নগরীতে ১১ ফেব্রুয়ারি যাচাই-বাছাই || মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তি, অভিযোগ

আপডেট: জানুয়ারি ২২, ২০১৭, ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক



প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি কার্যক্রম শুরুর আগেই তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেই দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দিয়েছে। রাজশাহী মহানগরীর ৬৭ জন তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাকে ইতোমধ্যেই অভিযুক্ত করা হয়েছে যে, তারা বিতর্কিত এবং তাদেরকেও যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় আনতে হবে। যেহেতু তারা অভিযুক্ত তারা কোনোভাবেই যাচাই-বাছাই কমিটির সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এটি খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করছেন অভিযোগকারীরা।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, আবেদনকৃত ও তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরীক্ষণ এবং তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে উপজেলা, জেলা/মহানগর যাচাই-বাছাই কমিটি করেছে সরকার।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১২ জানুয়ারি এসব কমিটি গঠনের আদেশ জারি করে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ে এর আগে গঠিত সব কমিটি বাতিল করেছে।
রাজশাহীতে ইতোমধ্যেই এই বিষয়টি নিয়ে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অস্থিরতা ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। অমুক্তিযোদ্ধা যারা ইতোমধ্যেই তালিকাভুক্ত হয়ে আছেন তারা এখন নানাভাবে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে করে তারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ না পড়েন। স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে মেতেছে বলেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দাবি করেছেন।  অনেকেই বিষয়টিকে এত সিরিয়াস হিসেবে না নেয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের কথা হলো- কী দরকার স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এসে তালিতাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাকে অমুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করার। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন যারা মুক্তিযোদ্ধা নয় অথচ তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেব তালিকাভুক্ত হয়ে পরিচয় দিচ্ছেন, সরকারের সুবিধা নিচ্ছে তারা প্রকৃত অর্থে মিথ্যেবাদী, অপরাধ করছেন। আর অপরাধীর প্রতি সহানুভুতি দেখানোর অর্থই হল দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অবমাননা।  আগামী প্রজন্মও বিষয়টিকে কোনোভাবেই ক্ষমা করবে না।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাচাইয়ের কার্যক্রমটি শুরুতেই যেভাবে হোঁচট খেতে শুরু করেছে, তাতে এর সাফল্য নিয়েই এখনই সংশয় দেখা দিয়েছে। কেননা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তাদের প্রায় সকলেই অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসীন দলের লোক হিসেবে পরিচিত। তারা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ইতোমধ্যেই ব্যবহার করে যাচাই-বাছাই কমিটির ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী মহানগরীর যে ৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিতর্কিত ও অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে রাজশাহী জেলা ও মহানগর কমান্ডের শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন রয়েছেন।
রাজশাহী মহানগরীতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি মনোনীত হয়েছেন রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ২০১৩ সালে গেজেটভুক্ত হয়েছেন। তাঁর নেতত্বে অন্য সদস্যরা হলেন, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিনিধি সদস্য রাজশাহী মহানগর ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার রবিউল ইসলাম, মহানগর ইউনিট কমান্ডার ডা. আব্দুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সদস্য মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মো. শফিুকুর রহমান রাজা, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিনিধি সদস্য মুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমান এবং এই কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাজশাহী। আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মহানগরীতে যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হবে।
মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট অধিশাখার বিজ্ঞপ্তি নং- ৪৮.০০.০০০০.৪৯.২৩৩.০৯-৯৪ তাং- ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ তে এই কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রকাশ করা হয়। এই কমিটি গঠনের পরপরই ‘অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিযুক্ত’ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রথমত তারা অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য দেনদরবার চালাচ্ছে। দ্বিতীয়ত তারা যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে যুদ্ধকালীন কমান্ডার শফিকুর রহমান রাজা ও মুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমানকে বাদ দেয়ার জন্য সরকারের উচ্চ মহলে দেনদরবার করছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। কেননা উল্লিখিত দুই মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত ৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ইতোমধ্যে ‘অমুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাজশাহী জেলা প্রশাসক বরাবর উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এক আবেদনে রাজশাহী মহানগরীর ৬৭ জনকে ‘অমুক্তিযোদ্ধা’ উল্লেখ করে তাদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। ওই অমুক্তিযোদ্ধারা বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছেন এবং তারা সরকারের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন।
ওই আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মো. শফিুকুর রহমান রাজা, চৌধুরী এম মনিরুল ইসলাম, আব্দুল জলিল মোল্লা, মোতাহার হোসেন, তৈয়বুর রহমান, মো. গোলাম রসুল, মোহাম্মদ আলী ও মো. আমিনুল ইসলাম টুকু।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘প্রতিটি কমিটি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তকরণ, আবেদনকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই, তালিকাভুক্ত দাবিদার মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই এবং তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে  আনীত অভিযোগ নিষ্পত্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করবেন।’’
একই মন্ত্রণালয়ের নং- ৪৮.০০.০০০০.৪৯.২৩৩.০৯-৯২ ১২ জানুয়ারি ২০১৭ এর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী  শর্ত আছে- ‘‘যাচাই-বাছাইয়ের আওতাধীন কোনো মুক্তিযোদ্ধা/ প্রতিনিধি যাচাই-বাছাই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না।’’ কিন্তু রাজশাহী মহানগর কমিটিতে ‘অভিযুক্ত’ মুক্তিযোদ্ধারা সদস্য হয়েছেনÑ বলছেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ ইতোমধ্যেই  মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রকের মন্ত্রী সহ  সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার শফিকুর রহমান রাজা অভিযোগ করার বিষয়টি স্বীকার করে সোনার দেশকে বলেন, তাদের করা অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটিতে প্রভাব পড়বে না। অভিযুক্তদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা তারা (অভিযুক্তরা) কোথায় কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে তা তারা জানেন না। মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল, তাও তাদের জানা নেই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই যদি তাদের না চেনে, সে ক্ষেত্রে তারা কীভাবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সনাক্ত করবেন। অবশ্যই অভিযুক্তদেরও যাচাই বাছাই করে সঠিকতা নিরূপণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাজশাহী মহানগর ইউনিটের কমান্ডার ডা. আব্দুল মান্নান বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও নীতিমালার আলোকেই যাচাই-বাছাই কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতেই পারে। নিশ্চয় সেটা যাচাই-বাছাই কমিটি দেখবেন। ডা. মান্নান সোনার দেশকে আরো বলেন, অভিযুক্ত যদি যাচাই-বাছাই কমিটিতে থাকে, সে ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল বিষয়টি দেখবে। তবে তিনি বলেন, অভিযোগটি আরো আগে হলেই ভাল হত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করার কাজটি মোটেও সহজ কিছু নয়।  অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই সুপারিশ করেছেন। তারা সুপারিশ করেছে সম্পর্কের কারণে কিংবা স্বার্থ হাসিলের জন্য।  এ ক্ষেত্রে এসব সুপারিশকে মিথ্যে প্রমাণ করতে হবে, যা কঠিনই বটে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ