বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম
‘বয়স বৈষম্য দূর করুন’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে এ বছর ২৬তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালিত হয়েছে। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৯১ সালের ১ অক্টোবর হতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশের মর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। অধিকার ও মর্যাদার ভিত্তিতে সকলকে নিয়ে এক সুন্দর বিশ্ব সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষেই এই প্রবীণ দিবস। প্রবীণ মানেই সেকেলে, অর্থব্য, অক্ষম, সংকীর্ণতা, অসুস্থতা এবং সংসারের বোঝা নয়। তারাই আজকের এই সুন্দর সমাজ গড়ার সুনিপুণ কারিগর। অথচ বয়স বৈষম্য প্রবীণদের অন্যতম একটি নেতিবাচক অবমাননাকর, অগণতান্ত্রিক, অমানবিক এবং অনৈতিক বিষয়। সমাজের কোন ক্ষেত্রেই তারা সমাদৃত হন না। বরং চরম অবহেলা, অবজ্ঞা, সমালোচনা আর উদাসীনতা তাদের মনকে খুবই আহত করে। এতে শুধু প্রবীণরাই বিছিন্ন হচ্ছেন তা নয়। আমরাও বঞ্চিত হচ্ছি তাদের অভিজ্ঞতা ও সম্পৃক্ততার সুফল থেকে যা মোটেই কাম্য নয়।
আধুনিক সমাজে অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণরা শুধুই অবহেলিত এবং বঞ্চিত। একাকি বাড়িতে বা বৃদ্ধাশ্রমে তারা যান, কেউ বা নিতান্ত বাধ্য হয়েই এই ভাগ্যকে বরণ করে নেন। পুত্র, কন্যা, আপনজন ও আত্মীয় স্বজনদের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তারা মানসিকভাবে মর্মাহত হয়ে অত্যন্ত কষ্ট ভোগ করেন। একাকিত্ব যেন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গি। অসহায় হয়ে তারা অবসুস্থতার মধ্যে দিন যাপন করেন। ইসলাম ধর্মে প্রবীণদের সেবা করা মানুষের অন্যতম ফরজ কাজ করে দেয়া হয়েছে। ফ্রান্সিস বেকেন এর মতে, ‘নৈতিক জগতে নবীনদের প্রাধান্য আর প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে প্রবীণদের। পল রবসন এর মতে, ‘সবাইকে একদিন বৃদ্ধ হতে হবে। যারা-যুবক, যুবতী তাদের এ কথাটি মনে রাখা উচিত। বৃদ্ধদের সম্মান করতে না পারো, অসম্মান করো না।
মোগল স¤্রাট আওরঙ্গজেব। তিনি ১৬১৮ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরা নাম হাফেজ আবু জাফর মোহাম্মদ মহিউদ্দীন আওরঙ্গজেব। ১৭০৭ খৃীস্টাব্দে ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুকালে তিনি তাঁর পুত্র কামবকসকে এই বলে চিঠি লিখেছিলেন,- ‘আজ আমি বৃদ্ধ, জরাজীর্ণ, শরীর একান্ত দুর্বল। যখন জন্মেছিলাম তখন কত লোক ও ঐশ্বর্য-প্রাচুর্যই না ছিল। জীবনের উজ্জ্বল দিনগুলি চলে গিয়েছে। আছে শুধু অস্থি, চর্ম, আর কংকাল। আজ আমি একা, অসহায়, অস্থির ও বিমূঢ়। তাঁর এই চিঠিতেও বোঝা যায় যে, স¤্রাট আওরঙ্গজেব প্রবীণ বয়সে কত অসহায় এবং একাকিত্বের মধ্যে ছিলেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ প্রবীণ। আগামী ২০১৫ সালে প্রবীণদের সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০৫০ সালে প্রায় ৪ কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি। ২০৫০ সালের দিকে এদেশের ২০ শতাংশ নাগরিক হবেন প্রবীণ এবং শিশু জনসংখ্যা হবে ১৯ শতাংশ। প্রবীণ বা বৃদ্ধ বয়স মানব জীবনের শেষ ধাপ। মানুষ জীবনের শিশু কৈশর ও যৌবনকাল পার করে বার্ধক্যে আসে। অর্থাৎ তারা প্রবীণে পরিণত হয়। বৃদ্ধ বা প্রবীণ জনগোষ্ঠির সংখ্যার দিক দিয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। ৯৬টি দেশের তালিকার সবচাইতে নিচে আছে আফগানিস্তান। ভারতের অবস্থার ৭১, আর বাংলাদেশের ৬৭।
প্রবীণ বা বৃদ্ধদের প্রতি দায়িত্ব শুধু পরিবারেই নয় বরং সমাজের সবারই উচিত প্রবীণদের মান্য করা গুরুত্ব দেয়া, তাদের সাথে পরামর্শ করা, তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সাথে সাথে তাদের সম্মানজনক জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা। প্রবীণরা যেন কারো আচরণে কখনো মনে কষ্ট না পায় সে ব্যাপারে অবশ্যই খেয়াল করা। সমাজে তাদেরও যে প্রয়োজন আছে একথা তারা যেন অনুধাবন করতে পারে।
আসলেও তাই, বাস্তব জীবনে প্রবীণ ব্যক্তি না থাকলে পারিবারিক জীবনে অসম্পূর্ণতা থেকেই যায়। বিভিন্ন হাদিসে প্রবীণ বা বৃদ্ধদের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ছোটদের ¯েœহ করে না এবং প্রবীণ ও বয়স্কদের সম্মান করে না, তাদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন নয়, সে ব্যক্তি আমার উম্মত নয়- (তিরমিযী, আস সুনান ৪/৩২১)।
পুলিশ ও র্যাবে দীর্ঘদিন চাকরি করাকালীন অনেক জায়গায় দেখেছি, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণরা আজ অরক্ষিত, অসহায়, অভাবী, বিচ্ছিন্ন এবং বয়স বৈষম্যসহ নানামুখি বৈষম্য এবং দুর্ব্যবহারে জর্জরিত। তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। এমন কী কোথাও কোথাও তারা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। অথচ তাঁরা দেশের সিনিয়র সিটিজেন। দুর্বল স্বাস্থ্য আর উপার্জনহীন একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে পদে পদে স্বজন, সমাজ, পরিবার, কর্মস্থলসহ সকলের কাছে অবহেলা, উপেক্ষা, দুর্ব্যবহার এবং নানা ধরনের নির্যাতনের সম্মুখিন হতে হয়। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ব্যাংক, ডাকঘর, পেনশন তোলার কেন্দ্র, চিত্তবিনোদনস্থলসহ সকল গণসেবা কেন্দ্রে তিনি আর মোটেই সমাদৃত হন না। পেশাজীবীসহ সকলের কাছেই তিনি যেন অনাহুত, অসমাদৃত এবং উটকো ঝামেলা বিশেষ। তাকে গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে যেতে চায়। কারণ তার দোষ তিনি একজন বয়োবৃদ্ধ প্রবীণ। বিশ্ব প্রবীণ দিবস উপলক্ষে এ ধরনের একটি সত্য ঘটনা সম্পর্কে না লিখে পারলাম না। এ ধরনের অনেক ঘটনার কথা মনে পড়লে দু’চোখের পাতা পানিতে ক্রমেই ভরে উঠে।
করিম সাহেব বুঝতে পারেন ইদানিং তার প্রতি বাড়ির লোকজনের পারিবারিক সম্পর্ক ও শ্রদ্ধাবোধ একদম কমে গেছে। এই তো সেদিন দুপুরে বাসায় ঢুকেই দেখেন লোকজন সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। তাকে দেখেই বড় বৌমা বলে বসে, বাবা আমরা খেয়ে নেই। টেবিলে ভাত বাড়া থাকবে। আপনি পরে এসে খেয়ে যাবেন। করিম সাহেব ভাবেন, আগে এই সংসারে তার কতই না কদর ছিল। অথচ অবসরের পর থেকে পরিবারে তার অস্তিত্ব বোঝার মতো। সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক ক্রমেই শিথিল হয়ে যাচ্ছে। বয়স্ক হিসেবে সম্মানটুকুও ঠিকমতো পাচ্ছেন না।
স্ত্রী দু’ছেলে নিয়েই করিম সাহেবের সংসার। ছেলে দুু’টি বিবাহিত স্ত্রীর সাথে বসবাস করে। তিনি স্থানীয় একটি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করে সম্প্রতি অবসরে গেছেন। প্রথমে কিছু না বললেও ইদানিং বৌমারা কথায় কথায় তার সঙ্গে তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হয়ে অসম্মানজনক কথাবার্তা বলে থাকে। অথচ আগে তারা মুখ তুলে কথা বলতো না। তাকে খুব সমীহ এবং শ্রদ্ধা করতো। গতকাল দুপুরে রান্না ভাল হওয়ার কারণে ভাত একটু বেশি খাওয়ায় ছোট বৌমা বলেই বসে, বাবা আপনার বয়স হয়েছে। এ বয়সে এত ভাত গিলেন কীভাবে? এ ধরনের অশালীন কথা শুনে করিম সাহেব মনে ব্যথা পেলেও মুখ ফুটে কিছু বলেন না।
করিম সাহেব কিছুক্ষণ পরপর চা পান করে থাকেন। বলতে গেলে ছোট থেকেই চায়ের প্রতি তার নেশা। স্ত্রী বেঁচে থাকতে প্রায়ই বলতেন- আমি যখন থাকবো না, তখন কে তোমাকে চা বানিয়ে দেবে? করিম সাহেব ম্লান হেসে বলতেন, বৌমারা তো মেয়ে, তারাই বানিয়ে দেবে। শুনে স্ত্রী হেসে বলতেন, বানিয়ে দিলেই ভালো। কিন্তু স্ত্রী মারা যাওয়ার পর অবসরের প্রথম দিকে বিরক্তবোধ না করলেও এখন চা চাইলেই বৌমারা চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে মুখের উপর যা তা শুনিয়ে দেয়। আজ সকালে প্রাতঃরাশ সেরে বাসায় এসে করিম সাহেব এক কাপ চা চাইতেই বড় বৌমা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে মুখ ঝামটা মেরে বলে বসে-বাবা, আমি আপনার কেনা গোলাম নই যে, হুকুম করা মাত্রই চা নিয়ে হাজির হবো। এ সময় ছোট বৌমা এসে বড় বৌমাকে সমর্থন করে জানায়, ঠিক বলেছেন আপা। বুড়ো হয়েছে অথচ কা-জ্ঞান দিন দিন লোপ পেয়েছে। যখন তখন হুকুম আর ফাইফরমাশ। সকালে যে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাবো তার জো নেই। সকাল বেলা চায়ের জন্য কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে। বৌমারা করিম সাহেবকে দু’কথা শুনিয়ে যার যার ঘরে চলে যায়। তিনি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তার দু’চোখের পাতা অশ্রু সিক্ত হয়ে ওঠে। ভাবেন, তাই তো তিনি বুড়ো হয়েছেন। বুড়োরা তো মানুষ নয়, তারা সংসারের বিরাট বোঝা।
একদিন দুপুরে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার সময় বড় বৌমা বলে- বাবা, কাপড়-চোপড় ধোন না কেন? আপনার পরনের জামা শুধু ময়লাই হয়নি, তা থেকে বিশ্রি গন্ধ বেরুচ্ছে। এখানে বসাই যাচ্ছে না। আপনি উঠে গিয়ে আপনার ঘরে বসুন। এখন থেকে কাজের ছেলে আপনার ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসবে। করিম সাহেব বড় বৌমার এ ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক কথায় খুবই দুঃখ পেলেও মাথা নেড়ে সায় জানান। ছেলেদের অবর্তমানে তাকে নিয়ে বৌমারা সারাদিন সমালোচনায় মুখর থেকে বিদ্রুপ আর হাসাহাসিতে মেতে ওঠে। ছোট বৌমা তো একটু আগ বাড়িয়ে বলে, বুড়োটা পড়াতে পড়াতে মাথার মগজ কমে গিয়ে এখন নিজেই গরু-ছাগলে পরিণত হয়েছে। বৌমার ভাবটা এমন যেন তাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচে। করিম সাহেব ভেবে পান না, তাদের পাকা ধানে তিনি কি মই দিয়েছেন?
দুপুরে করিম সাহেব একগাদা কাপড় নিয়ে কলতলায় গেলে কাজের ছেলে কাপড় কেঁচে দিতে চাইলে ছোট বৌমা রেগে বলে, মাসুদ তুই বাজার যা। যার কাপড় তাকে কাঁচতে দে। অগত্যা মাসুদ কাপড় না কেঁচেই বাজারে চলে যায়। এদিকে করিম সাহেব সাবান না পাওয়ায় শুধু পানি দিয়ে তার কাপড়গুলো কেঁচে রোদে মেলে দেন। বড় বৌমার কাছে সাবান চেয়েছিলো। কিন্তু না দিয়ে বরং বৌমা ব্যাঙ্গাত্মক কথায় বলে, কথায় কথায় সাবান চান কেন? সাবান কী গাছে ধরে যে চাইলেই পাওয়া যায়। সাবান নেই, পানি দিয়ে কাপড় কাঁচুন। এ বয়সে ওতো ফ্যাশান করতে হবে না। বৌমার কথা শুনে করিম সাহেব ভীষণ কষ্ট পেয়ে কোন কথা না বলে চুপচাপ কাপড় কেঁচে রোদে মেলে দেন।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর রাতে না ঘুমানো পর্যন্ত সারাদিন বৌমারা করিম সাহেবকে কথায় কথায় রাগারাগি আর অপমানজনক কথা বলতেই থাকে। পান থেকে চুন খসলেই শুরু হয় জ্বালা-যন্ত্রণা, বকাবকি, খারাপ ব্যবহার আর কট ুও তীর্যক কথাবার্তা। তাদের অভদ্রোচিত এবং অমার্জিত আচরণে করিম সাহেব অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ছেলেদেরকে বললেও তারা কিছু না বলে নিজ নিজ বৌকে অন্ধের মতো সমর্থন করে। শুধু তাই নয়, বৌদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অপবাদ দেয়ার জন্য তারা বাবাকে তীব্র ভাষায় ভৎর্সনা করতেও ছাড়ে না।
করিম সাহেব সন্ধ্যার সময় টেলিভিশনে খবর দেখেন। সেদিন শুক্রবার ছুটি থাকায় ছেলেরা বাহিরে না গিয়ে বাসার টিভির সামনে বসে ভারতীয় সিরিয়াল দেখার সময় করিম সাহেব বড় বৌমার ঘরের দরজায় গিয়ে বলেন আসিফ ঘরে আছিস বাবা? আমি তোর ঘরে বসে টিভিতে সান্ধ্যকালীন খবর শুনতে চাই। শুনে বড় ছেলে বলে, বাবা তুমি ভিতরে এসো। ছেলের কথায় করিম সাহেব ভিতরে ঢোকা মাত্রই বড় বৌমা প্রচ- রেগে চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে, বুড়োর ভীমরতি দেখ। এ বয়সেও টিভি দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে। বড় বৌমার এ কথা শুনে করিম সাহেব লজ্জিত হয়ে বলে, বৌমা আমি টিভিতে খবর শুনতে এসেছিলাম। তোমাদের অসুবিধা হলে আমি চলে যাচ্ছি। এ কথা বলে করিম সাহেব তার রুমে রক্ষিত স্ত্রীর ফটোর সামনে গিয়ে কেঁদে বলেন, শরিফা কেন তুমি আমায় ছেড়ে একা চলে গেলে। আমাকেও নিয়ে যাও, আমি যে আর পারছি না। করিম সাহেব ভেবেছিলেন, বড় খোকা এসে তাকে বুঝিয়ে খবর শোনার জন্য নিয়ে যাবে। কিন্তু বড় খোকা আর আসেনি। এদিকে করিম সাহেব যেন টিভি দেখার জন্য মেঝ ছেলের ঘরে যেতে না পারে সেজন্য মেঝ বৌমা তাদের ঘরের দরজা সজোরে লাগিয়ে দেয়। দরজা লাগার শব্দে করিম সাহেব নিজেকে চরম অপমানিত বোধ করেন। এ সময় তার বুক থেকে একটি বড় দীর্ঘশ্বাস বের হয়।
ঘরে এসে করিম সাহেবের মনে পড়ে বিয়ের পর যেদিন তিনি বাসায় প্রথম টেলিভিশন কিনে এনেছিলেন, সেদিন স্ত্রী শরীফাকে নিয়ে সারাক্ষণ টিভির সামনে বসে একটার পর একটা অনুষ্ঠান দেখেছিলেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর সন্ধ্যে হলেই একত্রে দুজনাই বসে টিভি দেখতেন। পুরনো দিনের সে সব কথা মনে করে দুঃখে পুনরায় তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। করিম সাহেব অবশ্য টিভিতে অন্য অনুষ্ঠানের চেয়ে খবর শোনাটাই পছন্দ করেন। তাই তো আজ টিভি-তে খবর শুনতে চাওয়ায় ছেলের সামনে বৌমাদের কাছে কি অপমানটাই না হলেন?
দু’দিন পর দুপুরে বড় খোকার ছেলে স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে দাদুকে দেখে তার কোলে উঠে বলে, দাদু আমাকে আগের মতো আর ডাক না কেন? কতদিন তোমার সাথে বেড়াতে যাইনি। শুনে দাদু তাকে জড়িয়ে ধরে। তাই না দেখে বড় বৌমা তেড়ে আসে। পারলে করিম সাহেবকে মারে আর কী? বৌমা বলে, খোকা তাড়াতাড়ি নেমে আয়। দেখিস না ওনার কাপড়-চোপড় কি নোংরা। গা থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে। ওনার কোলে থাকলে তুই অসুস্থ হয়ে যাবি। ছেলে মাকে বলে, মাগো দাদুর এই কোলেই বাবা, ছোট চাচা মানুষ হয়েছে। কই তারা তো অসুস্থ হয়নি। তুমি দাদুকে এ ধরনের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলবে না। দাদু শুধু বয়স্কই নয়, এ বাড়ির অভিভাবক। তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলো। এ কথায় বড় বৌমা ছেলেকে চড় মেরে জোর করে করিম সাহেবের কোল থেকে নামিয়ে নিয়ে চলে যায়। যাবার সময় ক্ষেপে গিয়ে বলতে থাকে, ওই বুড়োটাই আমার ছেলেটার মাথা খেয়েছে। বুড়োটা এখান থেকে সরে না কেন?
করিম সাহেব একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় দেখেন শুধু ডাল আর ভাজি দিয়ে তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। অথচ ওইদিন মেহমান আসবে বলে তিনি বাজার থেকে মুরগী, খাশির মাংশ, ইলিশ মাছ এনেছেন। যথারীতি সেগুলো রান্নাও হয়েছে। করিম সাহেব দুঃখ পেলেও লজ্জায় বড় বৌমাকে কিছু বলেন না। বরং অসুস্থ অজুহাতে দুপুরে না খেয়ে থাকেন। কাজের ছেলে এ কথা বড় বৌমাকে বলায় সে করিম সাহেবের ঘরে এসে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলে, ভাত না খেয়েই দেমাগ দেখাচ্ছেন। এতো দেমাগ ভাল না। যা দিবো তাই খেতে হবে। বসে বসে খাচ্ছেন তো, টের পাচ্ছেন না? করিম সাহেব বড় বৌমাকে করজোড়ে মিনতি করে জানায়, বৌমা খাবার নিয়ে আমি কোন কথা বলিনি। আমি তো শিক্ষক মানুষ, এ জ্ঞানটুকু আমার আছে। এ কথা শুনে বড় বৌমা রাগত স্বরে বলেন, আমাকে জ্ঞান দিয়ে তর্কাতর্কি করে অপমান করছেন? আসুক আপনার ছেলে, এর বিহিত ব্যবস্থা না করলে আজই বাপের বাড়ি চলে যাবো। এ সময় ছোট বৌমা এসে বড় বৌমাকে সমর্থন করে আরও উসকিয়ে দেয়। মনে মনে প্রমাদ গুনতে থাকেন, না জানি ছেলেরা আসলে কি কা-টাই না ঘটে?
রাত্রিতে বড় এবং ছোট ছেলে এলে বৌমারা ইনিয়ে বিনিয়ে করিম সাহেবর বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলে তাদের মন বিষিয়ে তুলে। দু’জনাই নিজ নিজ বৌয়ের মিথ্যা অভিযোগ শুনে অসুস্থ বাবাকে তাৎক্ষণিক তলব করে বারান্দায় নিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলে রাগারাগি আর অপমান-অপদস্ত করে। বৌদের প্ররোচণায় ছেলেদের এমন আচরণ দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান। কোন কথা না বলে নিশ্চুপ থেকে দু’চোখ দিয়ে পানি ঝরাতে থাকেন। করিম সাহেব এ অবস্থা দেখে আড়াল থেকে বৌমারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে টিটকারি মারতে থাকে। ছেলেদের বলা শেষ হলে করিম সাহেব তাদেরকে বলেন, বৌমারা তোদের কাছে কী বলেছে জানি না। বড় বৌমা আজ রাগ করে অনেক আজে বাজে কথা বললেও আমি প্রতি উত্তর না করে নিশ্চুপ ছিলাম। অথচ তার কথা শুনে যাচাই না করে জন্মদাতা বাবাকে শুধু অপমানই নয়, সাথে সাথে দূরত্বও সৃষ্টি করলি। করিম সাহেবের কথা শুনে ছোট ছেলে তার সাথে তুমুল তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়ে এবং উত্তেজনার এক পর্যায়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।
করিম সাহেব গেটের বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বাড়িতে ঢোকার জন্য ছেলেদের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় এবং কাকুতি মিনতি করেন। কিন্তু কিছুতেই তাদের পাষাণ হৃদয় গলাতে পারেন না। অগত্যা তিনি কোন উপায় না দেখে বিফল মনোরথে রেলস্টেশনে গিয়ে বেঞ্চির মধ্যে শুয়ে অভুক্ত থেকে সারারাত কাঁদেন। কোন উপায় না পেয়ে অবশেষে খুব ভোরে এক রকম বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ভাবেন, সেখানে কেউ তাকে কোন প্রকার কটু কথা এবং গলা ধাক্কা দিয়ে অপমান তো করবে না। আর কিছু না হোক বাকি জীবনটা সেখানেই তিনি কোন রকমে কাটিয়ে দিতে পারবেন। দুঃখ শুধু একটাই তার এবং স্ত্রী শরীফার নিজের হাতে গড়া বাড়িতে থেকে জীবনের শেষ নিশ্বাসটুকু ফেলা হবে না।
আমরা ভুলে যাই যে, বেঁচে থাকলে সকলকেই একদিন প্রবীণ হতে হবে। বিশ্ব প্রবীণ দিবসে আমাদের শপথ হোক, আমরা সব সময় প্রবীণদের সিনিয়ার সিটিজেন হিসেবে মান্য করে তাদেরকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবো। যে কোন বিষয়ে গুরুজন হিসেবে তাদের মতামতকেই প্রাধান্য দিবো। তাদের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা সহ সব ধরণের দুঃখ, কষ্ট, অসুবিধা দূরীকরণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো। কখনোই তাদের সাহচার্য ত্যাগ করবো না। সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে প্রবীণদের মর্যাদা সবার ওপরে। একটা কথা আবশ্যই মনে রাখা উচিত, আজ যারা নবীন, আগামীতে তারাই প্রবীণ। বেঁচে থাকলে সকলকেই একদিন প্রবীণ হতে হবে। প্রবীণদের প্রতি নবীনদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা মার্জিত এবং শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রবীণদের মূল্যায়ন করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের অভিজ্ঞতাপূর্ণ মতামত, উপদেশ, পরামর্শ, বুদ্ধি ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে। তারা যেন বুঝাতে পারেন পারিবারিক এমনকী সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের প্রয়োজন এবং গুরুত্ব রয়েছে। আর তবেই প্রবীণরা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাদের জীবনকে আনন্দ চিত্তে সার্থক ভাববেন। ফলে প্রবীণদের জীবনটা হবে সফল, নচেৎ নয়।
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা (অব:)(আই.জি ব্যাজ, জাতিসংঘ ও রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত)