মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১১ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজশাহী সদর খাদ্য গুদামের বহুল আলোচিত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে এবার হোটেল ব্যবসায় শেয়ার দেয়ার নামে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আবদুর রহিমের ১০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সময়ে এ ধরনের মোটা অঙ্কের অর্থ প্রতারণার অভিযোগ উঠায় সংশ্লিষ্ট খাদ্য বিভাগ এবং বিভিন্ন মহলে তোলপাড় চলছে।
আবদুর রহিমের স্ত্রী আরিফা সুলতানার নামে প্রতারিত ব্যবসায়ীকে দেয়া কোটি টাকার চেক ডিজঅনার (চেকের বিপরীতে অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকা) হয়েছে। এছাড়া বাকি ২৫ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য স্ত্রীর নামে নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার একটি বাড়ি হস্তান্তরের জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন আবদুর রহিমের স্ত্রী। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও আবদুর রহিম ওই ব্যবসায়ীর কাছে বাড়ি হস্তান্তর করেন নি।
প্রতারিত হবার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা গত ৬ নভেম্বর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক, রাজশাহীর কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগের অনুলিপি রাজশাহী মেটোপলিটন পুলিশ কমিশনার, দুদক, র্যাব-রাজশাহীসহ বিভিন্ন দফতরে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া চেক ডিজঅনারের বিপরীতে রাজশাহীর আদালতে রহিমের স্ত্রী আরিফা সুলতানার নামে মামলা দায়ের করেছেন ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা।
লিখিত অভিযোগ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে খাদ্য কর্মকর্তা আবদুর রহিম তার স্ত্রী আরিফা সুলতানার নামে রাজশাহী নগরীর প্রাণকেন্দ্র বাস টার্মিনালের পশ্চিমে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) গোধুলী মার্কেটের তিন তলায় ১৪ হাজার বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ নেন। এরপর ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফাকে শতকরা ৫০ ভাগ শেয়ার বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করেন আবদুর রহিম। তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গোলাম মোস্তফা সোয়া কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। এরপর ২০১৩ সালের এপ্রিলে হোটেলটি চালু হয়। হোটেলটি ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করার দুই বছর পার হবার পরও ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফাকে তার শেয়ার বুঝিয়ে দেয়া হয় নি। একপর্যায়ে আবদুর রহিম গোলাম মোস্তফাকে শেয়ার দিতে অস্বীকৃতি জানান।
অপরদিকে একই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, হোটেল ব্যবসায় শেয়ার দেবার পাশাপাশি ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফার ছেলে ও জামাইকে খাদ্য বিভাগে চাকরি দেয়ার নামে ২৫ লাখ টাকা নেন আবদুর রহিম। কিন্তু গোলাম মোস্তফার ছেলে ও জামাইয়ের চাকরির ব্যবস্থা না করে তিনি তাদের ঘোরাতে থাকেন। এছাড়া ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফার কাছে ট্রাক ব্যবসা করার প্রলোভন দিয়ে আরো ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন আবদুর রহিম।
এদিকে হোটেল ব্যবসার শেয়ার এবং ছেলে ও জামাইয়ের চাকরির ব্যবস্থা না হবার কারণে একপর্যায়ে তিনশ টাকার স্ট্যাম্পে দুটি পৃথক চুক্তিনামা করা হয় ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। চুক্তি মোতাবেক আবদুর রহিমের স্ত্রী আরিফা সুলতানা রাজশাহীর অগ্রণী ব্যাংক, সাহেববাজার কর্পোরেট শাখার ৫০ লাখ টাকা করে মোট এক কোটি টাকার পৃথক দুটি চেক গোলাম মোস্তফাকে হস্তান্তর করেন। যার অ্যাকাউন্ট নম্বর : ০২০০০০২৩১৭০৫৭, চেক নম্বর : সিডিএ : ৬০০৪৯৩৭, তারিখ : ২৯/৬/২০১৬। পৃথক আরেকটি চেক হলো- চেক নম্বর : সিডিএ : ৬০০৪৯৩৮, তারিখ : ০১/০৭/২০১৬।
এ দুইটি চেক গোলাম মোস্তফা হাতে পাবার পর চলতি বছরের ১ জুলাই তিনি ঢাকা ব্যাংক, রাজশাহী সাহেববাজার শাখায় তার নিজ অ্যাকাউন্টে ৫০ লাখ টাকা করে মোট এক কোটি টাকার পৃথক দুটি চেক জমা দেন। এরপর ঢাকা ব্যাংক আরিফা সুলতানার দেয়া এক কোটি টাকার পৃথক দুটি চেক অগ্রণী ব্যাংকে জমা দেয়। অগ্রণী ব্যাংক এরপর ঢাকা ব্যাংককে জানিয়ে দেয় আরিফা সুলতানার উল্লিখিত অ্যাকাউন্টে টাকা জমা নেই। এ ঘটনার পর প্রতারিত হয়ে গোলাম মোস্তফা আদালতে মামলা করেন।
অপরদিকে গোলাম মোস্তফার ছেলে ও জামাইকে চাকরি দেয়ার নামে ২৫ লাখ টাকা গ্রহণের বিপরীতে নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার একটি বাড়ি হস্তান্তরের জন্য চুক্তি করেছেন আবদুর রহিমের স্ত্রী আরিফা সুলতানা। বাড়িটি বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের কাছ থেকে ২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে কেনেন আরিফা সুলতানা। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর বাড়িটি হস্তান্তরের চুক্তি হলেও আরিফা সুলতানা ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফাকে তা হস্তান্তর করেন নি।
ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা বলেন, খাদ্য কর্মকর্তা আবদুর রহিমের সঙ্গে আমার দীর্ঘ ২৫ বছরের সম্পর্ক। তিনি অত্যন্ত ধূর্ত ব্যক্তি। হোটেল ব্যবসায় শেয়ার, ছেলে ও জামাইয়ের চাকরি এবং ট্রাক কেনার নামে তিনি আমার কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। হোটেলে বিনিয়োগ এবং ছেলে ও জামাইয়ের নামে চাকরির জন্য দেয়া সোয়া কোটি টাকার প্রমাণাদি আমি তৈরি করতে পেরেছি। বাকি ২৫ লাখ টাকা দেয়ার প্রমাণ আমার কাছে নেই। কারণ আমি আবদুর রহিমকে সরল বিশ্বাসে টাকা দিয়েছি। কিন্তু তিনি আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে পথে বসিয়েছেন।
ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে খাদ্য কর্মকর্তা আব্দুর রহিমের সঙ্গে তার দুটো মোবাইল ফোন নম্বরে মঙ্গল ও বুধবার দীর্ঘসময় ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। ফোন বাজলেও তিনি ধরেননি। শেষে গতকাল বুধবার দুপুরে অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি অফিসে নেই।
এ ব্যাপারে রাজশাহীর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জামাল হোসেন বলেন, খাদ্য কর্মকর্তা রহিমের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ তদন্তের জন্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুজা আলমকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি তদন্ত করে সত্যতা পেলে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এছাড়া মনে করলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমার কাছে সুপারিশ করতে পারেন। বিষয়টি বর্তমানে তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে।
প্রসঙ্গত, আবদুর রহিমের দশ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজে বর্তমানে তদন্ত করছে দুদক।