বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৯ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
আত্রাই, বদলগাছী ও সাপাহার প্রতিনিধি
আত্রাইয়ে আবারো বাঁধ ভেঙে নতুন এলাকা প্লাবিত- সোনার দেশ
নওগাঁর আত্রাই, বদলগাছী ও সাপাহার অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল বুধবারও নতুন করে বাঁধ ভেঙে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ।
আত্রাইয়ে গতকাল সকালে পাঁচুপুর-মধুগুড়নই এলাকায় বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্পের বাঁধ ও পাকা সড়ক ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ২৪টি গ্রামের দুই হাজার ৫শ পরিবারের ১২ হাজার ৫শ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় চার হাজার ১২০ হেক্টর জমির ফসল। পাকা সড়ক ভেঙ্গে যাওয়ায় জেলা শহরসহ পাশর্^বতী উপজেলা সিংড়া ও নাটোর জেলার সাথে আত্রাই উপজেলার সম্পূর্ণ ও রাণীনগর উপজেলার আংশিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সরকারি ভাবে এখনও পানীবন্দি বন্যার্ত মানুষের মাঝে পৌঁছেনি ত্রাণ সামগ্রী। জানা গেছে, গত কয়েক দিনের একটানা ভারী বর্ষণে ও উত্তরের উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে উপজেলার পাঁচুপুর ইউপির সাহেবগঞ্জ, মালিপুকুর, পাঁচুপুর উজান পাড়া ও ভোঁপাড়া ইউপির ভরতেঁতুলিয়া গ্রামের বীরেন্দ্র নগর তহশিল অফিসের যাওয়ার রাস্তা ও পাঁচুপুরÑমধুগুড়নই তিন রাস্তার মোড় এলাকায় বরেন্দ্র প্রকল্পের পাকা সড়ক গতকাল বুধবার ভোর রাতে বেড়িবাঁধ পানির চাপে ভেঙ্গে যায় এবং সকাল থেকে আত্রাই-নাটোর ও নওগাঁ জেলা শহরের সাথে আত্রাই উপজেলার যোগাযোগের একমাত্র পাকা সড়কের মালিপুকুর-পাঁচুপুর এলাকায় দুইটি স্থানে ভাঙ্গনের ফলে আত্রাই উপজেলার সম্পূর্ণ এবং রাণীনগর উপজেলার আংশিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। পাকা সড়ক ও বেঁড়িবাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানি প্রবেশ করায় উপজেলার পাঁচুপুর বিশা, ভোঁপাড়া, সাহাগোলা, আহসানগঞ্জ, কালিকাপুর, হাটকালুপাড়া ইউপির পাঁচুপুর, মাীলপুকুর, জগদাশ, শিকারপুর, সাহেবগঞ্জ, মধুগুড়নই জয়সারা, খঞ্জর, নবাবেরতাম্বু, বিপ্রোবোয়ালিয়া, ভরতেঁতুলিয়া, কাশিয়াবাড়ি, ভোঁপাড়া, বলরামচক, মহাদিঘী, জামগ্রাম, কালিকাপুর, শলিয়া, বান্ধাইখাড়া, চকশিমলা, হাটকালুপাড়া গ্রামসহ নদীর তীরবর্তী প্রায় ২৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ২৪টি গ্রামের প্রায় ১২ হাজার ৫শ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া ভোঁপাড়া, পাঁচুপুর, সাহাগোলা, বিশা, কালিকাপুর ও হাটকালুপাড়া ইউনিয়নের বেশ কিছু আবাদী জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যার পানিতে ঘর-বাড়ি, এলাকার রাস্তাঘাট ও বেশ কয়েকটি প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বন্যাকবলিত মানুষ আত্নীয়-স্বজনের বাড়ি ও এলাকার বিভিন্ন বিদ্যালয়, পাকা রাস্তায় খোলা আকাশের নীচে ও উঁচু জায়গায় পরিবার-পরিজন আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয় কৃষি অফিসের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী এলাকার প্রায় চার হাজার ১২০ হেক্টর জমির রোপণকৃত রোপা-আমন ধান বন্যার পানিতে তলে গেছে। পাশাপাশি ওইসব এলাকার অনেক পুকুর ডুবে গিয়ে লাখ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। এ ছাড়াও নওগাঁর আত্রাই সিংড়ার পাকা সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে গত তিন দিন ধরে বন্যা দূর্গত মানুষের কাছে কোন ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে নি বলে জানিয়েছেন বন্যাদুর্গতরা।
আত্রাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোখলেছুর রহমান জানান, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ও পরিবারের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া বন্যা কবলিত মানুষদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে যে চাল বরাদ্ধ করা হয়েছে তা দ্রুত বিতরণ করতে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এদিকে বদলগছীতে ছোট যমুনা ও তুলশী গঙ্গা নদীর ভয়াবহ রূপ। বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধে ফাঁটল ধরেছে। আতঙ্কিত এলাকবাসী দিন রাত পাহারা দিচ্ছে বাঁধ। এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিপাতে মাঠ ঘাঠ তলিয়ে যায়। হাজার হাজার বিঘা রোপা আমন ধাঁন সহ বেগুন, পটল, মরিচসহ অন্যান্য শাক সব্জির ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। নদীর পানি ভয়াবহ বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ছোট যমুনা নদীর আরজী দাউদপুর, চক আলম, সেনপাড়া, দেউলিয়া, ইদ্রকপুর, পারসোমবাড়ী কাজল বিবরি মোড়ে তাজপুর, এনায়েতপুর সহ প্রায় ২০-২৫ জায়গাতে মারাত্নক ফাটল দেখা দেয়। তুলশী গঙ্গা নদীর দেউকুড়ী ভেংগে যাওয়ায় উপক্রম হয়ে পড়লে বিলাশবাড়ী ইউপির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান কেটু’র সহযোগিতায় এলাকাবাসী বস্তা ও খুটি দিয়ে বন্ধ করে দেয়। বাঁধের হুমকির স্থানগুলিতে বস্তা খুটি মেরে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছে এলাকাবাসী। পুরো বাঁধে হাজার হাজার লোক দিন রাত পাহারা দিয়েছে চলেছে বাড়িঘর রক্ষায়। এখন পর্যন্ত নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আতংকিত এলাকাবাসী মাচা বেঁধে বাড়ি ঘরের মালামাল হেফাজত করছে। বিলাশবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান কেটু ও আধাইপুর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন চৌধুরী বাঁধ রক্ষায় সার্বক্ষনিক বস্তা ও খুটি দিয়ে সহযোগিতা করে চলেছে এলাকাবাসীকে। থেমে নেই স্থানীয় সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম তিনিও সার্বক্ষণিক পরিদর্শন করছেন। গতকাল বিকালে পারসোমবাড়ী কাজল বিবির মোড়ে মারাত্মক ভাঙন ঠেকাতে এক হাজার বস্তা দিয়েছেন। এলাকাবাসীকে সব সময় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন সাংসদ। উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা অলি আহম্মেদ রুমী চৌধুরী, নওগাঁ জেলা পরিষদ সদস্য জহুরুল ইসলাম, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সম ফজলুল হক বাচ্চু, ইউএনও মাসুম আলী বেগ, উপজেলা প্রকল্প বাস্তয়ন কর্মকর্তা আবদুল করিম সার্বক্ষণিক বাঁধ পরিদর্শন করে চলেছেন, ইউপি চেয়ারম্যানসহ এলাকাবাসী অভিযোগ করেন- বিভিন্ন স্থানে বাঁধে মারাত্নক ফাঁটল ও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়ে পড়লেও নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে কোন সহযোগিতা করা হয় নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুম আলী বেগ জানান পানিবন্দি পরিবারদের মাঝে বিতরনের জন্য ৫০ মেঃ টন ত্রান বরাদ্দ পাওয়া গেছে শীঘ্রই তা বিতরন করা হবে।
অন্যদিকে সাপাহার উপজেলার পাতাড়ী ইউনিয়নের পূর্নভবা নদীর ৭টি বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এতে ওই ইউনিয়নের প্রায় তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নদীর গর্ভে বিলিন হয়েছে ৫ শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি। হাজার হাজার বিঘা জমির ধান, সবজি খেত, পুকুর, পান বরজ, আমের বাগান তলিয়ে গেছে। জানা গেছে, পাতাড়ী ইউনিয়নের জালশুকা, তিলনী, আদাতলা, পাতাড়ী, হাড়িপাল, কাউয়াভাষা, করমুডাঙ্গা, মির্জাপুর, তিলন ভাবুক সহ বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবার তীব্র সঙ্কটসহ চর এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এসব এলাকার দুর্গত মানুষরা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে।
খবর পেয়ে গত মঙ্গলবার বিকেলে নওগাঁ-১ আসনের জাতীয় সাংসদ বাবু সাধন চন্দ্র মজুমদার, উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল আলম শাহ চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাহাদ পারভেজ বসুনীয়াসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেন। বুধবার বিকেলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রান বিতরণ করেন নওগাঁ-১ আসনের সাংসদ সদস্য বাবু সাধন চন্দ্র মজুমদার। পাতাড়ী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মুকুল মিঞা জানান, জরুরী ভাবে বন্যায় আটকে পড়া পরিবারগুলোকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার এএফএম গোলাম ফারুক হোসেন জানান, বন্যায় পাতাড়ী ইউনিয়নে ৪৮০ হেক্টর আউস, দুই হাজার ৫শ হেক্টর রুপা আমন এবং ১০৬ হেক্টর শাক-সবজি সহ সর্বমোট ৩৮৬ হেক্টর ফসল ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ফাহাদ পারভেজ বসুনীয়া জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে চিকিৎসা, শুকনো চিড়া, চিনি, চালসহ বিভিন্ন খাবার বিতরণ করা হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ইতোমধ্যে পানিবন্দি পরিবারগুলোর প্রাথমিক তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলেও তিনি জানান।