রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৫ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
আব্দুর রউফ রিপন, নওগাঁ প্রতিনিধি:
নওগাঁর রাণীনগরের ভেটী সিদ্দিকীয়া ফাযিল (স্নাতক) মাদ্রাসার তিনটি নিয়োগে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অর্ধকোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া নিয়োগের কিছুদিন আগে ছেলেকে প্রায় ছয় লাখ টাকার মোটরসাইকেল কিনে দেয়ার বিষয়টি স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। অপরদিকে কতটুকু স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে সেই বিষয়েও পরীক্ষায় অংশ নেয়া একাধিক প্রার্থীর কাছ থেকেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ওই মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ, অফিস সহকারি (করণিক) ও আয়া পদে নিয়োগের জন্য ২০১৮ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেই বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থী না পাওয়া ও নিয়োগ নিয়ে তৎকালীন সাংসদের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ার কারণে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পক্ষে তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তিতে ২০২০ সালের উপনির্বাচনে নতুন সাংসদ এলে তার সঙ্গেও ওই নিয়োগ নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আইয়ুব আলী কৌশল করে সংসদ নির্বাচনের মৌসুমে গত বছরের অক্টোবরে গোপনে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
চলতি এপ্রিল মাসের তিন তারিখ পর্যন্ত সেই নিয়োগের মেয়াদ থাকায় আইয়ুব আলী অত্যন্ত গোপনে সব পদে প্রার্থী প্রস্তুত করে শনিবার (৩০মার্চ) জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। আর গোপনে নিয়োগ সম্পন্ন করার বিষয়টি বিভাগীয় কর্মকর্তা, মাদ্রাসার অন্যান্য শিক্ষক ও স্থানীয়দের মাঝে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভেটী গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান যে, নিয়োগে যদি লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করা না হয় তাহলে একজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কিভাবে প্রায় ছয়লাখ টাকা মূল্যের একটি দামী মোটরসাইকেল নিয়োগ পরীক্ষার কিছুদিন আগে ছেলেকে উপহার দিতে পারেন। অফিস সহকারি পদে ১৬লাখ টাকার বিনিময়ে মাসুদ শেখকে ও আয়া পদে ৯লাখ টাকার বিনিময়ে নাহিদা আক্তারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
তবে অধ্যক্ষ যেহেতু অন্য উপজেলা থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেহেতু সেই পদে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি এখনোও জানা যায়নি। ইতিমধ্যেই দুই পদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি পুরো এলাকায় ব্যাপক ভাবে চাউর হয়েছে। এছাড়া প্রভাবশালীদের ছত্রছাঁয়ায় দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত পদে থাকার দরুন আইয়ুব আলীর সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতিতে মাদ্রাসার শিক্ষকসহ স্থানীয়রা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও তার পেশীবলের কাছে নাকাল সবাই।
আয়া পদের একজন প্রার্থী ভেটী গ্রামের আয়েন উদ্দিনের মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা মোবাইল ফোনে জানান যে, তিনি বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে আয়া পদে আবেদন করেছিলেন। তার সঙ্গে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীও আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাদের মেধা ও যোগ্যতা থাকলেও ভেটি গ্রামের এসএসসি পাশ করা নাহিদা আকাতার নামের এক গৃহবধূকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাহলে এথেকেই প্রমাণিত হয় যে নিয়োগ প্রক্রিয়া কতটুকু স্বচ্ছ ও মেধার ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে যার সঙ্গে সমঝোতা করা হয়েছে তাকেই পাশ করিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
ভেটী মাদ্রাসার শিক্ষক আবু সাইদ মোবাইল ফোনে জানান প্রথম দিকে অধ্যক্ষ ওই নিয়োগ কমিটিতে তাকে রাখার কথা বললেও পরবর্তিতে অদৃশ্য কারণে তাকে আর নিয়োগ কমিটিতে রাখা হয়নি। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তার পছন্দ মাফিক ব্যক্তিদের নিয়োগ কমিটিতে রেখে অত্যন্ত গোপনীয় ভাবে নিয়োগটি সম্পন্ন করেছেন।
ভেটী মাদ্রাসার সহকারি অধ্যাপক ও নিয়োগ কমিটির সদস্য মো. আসাদুল ইসলাম আসাদ মোবাইল ফোনে জানান যে মাদ্রাসার মঙ্গলের স্বার্থে এই নিয়োগটি শতভাগ স্বচ্ছতা ও মেধার ভিত্তিতেই সম্পন্ন করা হয়েছে। এর বাহিরে যদি কোন প্রার্থী কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ করে থাকেন তাহলে তার সত্যতা পাওয়া গেলে জড়িত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এই বিষয়ে মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আইয়ুব আলীর মোবাইল ফোনে (০১৭২০৪৬৫৮৫৭) নিয়োগ পরীক্ষার দিন শনিবার (৩০মার্চ) একাধিকবার ফোন প্রবেশ করলেও তা রিসিভ করা হয়নি। এরপর থেকে সোমবার (০১এপ্রিল) রাত পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আইয়ুব আলীর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম মোবাইল ফোনে জানান যে, তিনি একজন বিভাগীয় কর্মকর্তা হলেও এই নিয়োগ বিষয়ে কোনো কিছুই জানেন না। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এই নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো বিষয়েই তার সঙ্গে পরামর্শ করেননি। এমনকি নিয়োগ পরীক্ষার দিন বিষয়টি জানার জন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে তার মোবাইল ফোনে অসংখ্যবার ফোন দিলে আইয়ুব আলী ফোন রিসিভ করেননি এবং পরবর্তিতে ফোনও দেননি। তাহলে এথেকেই প্রমাণিত হয় যে কতটা গোপনীয়তা রক্ষা করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।
ভেটী মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. সোহেল রানা মোবাইল ফোনে জানান যে, নিয়মানুসারে নিয়োগ পরীক্ষা মাদ্রাসায় সম্পন্ন না করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সম্পন্ন মেধা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হয়েছে। কোনো প্রকারের অনিয়ম করা হয়নি। এছাড়া আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি তার জানা নেই বলেও তিনি জানান।