতার অংশ হিসেবে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দফতর থেকে পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তবে পুলিশ সদর দফতরের কোনও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করেননি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তারাও হেফাজতের মামলাগুলো দ্রæত নিষ্পত্তির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। যেসব কর্মকর্তার সঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের কথা হয়েছে তারা বলছেন, ফৌজদারি আইনের কোনও মামলা পুলিশের নিষ্পত্তি করার কোনও সুযোগ নেই। পুলিশের কাজ হচ্ছে তদন্ত শেষে মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) কিংবা ফাইনাল রিপোর্ট (চূড়ান্ত প্রতিবেদন) আদালতে দেওয়া। মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে।
তবে কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হেফাজতের মামলাগুলোর তদন্ত দ্রæত শেষ করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে নির্দেশনা দিয়েছে। যাতে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মামলাগুলো নিয়ে পুলিশের কার্যক্রম শেষ করতে পারে।
হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার অংশ হিসেবে এ নির্দেশনা কিনা জানতে চাইলে ডিএমপির এক কর্মকর্তা (পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, হেফাজতে ইসলামের নেতারা সরকারের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে অঙ্গীকার করেছেন, তারা কোনও রাজনৈতিক কর্মকাÐ চালাবেন না। ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়েই তারা কাজ করবেন।
কী বলছে হেফাজতে ইসলাম
যদিও হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা শায়েখ সাজিদুর রহমান বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেছেন, রাজনীতি করবে না মর্মে হেফাজত কারও কাছে কোনও অঙ্গীকার কিংবা মুচলেকা দেয়নি। উদ্দেশ্যমূলকভাবে হেফাজতের বিরুদ্ধে এসব প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে।
বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলামের এই শীর্ষ নেতা আরও বলেন, হেফাজতে ইসলাম সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়েছে মর্মে কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদটি সত্য নয়। তাছাড়া হেফাজতে ইসলাম রাজনীতি না করার বিষয়ে সরকারকে প্রতিশ্রæতি দিয়েছে, এটা সত্য না। এসবই প্রোপাগান্ডা।
বিবৃতিতে বলা হয়, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) হেফাজতকে প্রতিষ্ঠাই করেছিলেন অরাজনৈতিক ও ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সংগঠন হিসেবে। হেফাজত কোনোকালেই নিজেদের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করেনি, আগামীতেও করবে না। যেহেতু হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন এবং অতীতেও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না, তাই নতুন করে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হওয়ার বিষয়ে কারও কাছে প্রতিশ্রæতি দেওয়ার প্রশ্নটাই অবান্তর।
হেফাজত নেতা মাওলানা বোরহান উদ্দিন আল মতিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হেফাজতে ইসলাম কখনও রাজনৈতিক দল ছিল না। বিভিন্ন মহল তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের নেতাকর্মীদের ব্যবহার করেছেন। হেফাজত সমসময়ই রাজনীতিমুক্ত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। শান্তির স্বার্থে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আমাদের নেতারা দেখা করে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরে আলোচনা করেছেন। অন্য কিছু নয়।
২০৩ মামলা
২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই দিন রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের পর তারা সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। হেফাজতের ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীজুড়ে সহিংসতা হয়।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সাত জেলায় হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনায় রাজধানীসহ সাতটি জেলায় ৫৩টি মামলা দায়ের হয়।
৫৩টি মামলার মধ্যে ৪৯টি মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। এছাড়া ২০২১ সালের ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ করে হেফাজতে ইসলাম।
বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। যার রেশ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব ঘটনায় সারাদেশে আরও ১৫৪টি মামলা দায়ের হয়। সব মিলিয়ে হেফাজতের ইসলামের সংশ্লিষ্টতায় সহিংসতার ঘটনায় ২০৩টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।
এসব ঘটনার পর হেফাজতে ইসলামীর অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। যাদের অনেকেই এখনও কারাগারে রয়েছেন। হেফাজতের নেতারা বলছেন, তাদের নেতাকর্মীদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন তারা।
গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও হেফাজত নেতারা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে হেফাজতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেন। এক ঘন্টারও বেশি সময় তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
এরপর হেফাজতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন নেতা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে এর আগেও হেফাজতের কোনও কোনও নেতা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়ে যে, হেফাজতের মামলাগুলো দ্রæত নিষ্পত্তি করতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ যা বলছে
হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো নিষ্পত্তির বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনও নির্দেশনা আছে কিনা জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের গণমাধ্যম শাখার এআইজি মো. মনজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হেফাজতের মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে কোনও নির্দেশনা আমাদের কাছে আসেনি। মামলা মামলার মতোই আছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অনেকে অনেক কিছু বলে দাবি করে। মামলা নিষ্পত্তি হবে কেন। মামলা মামলার গতিতে চলবে। মামলা নিষ্পত্তির কোনও আলোচনা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের সামনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ২০২১ সালে মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। সেসব ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা আইন অনুযায়ী চলছে। তবে আমরা চাই মামলার কার্যক্রম দ্রæত শেষ হোক। এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করছি।
গত বছর ৯ ফেব্রæয়ারি (২০২২) হেফাজতের শীর্ষ নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় একটি বৈঠক করেন। তখন হেফাজত নেতারা তাদের বন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলেন, তাদের নেতাকর্মীদের মুক্তি দিলে তারা কোনও ধরনের রাজনীতিতে জড়াবে না। তবে মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের স্মরণ করিয়ে দেন।
আইনে কী আছে
সিনিয়র আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, মামলা নিষ্পত্তির এখতিয়ার শুধু আদলতের। পুলিশ তদন্ত শেষে হয় অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে। এরপর আদালতের প্রক্রিয়ায় মামলার নিষ্পত্তি হবে। তবে যেসব মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়নি, সেক্ষেত্রে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় অভিযোগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই সিদ্ধান্ত আদালতকে জানালে আদালত সেসব মামলা নিষ্পত্তি বা খারিজ করে দিতে পারেন।
তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন