মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১১ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
গোলাম কবির:
কোলকাতায় ১৯৪১ সালের বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির রজত জুবিলী অধিবেশনে নজরুল ইসলাম সভাপতির ভাষণে জীবনের মুক্তির পথ কোথায় এবং তার ভাবনার একটা দিক নির্দেশ করতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন: যার ইচ্ছায় আজ দেহের মাঝে দেহাতীতের নিত্য মধুর রূপ দর্শন করছি। তিনি যদি সব অস্তিত্ব গ্রহণ করে আমার আনন্দময়ী, প্রেমময়ী শক্তিকে ফিরিয়ে দেন, তা হলে এই বিদ্বেষ জর্জরিত ভেদজ্ঞান কলুষিত অসুন্দর অসুর নিপীড়িত পৃথিবীকে সুন্দর করে যাব; এই তৃষিতা পৃথিবী বহুকাল যে প্রেম, যে অমৃত, যে আনন্দ রসধারা থেকে বঞ্চিত, সেই আনন্দ, সেই প্রেম সে আবার ফিরে পাবে।’ কবির এই আকুলতা কখন কিভাবে এই তৃষিতা পৃথিবীতে বর্তমান ছিলো তা আমাদের ক্ষুদ্রজ্ঞানে সেসবের হদিস পায়নি। বিরোধ-বিবাদ চিরকালই ছিলো, তবে তার পরিধি এবং ব্যাপকতার পরিমাণ হয়তো দেখার কেউ ছিলো না; কিন্তু ছিলো এবং এই উজ্জ্বল জ্ঞান-রাশির যুগে তা কম নয়। আমাদের স্মরণ কালের ইতিহাস সেই সাক্ষ্য বহন করে। আমরা তার অক্ষম দর্শক মাত্র। সমাধানের অভাবে মানুষ অলৌকিকতার পদপ্রান্তে হুমড়ি খায়।
বাংলা সাহিত্যের ধারায় নজরুলের আবির্ভাব শাসনতান্ত্রিক সংক্ষুব্ধ যুগে। বাংলা তথা ভারত নিরবধি কালই শাসিত হয়েছে। দ-ের অধিকার পেয়েও ধর্ম আর মতবাদের প্রাধান্যের কারণে প্রশান্তি সর্বত্র বিরাজিত হয়নি। বাংলার মানুষের এই সংক্ষুব্ধ কালে নজরুলের আবির্ভাবে সময়টা ছিলো ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জৈষ্ঠ মোতাবেক ১১মে ১৮৯৯। পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য তাঁর আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি-বৈভব ছিলোনা। তবে মনোভূমি মানব মিলনের জন্য যে শিক্ষার প্রয়োজন, তা তিনি অর্জন করেছিলেন। তাঁর সাহিত্য পাঠে সহজভাবে এই মত পোষণ করা যায়।
বাইরের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতার আবরণ দিয়ে জীবন রক্ষার কর্মসাধন শুরু করলেও অবিলম্বে লেটোর গানে যোগ দিয়ে তিনি মানুষে মানুষে মিলনের সেতুবন্ধ শুরু করেন কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে। তারপর যথাবিধি এখানে সেখানে বিদ্যার্জনের চেষ্টা তিনি করে গেছেন, প্রায় অসহয়ের মত। তবে একটা সত্য স্মরণ রাখার যে তিনি আবেগের কাছে নিজেকে অনেক সময় ভাসিয়ে দিয়েছেন। তাই বলে মানবপ্রেম বিচ্যুত হয়েছেন কি কখনো। পুরষানুক্রমে কাজী পরিবারে জন্ম-স্থিতি হলেও জীবন পরিচালনাকালে বিশেষ কোনো ধর্মের প্রতি তিনি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন নি। এমন কি যুদ্ধ ফেরৎ নজরুল মতবাদী মোজাফফর আহমদের স্নেহছায়ায় কিছুদিন অবস্থান করলেও সেই মত-পথ ধারণ করে তিনি পরিচিতির দ্বারস্থ হননি। বিশেষ কোনো ধর্মের আশ্রয়ে থেকে তার পরিচর্যায় আদাজল খেয়ে পথে নামেননি। জীবনযুদ্ধে প্রায় পরাজিত নজরুল আবেগের বসে রাজনীতির খাতায় নাম লেখিয়ে প্রায় খালি হাতে ফিরে গেছেন। এক কল্পলোকের মানুষের মত তার জীবন; অথচ কোনো কিছু সচেতন পরিকল্পিত হয়নি। তবে একটি বিষয় তাঁর করোটিতে স্পষ্ট ছিলো, তিনি মানুষের মিলনকে মতবাদী ফাঁদে ফেলেন নি। যদিও আজকের বিশ্ব মতবাদ প্রধানই রয়ে গেছে। কেননা মানুষকে সহজে একমত করার সস্তা পুঁজি হলো মতবাদ। নজরুল সেই গোলক-ধাঁধায় চোখ রেখেছেন, কিন্তু নিমগ্ন হননি। সম্প্রীতির দ্বার তাঁর কাছে ছিলো অবাধ তবুও অনেকে তাঁকে ভুল বুঝেছে। তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় বলেছেন :
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর ‘মোল্-লারা’ কন হাত নেড়ে। ‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।/ফতোয়া দিলাম-কাফের কাজী ও, / যদিও শহীদ হইতে রাজী ও/ ‘আমপারা’ পড়া হামবড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে।/হিন্দুরা ভাবে ফার্শী শব্দে কবিতা লেখে-ও পাত-নেড়ে।
প্রায় সমসাময়িক কালে কবি ইকবাল ‘আমপারা পড়া’ হামবাগদের বলেছিলেন :
নালে বুলবুলকে শুনো আওর হাম ওয়াতানে গোস রাহু।/ হাম নাওয়ামে ভি কোই গুল হোঁ কে খামুশ রাহো/ (শেকওয়া) অর্থাৎ আমি ফুল নই যে বুলবুলির গান শুনে চুপ থাকবো। তিনি ‘জওয়াবে শেকওয়ায়’ তার জবাব দিয়েছিলেন। নজরুল সময় পাননি। অকালে তাঁর চেতনা স্তব্ধ হয়ে যায়।
মানুষে মানুষে মিলনের জন্য আমরা এখন সম্প্রীতির আসর করছি, নজরুল তার জীবন ধরে তা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাতে ফল হয়েছে এই যে, তাঁকে একান্ত আপন করতে গিয়ে অনেকটা পর করে ফেলেছি। পার্থিব জীবনে নজরুল মানব মিলনের যে মন্ত্র জপ করে তার পরিসীমা পান নি। মৃত্যুর পরেও যেন আরো জটিল হয়ে গেছে, ঐযে রওজা তৈরি করা হয়েছে মসজিদের পাশে, তা কিন্তু সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। বিষয়টি সে সময়ে অনেকের মনে উঁকি দিলেও ‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই’ গানটি মুক্ত মনে গ্রহণের সুযোগ আমাদের হয়নি। নজরুলের মানব মিলন আকাক্সক্ষা কেতাবি রয়ে গেছে।
নজরুলকে নিয়ে মূঢ় ধর্মবাদীরা ধর্মের গূঢ় বিষয় অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়নি। তবে রাজনীতিতে দলীয় উজ্জীবনের পন্থা হিসেবে একে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা ঐক্যের হয়নি। আমাদের ব্যক্তিস্বার্থের ঝাঁজ হয়তো কখনো অপসৃত হবেনা। আমরা কেবল মিলন মিলন করে হাবুডুবু খাব। আর নজরুলের ধর্মকেন্দ্রিক কবিতা ও গানগুলো সেখানে ব্যবহার করবো। জীবনে তা সন্নিবেশ হবে না। ফলে সম্প্রীতি আর মিলন পত্রিকার পাতায় নিবিষ্ট রয়ে যাবে, মানুষে মানুষে মিলনের পথ উন্মুক্ত হবেনা।
লেখক: সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ