শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৯ ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
নওগাঁ প্রতিনিধি:
নওগাঁর বৃহত্তম রাণীনগরের আবাদপুকুর হাটে খাস আদায়ের নামে দুই পক্ষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টোল আদায় করা হচ্ছে। প্রতি হাটেই অতিরিক্ত টোল আদায় করা হলেও প্রশাসনের কোন নজরদারি নেই। এতে করে হাটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা ইজাদারদের হাতে জিম্মি হয়ে লোকসান গুনছেন। এমন লুটতরাজ থেকে মুক্তি চায় হাটে আসা সকল ক্রেতা-বিক্রেতাসহ স্থানীয়রা। খাস আদায়ের রশিদে উল্লেখ করা হয় না আদায়কৃত টোলের পরিমাণ। আবার রশিদে না লিখে দায়সারাভাবে রশিদের উল্টোপাতায় টোল ছাড়া লিখে দেয়া হয় সবকিছু।
সপ্তাহের প্রতি রোববার ও বুধবার জেলার বৃহত্তম ধান ও পশুর এই হাটে আনুমানিক দেড় থেকে দুই হাজার গরু এবং এক হাজারের বেশি ছাগল-ভেড়া হাত বদল হয়। এছাড়া সর্বশেষ টোলের হার বিশিষ্ট কোন তালিকাও হাটের কোন স্থানে ঝুলানো নেই যে কোন ক্রেতা কিংবা বিক্রেতারা সেই টোলের হার দেখে খাজনা প্রদান করবেন। এছাড়া নিয়ম না থাকলেও প্রতিটি পণ্য বিক্রেতার কাছ থেকেও অতিরিক্ত টোল আদায় করা হয়। এই হাট যেন টোল আদায়কারীদের বাপদাদার পৈতিক সম্পত্তি।
জেলা প্রশাসন কর্র্তৃক নির্ধারিত টোল আদায়ের তালিকা অনুসারে এই হাটে আদায় করা হয় না কোন পণ্যের খাজনা। নওগাঁ জেলার হাট-বাজারের (উপজেলা ও পৌরসভা) নতুন প্রস্তাবিত টোল রেইটের তালিকার ১৪নং ক্রমিকের ক) গরু/মহিষ/ঘোড়া প্রতিটি ক্রেতার দেয় ৫শত টাকা (যা পূর্বে ছিলো ৪শত টাকা) আর খ) ছাগল/ভেড়া ইত্যাদি প্রতিটি ক্রেতার দেয় ২শত টাকা (যা পূর্বে ছিলো ১৫০শত টাকা) যে রেইটটি নির্ধারণ করা হয়েছে ১লা বৈশাখ ১৪২৯ বাংলা সন হতে কার্যকর হয়ে আসছে। ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা আবশ্যিকভাবে পালনীয় শর্তাবলীর ১নং এ বলা হয়েছে যে কোন ক্রমেই দুইপক্ষ হতে টোল আদায় করা যাবে না।
দুই পক্ষ হতে টোল আদায় প্রমাণিত হলে বা জোরপূর্বক টোল আদায় প্রমাণিত হলে জোরপূর্বক অর্থ আদায়ের জন্য দন্ডবিধি মোতাবেক ইজাদার-আদায়কারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে অথবা নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২নং এ বলা হয়েছে অনুমোদিত টোল আদায়ের তালিকা টিন অথবা কাঠের বোর্ড অথবা ডিজিটাল ব্যানার বা ঐ জাতীয় বোর্ডে স্পষ্ট অক্ষরে লিখে হাট-বাজারের প্রকাশ্য জায়গায় প্রদর্শন করতে হবে। টোল চার্ট প্রকাশ্যভাবে প্রদর্শন করা না হলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে জনসাধারণকে প্রতারণার দায়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন,২০০৯ ও সরকারি আদেশ অমান্যের জন্য দন্ডবিধিসহ উক্ত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন-বিধি মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে মর্মে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে আবাদপুকুর হাটে তার কোন প্রয়োগ নেই।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা, সর্বশেষ গত ১৪২৯সনে (২০২২খ্রি:) প্রকাশ্যে খোলা ডাকের মাধ্যমে হাটটি ভ্যাট-ট্রাক্স ছাড়া ৮০লাখ টাকায় ইজারা প্রদান করা হয়েছিলো। এরপর ২০২৩খ্রি: হাটটি খাস আদায়ের আওতায় আনতে একটি মহলের নির্দেশনা মোতাবেক ওই বছর আবাদপুকুর উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের স্কুল মাঠে পশুর হাট বসতে দিবে না মর্মে একটি মামলা দায়ের করলে পরবর্তিতে হাটটি মামলার যাতাকলে খাস আদায়ের আওতায় চলে যায়।
অপরদিকে খাস আদায়ে বাৎসরিক ইজারা প্রদানের কোন নিয়ম না থাকলেও উপজেলা প্রশাসন তা করে আসছে। আর খাস আদায়ের নামে প্রশাসনের সহযোগিতায় গত দুই বছর যাবত হাটের টাকা হরিলুট করছে কতিপয় একটি সিন্ডিকেট।
চলতি বাংলা ১৪৩১সনের (২০২৪খ্রি:) জন্য গত বৈশাখ মাসে আবাদপুকুর হাটটি জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে খাস আদায় কমিটির সদস্যদের উপস্থিতি ছাড়াই উপজেলা সদ্য বিদায়ী নির্বাহী কর্মকর্তা ও কমিটির সভাপতি উম্মে তাবাসসুম অবৈধ ভাবে গোপনে নামমাত্র খোলা ডাকের মাধ্যমে ইজারা প্রদান করেন। দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট হেলু মেম্বার গংদের কাছে প্রতি সপ্তাহে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ৩লাখ (৫২ সপ্তাহ) টাকার বিনিময়ে হাটের খাস আদায়ের ইজারা প্রদান করা হয়েছে। যে সিন্ডিকেটটি কৌশল করে বছরের পর বছর রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছাঁয়ায় আবাদপুকুর হাটের ইজারা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিটি পণ্যের নির্ধারিত হারের চেয়ে দ্বিগুন টাকা খাজনা হিসেবে আদায় করে আসছে।
গত বুধবার (১৭জুলাই) হাটে গরু কিনতে আসা উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের ক্রেতা জাকির হোসেন বলেন তিনি একটি গরু ৬৫হাজার টাকায় ক্রয় করার পর খাজনা দিতে হয়েছে ৬শত টাকা আর উপজেলার ডাকাহার গ্রামের বিক্রেতা জুয়েলের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ১শত টাকা। এছাড়া খাজনা আদায়কারী রশিদের অপর পাতায় হাতে সবকিছু লিখে দিলেও খাজনা কতটাকা নিলো তা লিখে দেয়া হয়নি।
হাটের টোল আদায়কারী দলের প্রধান হেলু মেম্বার মুঠোফোনে জানান হাটের ব্যবসায় ঠিক-বেঠিক দুটোই থাকে। দুই পক্ষের কাছ থেকে এবং নির্ধারিত টোলের চেয়ে বেশি টোল আদায় বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন ভাই বুধবার হাটে আসেন আপনার সঙ্গে কথা বলবো।
কালীগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল ওহাব চাঁন মোবাইল ফোনে জানান আমার ইউনিয়নের মধ্যে থাকা বৃহত্তম আবাদপুকুর হাটের খাস আদায়ের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কবে কিভাবে কখন খোলা ডাকের মাধ্যমে হাটের খাস আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বারবার জানতে চাইলেও আমাকে বিষয়গুলো জানানো হয়নি। উপজেলা প্রশাসন দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট হেলু মেম্বার গং এর সঙ্গে আঁতাত করে হাটের টাকা হরিলুট করছে। হাটের খাস আদায়ের ক্ষেত্রে কোন নিয়মই মানা হয়নি এবং মানা হচ্ছে না। দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেটের দখলে থাকা হাটটিতে কোরবানীর ইদের প্রতি হাটে প্রতিটি পশুর টোল আদায় করা হয় সরকারি হারের চেয়েও দ্বিগুন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও হাট কমিটির সভাপতি মোহাইমেনা শারমীন মুঠোফোনে বলেন, তিনি চলতি মাসের ১৪তারিখে নতুন ইউএনও হিসেবে উপজেলায় যোগদান করেছেন। তিনি বিষয়টি সবেমাত্র জানলেন। সরেজমিনে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
হাটের খাস আদায় কমিটির সদস্য ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো: রাহিদ সরদার বলেন, তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় সরকারি টোল আদায়ের তালিকা হাটের বিভিন্ন স্থানে ঝুলিয়ে দিই এবং মাইকিং এর মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতাদের অতিরিক্ত খাজনা না দিতে সচেতনতামূলক প্রচারণাও করেছি। কিন্তু হাট সিন্ডিকেট স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীদের ছত্রছাঁয়ায় সেই তালিকা রাতের আঁধারে তুলে ফেলে নিজেদের ইচ্ছে মাফিক টোল আদায় করে আসছে। ফলে সরকার যেমন লাখ লাখ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে অপরদিকে খাজনা আদায়ের নামে হাটে আসা হাজার হাজার ক্রেতা-বিক্রেতাদের গলা কাটা হচ্ছে। এমন অরাজকতা থেকে দ্রুত হাটটিকে রক্ষা করতে সরকারের একান্ত সুদৃষ্টি কামনা করছি।