নদী বাঁচুক, বাঁচুক দেশ

আপডেট: অক্টোবর ১৯, ২০১৬, ১১:৫৭ অপরাহ্ণ

শ্রভ্রারানী চন্দ
সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা বাংলার অপরূপ রূপ মাধুরী আমাদের নদীমাতৃক বাংলায় ¯্রষ্টার অকৃত্রিম দান। অকৃপণ হাতে ¯্রষ্টা আমাদের দিয়েছেন সে গর্বের ধন। ছোট্ট বাংলাদেশের বুক চিরে শহর, বন্দর, গ্রাম, পাহাড় কিংবা সমতল ভূমি পেরিয়ে অগণিত নদ-নদীর ধারা গিয়ে মিশেছে সাগরে। এসব নদ-নদী আমাদের বড় সম্পদ। কিন্তু সরকারের উদাসীনতা, গণমানুষের দখলবাজি, অব্যবস্থাপনা ও মানবসৃষ্ট অত্যাচারের ফলে অনেক নদীই আজ বিলীন হয়ে গেছে এবং অনেক নদীর অস্তিত্বই এখন বিলুপ্তির পথে। আমাদের সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ এবং জীবন-যাপনের জন্য এটা হুমকিস্বরূপ।
এক সময় বাংলাদেশের প্রায় ১,৩০০ নদী ছিল। এখন যাদের বেশিরভাগেরই অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে গেছে। এসব নদীর ছিল শাখা-প্রশাখা বা উপনদী। “মাছে-ভাতে” বাঙালি-এ প্রবাদের সত্যতা এসব নদ-নদীর অস্তিত্বের সাথে ঔতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। নানা প্রজাতির অসংখ্যা মাছে পরিপূর্ণ ছিল এদেশের নদ-নদী। আর নদীর অবাধ প্রবাহ ও পলিমাটি শস্য ফলাতে সাহায্য করতো বিশেষ করে ধান। এগুলো এখন অনেকটাই রূপকথার গল্পের মতো শোনায়। কিন্তু এগুলো গল্প নয় মোটেই, চরম সত্যি ও বাস্তবতা। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, শীতলক্ষ্যা কর্ণফুলী, আড়িয়াল খাঁ, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, ব্রহ্মপুত্র নদ, করতোয়া, তিস্তা, মহানন্দা, বুড়িগঙ্গা, সন্ধ্যা, কালীগঙ্গা, ধরলা, চিত্রা, সুরমা, কুশিয়ারা ইত্যাদি প্রায় সবগুলোই তাদের প্রকৃতরূপ হারিয়ে ফেলেছে নানা কারণে।
এবারের বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- “সুস্থ নদী, সুস্থ নগর” সুস্থ নদী অর্থাৎ নদীর সুস্থতা নির্ভর করে নদীর প্রবাহ, জলের গুণগত মান এবং জলজ জীববৈচিত্রের অস্তিত্বের উপর। নদীবাহিত পলিমাটি, মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ায়। নদীর জল প্রবাহ সমুদ্রের লবণাক্ততা রোধ করে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে এবং নানাভাবে বৈরী পরিবেশ থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করে।
বাস্তবে নানা কারণে নদ-নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে, ভরাট হয়ে যাচ্ছে, জল দূষিত হচ্ছে, মাছ শূন্য হয়ে যাচ্ছে নদী-নালা। এ বিরূপ পরিবেশের জন্য দায়ী মানুষ। নানাভাবে তারা নদ-নদীগুলোকে হুমকির মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
প্রথমতঃ নদী দখল করে নানা স্থাপনা তৈরি করার ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং নদী ভরাট হয়ে যায়।
দ্বিতীয়তঃ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অসচেতনতাও নদী ভরাটের কারণ। কলকারখানা বা গৃহস্থালির বর্জ্য নদীতে ফেলে একদিকে নদী ভরাট হয় এবং অন্যদিকে এসব বর্জ্য পচে জল ব্যবহার অনুপযোগী হয়।
তৃতীয়তঃ অনেকক্ষেত্রেই শিল্প কারখানার তরল বর্জ্য নদী-নালায় ফেলে জল নষ্ট করে। ফলে জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যায় এবং জলজ প্রাণী বাসের অযোগ্য পরিবেশে তৈরি হয়।
চতুর্থতঃ অনেক ক্ষেত্রে বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের লাইন নদ-নদীর সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়। ফলে জল ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
পঞ্চমতঃ শীত মৌসুমে চরাঞ্চলে চাষাবাদ করেও নদী ভরাটের কারণ তৈরি করা হয়।
ষষ্ঠতঃ নদীগুলো দীর্ঘদিন খনন না করায় ধীরে ধীরে ভরাট হতে থাকে।
সপ্তমতঃ শীতকালে যখন নদীতে জল কম থাকে তখন নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরা কিংবা চাষাবাদ করার ফলেও নদী ভরাট হয় এবং দুষণের কারণ হয়।
অষ্টমতঃ নদী ভাঙ্গনেও দায়ী নদীর নাব্যতা নষ্টের জন্য। নবমতঃ অপরিকল্পিত নগরায়নও দায়ী।
যে কারণেই নদীর নাব্যতা নষ্ট হোক না কেন তা প্রতিরোধ করা যায় অনেক ক্ষেত্রেই যদি মানুষ সচেতন হয়। বাংলাদেশে নদী রক্ষা কমিশন আছে। তাদের কাছে সঠিক পরিসংখ্যান নেই প্রতিবছর ঠিক কত নদ-নদী ভরাট হচ্ছে। প্রধান নদীগুলোর বিষয় আলোচনায় এলেও অসংখ্য ছোট নদীর কথা কেউ বিবেচনা আনে না। তাদের মূল কাজ হলো জল সচেতনতা তৈরি করা। একইসাথে সরকারি-বেসরকারি ও সাধারণ জনগণের ভেতরে সমস্যা সাধন করা। সকলের ও সমন্বিত প্রচেষ্টায় যে কোন জটিল সমস্যা সমাধান করা যায়। এ সমস্যা সমাধানের প্রথমতঃ প্রয়োজন জনসচেতনতা তৈরি এবং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। জলের স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। নদীর ভাঙ্গন রোধে নদীর তীর বাধাই করতে হবে। নদীর তীরে গাছ লাগতে হবে। বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত পদক্ষেপগুলো যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় সেজন্য মনিটরিঙের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের সচেতনতাই পারে এদেশের নদী-সম্পদকে রক্ষা করতে। সুতরাং, আর দেরি নয় এখন থেকেই আমরা শুরু করি নদীর অস্তিত্ব রক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ। নদী বাঁচলে বাঁচবে মানুষ সুস্থভাবে।