বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক
ধূপ-প্রদীপের ধোঁয়া শঙ্খ ঘন্টার শব্দ, পূজারির মন্ত্র উচ্চারণ পবিত্রতা ও প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় মনে। দেবীর আয়ত নয়ন মনে দেয় শক্তি, জোগায় বাঁচার আশা। প্রতিমা দর্শন আর শ্রদ্ধা জানিয়ে শক্তি সঞ্চয়ে ভক্তদের আনাগোনায় ভরপূর পূজার মন্ডপগুলো। ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে গত শুক্র দেবীর অধিষ্ঠান হয়েছে। ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনির শব্দ দেবীর কৈলাশ থেকে ধরায় আগমনের জানান দিয়েছে। দেবী দূর্গা তার ২ পূত্র ও ২ কণ্যাকে নিয়ে মর্তে এসেছেন। মন্ত্রোচ্চারণ, আরতি আর মাইকের আওয়াজে মুখর এখন দেশের পূজা মন্ডপগুলো। প্রতিটি পূজা মন্ডপে কারিগরদের নিপূণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা এবং তার মেয়ে লক্ষ্মী, সরস্বতী, ছেলে গণেশ, কার্তিক ও অনিষ্টকারী অসুরসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি। বাহ্যিক ও আত্মিক অসুর নিধন করে শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর পালিত হয় শারদীয় দুর্গোৎসব।
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আনন্দ ও উৎসাহ উদ্দীপনা।
গতকাল শনিবার ছিল শারদীয় দূর্গোৎসবের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ মহা সপ্তমী। এদিকে সকলের মঙ্গল কামনায় মন্দিরে মন্দিরে চলছে প্রার্থনা। পূরোহিতরাও শুরু করেছেন পূজা অর্চণা। মহা সপ্তমীর মধ্যে দিয়ে দেবীর আরধনা ও অর্চণা শুরু হয়ে গেছে। মায়ের আগমনি বার্তা তার ভক্তদের কাছে পৌছানোতে ভক্তরা মায়ের কাছে তাদের মনবাসনা পূরণের আশায় আরাধনা করছেন। এ দিন সকাল ৯টা ৫৮ মিনিটে দুর্গা দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ স্থাপন ও সপ্তমী বিহিত পূজা শুরু হয়। মন্দিরে মন্দিরে ঢাকের বাজনার পাশাপাশি চলছে ধর্মীয়সহ বিভিন্ন ধরণের গান।
শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে নগরীর মন্দিরগুলো সাজানো হয়েছে দারুণভাবে। এ বছর মহানগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানা এলাকায় ৫০টা সহ ৪টি থানায় এলাকায় ৭৬টি এবং জেলার নয়টি উপজেলায় ৩৫০টি মিলিয়ে রাজশাহী জেলায় মোট ৪২৫টি পূজা মন্ডপে শারদীয় দূর্গা পূজা হচ্ছে। শারদীয় দুর্গোৎসব শান্তিপূর্ণভাবে পালনে নগরজুড়ে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। পূজা মন্ডপগুলোতে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পোশাকধারী পূলিশ, আনসার, র্যাব সদস্যের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে সাদাপোশাকের গোয়েন্দা সদস্যদের। পূজা মন্ডপের আইনশৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে মোতায়েন করা হয়েছে সাড়ে চার হাজার আনসার সদস্য। এছাড়াও যেকোন ধরনের অপ্রতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত রাখার হয়েছে বিজিবি সদস্যদেরকেও এবং জননিরাপত্তার স্বার্থে সকল ধরণের আতশবাজি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি রাত নয়টার মধ্যে প্রতিমা বিসর্জনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করছেন, অশুভ শক্তিকে দমন ও দেশের শান্তি কল্যাণে এবার দেবী দুর্গা মর্তে আসবেন ঘোড়ায় চড়ে এবং যাবেনও ঘোড়ায় চড়ে।
পূরোহিতরা বলেন, ঈশ্বর সব কিছুর মাঝে রয়েছেন। প্রকৃতির বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্য নয়টি গাছের ফুল, ফল, পাতা দিয়ে সব অশুদ্ধকে শোধন করে শুদ্ধ করে মাকে পূজা করা হয়। এরপর কল্পনার মধ্যদিয়ে মাকে (দেবী দূর্গা) মনের আসনে বসানো হয়।
মহাসপ্তমীর প্রভাতে ঢাক-ঢোলক-কাঁসর বাজিয়ে কলাবউ স্নান ও আদরিণী উমার সপরিবারে তিথি বিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হয়। আজ ৯ অক্টোবর রোববার মহা অষ্টমীর দিন। আজ সকালে কুমারীপূজা ও রাতে সন্ধিপূজা। আর ১০ অক্টোবর সোমবার মহানবমী এবং ১১ অক্টোবর মঙ্গলবার বিজয়া দশমী। বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসব।
দুর্গা পৌরাণিক দেবতা। তিনি আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভূজা, সিংহবাহনা ইত্যাদি নামে অভিহিত হন। দুর্গ বা দুর্গম নামক দৈত্যকে বধ করেন বলে তার নাম হয় দুর্গা। জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেও তাকে দুর্গা বলা হয়ে থাকে।
দুর্গতি নাশিনী দেবী দুর্গার আগমনে ভক্ত পূন্যার্থীরা গতকাল শনিবার পূজামন্ডপগুলোতে সমবেত হন আনন্দ ও শ্রদ্ধাকুল চিত্তে। পূজা শেষে সকলে মিলে জগজ্জননী দুর্গার চরণে নিবেদন করেন পূষ্পাঞ্জলি। সুখ ও সমৃদ্ধি কামনায় সমাগত পূন্যার্থীদের কন্ঠে সম্বস্বরে উচ্চারিত হয় শান্তি মন্ত্র। নানা বয়স ও শ্রেণী পেশার মানুষের উপস্থিতিতে প্রতিটি মন্দির প্রাঙ্গণ পরিণত হয় মহাতীর্থে। বিকেল থেকে প্রতিমা দর্শনার্থীদের ঢল নামে রাস্তায় রাস্তায়, প্রতিটি মন্দির এলাকা পরিণত হয় জনারণ্যে। তবে বৃষ্টির কারণে পূন্যার্থীদের পোহাতে হয় কিছুটা ভোগান্তি। তবুও তারা দেবীর দর্শনের উদ্যেশ্যে ঘুড়ে বেড়ান নগরীর বিভিন্ন পূজা মন্ডপে।
নগরীর রাজাহাতা কালী মন্দিরের পূরোহিত নারায়ন চক্রবর্তী সোনার দেশকে বলেন, আজ (শনিবার) সূর্যোদয়ের পরে পঞ্চবোধের পূজা হয় ষষ্ঠীর ঘটে। এরপর করা হয় নবপত্রিকার ¯œান। গঙ্গাজলের সঙ্গে পঞ্চশস্য, হলুদ প্রভৃতি দিয়ে ¯œান করানো হয় নয় রকমের গাছকে। গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে কলার গাছ, কচুর গাছ, হলুদের গাছ, জয়ন্তির গাছ বা গাছের শাখা, বেলের গাছ বা গাছের শাখা, ডালিম গাছ বা গাছের শাখা, মানকচুর গাছ, ধানের গাছ ও আশোক গাছ বা গাছের ডাল।
পূরোহিত নারায়ন চক্রবর্তী সোনার দেশকে আরো বলেন, কলা গাছকে নবপত্রিকার পর শাড়ি পড়িয়ে মন্দিরে প্রবেশ করিয়ে গণেশের পাশে স্থাপিত করা হয়। এরপর দেবী দূর্গা গরম জল করা হয়। এসময় বেলের ডাল (আট আঙ্গুল) দন্দকাকাউ হিসেবে দেবীকে উৎসর্গ করা হয়।
এরপর দেবী দূর্গার মহা¯œান করা হয়। গঙ্গাজলের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে দেবী দূর্গার মহা¯œান করানো হয়। দেবীর মহা ¯œান শেষে ভূতের পূজা করানো হয়। পূজায় ব্যবহৃত হয় ডাল, সেদ্ধ সরিসা। অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতে মূলত এ পূজা করা হয় বলে জানান পূরোহিত নারায়ন চক্রবর্তী।
ভূতের পূজার পর মন্ডপের সব প্রতিমার চক্ষুদান করানো হয়। এরপরেই প্রাণ প্রতিমা করানো হয়। তারপর গণেশসহ পঞ্চ দেবদেবীর পূজা করা হয়। অতপর দেবী দূর্গাসহ সকল (উল্লেখযোগ্য) দেবদেবীর পূজা হয়। এ পূজায় ষোড়শ উপকরনে দেব দেবীদের পূজার বিধান রয়েছে। যা নববতিকার পূজা। পূজার শেষে সকালে ৫ রকমের ফল দিয়ে বাল্য ভোগ দেয়া হয়। আর দুপূরে পূর্ণ অন্য/ খিচুরি সঙ্গে ৫ রকমের তরকারি অথবা ৫ রকমের সবজী দিয়ে অন্নভোগ দেয়া হয় বলেও সোনার দেশকে জানান নগরীর রাজাহাতা কালী মন্দিরের পূরোহিত নারায়ন চক্রবর্তী।