রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মানুষের উচ্ছ্বাস একটু একটু করে স্তিমিত হয়ে আসছে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার অবশেষে স্বীকার করেছে, সংস্কার প্রত্যাশার ওজনটা অনেক বেশিই বোধ হচ্ছে।সাবেক প্রধানমন্ত্রী যেদিন দেশ ত্যাগ করেন, তার অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ন্যায় আমির চৌধুরী (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী) জেলে ছিলেন।
জুলাই মাসে দেশব্যাপী বিক্ষোভ আন্দোলন দমনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। সেই সময়ের এক অভিযানেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জ্যেষ্ঠ নেতা, আমির চৌধুরী, আটক হয়েছিলেন। শেখ হাসিনার ১৫ বছর মেয়াদকালে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো কারাবাস বরণ করেন তিনি।
তবে এবারের আন্দোলনের বড় পার্থক্য ছিল এর সম্মুখ সারির সদস্যদের পরিচয়ে। কোনও রাজনৈতিক দল আন্দোলনের চালিকা শক্তি ছিল না। এর শুরু করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল।
বিক্ষোভ দমনে কঠোর অবস্থান নেয় সরকার। লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস, রাবার ও তাজা গুলি- সবই ব্যবহার করা হয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ১ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। আটক করা হয় আরও কয়েক হাজার। বিক্ষোভ দমনে বাংলাদেশের ইতিহাসের নৃশংসতম অধ্যায় হিসেবে একে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
কিন্তু দিন শেষে কেবল হিতে বিপরীত হলো। পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। আশ্রয় নেন ভারতে। সেদিন ছিল ৫ আগস্ট।
সেদিন আমির লক্ষ্য করলেন যে, তার সেল বিএনপি কর্মী ও শিক্ষার্থীদের দিয়ে পূর্ণ। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার লুকিয়ে করেকটা রেডিও আনানোর ব্যবস্থা করেছিল। রেডিওতে প্রচারিত খবরেই তারা জানতে পারেন, লাখ লাখ মানুষ তার বাসভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। আর তিনি হেলিকপ্টারে করে দেশত্যাগ করেছেন।
পরদিন সকালেই আমির চৌধুরি ও তার সহ বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওইদিনের বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘তার (শেখ হাসিনা) চলে যাওয়ার খবর ছিল খুবই আকস্মিক। সবাই বোমা ফাটার মতো বিহ্বল অনুভব করছিল।’
হাসিনা সরকারে পতনের প্রায় মাস দেড়েক অতিক্রান্ত হতে চলেছে। বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষার্থীদের অনুরোধে নোবেলজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস দেশের অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের হাল ধরার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অধ্যাপক ইউনূসসহ তার সরকারের অনেক উপদেষ্টাই আগের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় শত্রু হিসেবে বিবেচিত হতেন।
রাজধানীর মোড়ে মোড়ে এখনও মানুষের উচ্ছ্বাসের রেশ কাটেনি। হুট করে যেন তাদের জীবনে বাক স্বাধীনতা ফিরে এসেছে। চায়ের আড্ডায় রাজনীতি নিয়ে ভয়ে ভয়ে কথা বলতে হচ্ছে না। তাদের ভাষায় এটি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’।
ঢাকার একটি হোটেলের লবিতে বসে নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করছিলেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও তিনি সার্বক্ষণিক পুলিশ নজরদারিতে থাকতেন। জনসম্মুখে স্বস্তিতে কোনও আলোচনা সভা করার কথা ভাবতে পর্যন্ত পারতেন না। প্রায় একই অভিজ্ঞতা অসংখ্য বিএনপির নেতা কর্মীরও। দিনের পর দিন আদালত আর কারাগারে ছুটে চলা ব্যক্তিরা আজ একটু দম ফেলার সময় পাচ্ছেন।
কিন্তু দেশের পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। অরাজক ও বিশৃঙ্খল অবস্থা এখনও বিরাজমান। দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ গার্মেন্টস খাতের একাধিক কারখানা বিক্ষোভের মুখে গত মাসে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখনও পূর্ণোদ্যমে দায়িত্ব পালন করছেন না। আগের সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে দীর্ঘদিন অনুগত থাকা পুলিশের ওপর জনগণ ক্ষোভ উগড়ে দেয় জুলাই-আগস্ট মাসে। একাধিক থানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া ও সংঘবদ্ধ পিটুনির স্মৃতি এখনও তরতাজা আছে তাদের মনে। ফলে জনগণকে নিয়ন্ত্রণে শক্ত হওয়ার সাহস দেখা যাচ্ছে না পুলিশের মধ্যেও।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় সামরিক বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়েছে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার। তাদের হাতে এখন টহল ,আটক, তল্লাশির মতো অধিকার আছে। সরকার একে দুই মাসের অস্থায়ী ব্যবস্থা বলে দাবি করেছে। তারপরও অনেকের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশ সংস্কারের যে অঙ্গীকার উপদেষ্টামণ্ডলী করেছেন, সেটা অত্যন্ত জটিল। কেননা পুরো ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে কয়েক বছরও প্রয়োজন হতে পারে। আইন-আদালত থেকে শুরু করে জ্বালানি খাত, আর্থিক খাত, এমনকি সংবিধান পর্যন্ত সংস্কারের দাবি উঠছে। এতসব দাবির তোড়ে সরকারের নাভিশ্বাস উঠে যাবার অবস্থা হয়েছে।
আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেজওয়ান আহমেদ রিফাত বলেছেন, ‘সংস্কারের পরিধি ব্যাপক ও জটিল। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আগের সরকারের অনেক দমনমূলক ব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান। এজন্যই সচিবালয়, পুলিশ বাহিনী ও বিচার বিভাগকে পুনর্গঠন করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন ও সুষ্ঠুভাবে কাজ শুরু করার আগ পর্যন্ত কোনও পরিবর্তনই আসবে না।’
সরকারের পিছে লাখো মানুষের সমর্থন থাকলেও ইউনূস সরকার যদি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে, তবে শিক্ষার্থীরা আবারও মাঠে নামবেন বলে জানিয়েছেন রিফাত।
ব্যক্তিগতভাবে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সফলতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে প্রকাশ্যে এমন কথা কমই হচ্ছে।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সরকার স্বীকার করেছে, জনগণের প্রত্যাশার চাপটা তাদের অনেক বেশিই অনুভূত হচ্ছে। এই প্রত্যাশা পূরণে তাদের অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হবে। বিশেষত গত ১৫ বছরে দেশের আর্থিক খাতের যে দৈন্যদশা হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে অনেক চড়াই উতরাই পার করতে হবে বলে মনে করছেন উপদেষ্টামণ্ডলী।
এ বিষয়ে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কাজ গোছানো হলেই নির্বাচন দেওয়া হবে। তখন নির্বাচিত রাজনীতিবিদরা দেশ চালাবেন আর আমরা আমাদের আগের জীবনে ফেরত যাব। সরকারের ক্ষমতাসীন পদে থাকার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের কারও নেই।’
তাদের কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে আরও কয়েকমাস লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তবে দেশে এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি জিজ্ঞাসা হচ্ছে, এই সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে। প্রাথমিকভাবে কয়েক মাসের কথা ধারণা করা হলেও, কেউ কেউ মনে করছেন সবকিছু গুছিয়ে আনতে ৫ থেকে ৬ বছরও প্রয়োজন হতে পারে।
এই বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমি সময়সীমা নিয়ে কোনও ভবিষ্যদ্বাণী দিচ্ছি না। সংস্কারে সময় প্রয়োজন হয়।’
বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল আপাতত ড. ইউনূসের কাজের বিরোধিতা না করে কেবল পর্যবেক্ষণ করছে। এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ বিএনপি নেতা আবদুল মঈন খান বলেছেন, ‘তারা যদি ব্যর্থ হয়, তবে নিজেরা তো ডুববেই, সঙ্গে দেশকেও ডুবাবে।’
অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কয়েক বছর ক্ষমতায় থাকার বিরোধিতা করেছে বিএনপি। দৃশ্যপটে না থাকা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনরোষের কারণে নির্বাচনে জয় লাভে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী তারা। তবে এই ব্যগ্রতার কারণে দেশে অস্থিরতা বাড়তে পারে বলে অনেকের অভিমত।
এদিকে, দীর্ঘদিন রাজনৈতিক পরিসরে শূন্যতা থাকলে উগ্রপন্থি বা ধর্মভিত্তিক কোনও দল শক্তিবৃদ্ধি করতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
তবে দেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও অনেকে যথেষ্ট আশাবাদী। তাদের মধ্যে একজন হলেন ৩৫ বছর বয়সী গাজি জাকারিয়া। তিনি বিক্ষোভের সময় আংশিক অন্ধত্বের শিকার ৪শ’ মানুষের একজন। তিনি বলেছেন, ‘হাসিনা সরকারকে নামাতে পেরেছি। তাই আমার এই ত্যাগ নিয়ে কোনও কষ্ট নেই। সংস্কারের স্বপ্ন নিয়েই আমরা জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমেছিলাম। ইউনূস সরকার তো সেই সংস্কারের জন্যই কাজ করছেন। তাই আমি এখনও আশাবাদী। রাতারাতি সব পালটানো তো সম্ভব নয়।’
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বাংলা ট্রিবিউন