মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৭ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
নাটোর প্রতিনিধি:
নাটোর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত চামড়া শিল্পের কাঁচামালের অন্যতম যোগানদার নাটোরের চকবৈদ্যনাথের দ্বিতীয় বৃহত্তম কাঁচা চামড়ার আড়ত। দেশের ৩৬ জেলা থেকে ইদ-উল্-আজহায় কোরবানি করা পশুর কাঁচা চামড়া আসে এসব আড়তে ।
এ চামড়ার আড়ত থেকে ট্যানারি মালিকদের মোট চাহিদার ৫০ ভাগ চামড়া ঢাকায় যায় আর দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ জেলার লাখ লাখ পিস চামড়া আসে এই আড়তে। চামড়া শিল্পের অন্যতম বৃহত্তম কাঁচামালের যোগানদাতা হিসেবে নাটোর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অবদান রেখে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে।
গত বছরের চেয়ে চলতি বছর লবণযুক্ত গরুর চামড়ায় প্রতি ফিটে ৫ টাকা বৃদ্ধিতে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম চামড়ার বাজার নাটোরের ব্যবসায়ীরা খুশি। তবে চায়না নির্ভরতা কমিয়ে অনান্য দেশে চামড়ার বাজার তৈরি করতে পারলে চামড়ার দাম আরো বেড়ে যাবে বলে দাবি ব্যাবসায়ীদের।
এসব আড়তে লবণ দ্বারা প্রক্রিয়াজাতের পর অন্যুন ৪ মাস এই মোকামেই সংরক্ষিত থাকে কাঁচা চামড়া। দীর্ঘ এই সময় চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ লবণের। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই সংরক্ষণ উপাদানটি ঘিরে সক্রিয় হয়ে ওঠে লবন সিন্ডিকেট। এই লবণ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি চামড়ার আড়তদার,মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ইদের দিন কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারিরা।
আসন্ন কোরবানি ইদে লবণের এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। তবে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ নেই প্রশাসনের। চাহিদার তুলনায় লবণের সরবরাহ বেশি থাকার তথ্য জানিয়ে দাম না বাড়ার আশ্বাস দিয়েছে নাটোর জেলা প্রশাসন। তবে চামড়া সংগ্রহে সক্ষম মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষকে বিনামূল্যে লবণ সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন ও বিসিক।
নাটোর বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক দিলরুবা দিপ্তি জানায়, বর্তমানে নাটোরে লবণের চাহিদা ৭৫ মেট্রিক টনের বিপরীতে মজুদ রয়েছে ১০০ মেট্রিক টন। ৭ দিন আগে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) লবণের দাম ছিল ৮৮০ থেকে ৯০০ টাকা। বর্তমানে প্রতিমণ লবণ ৮৩০ থেকে ৮৪০ টাকা।
ব্যবসায়ীদের জানান, ইদের দুই সপ্তাহ আগে লবণের দাম কমাটা একদিক দিয়ে যেমন স্বস্তিদায়ক আরেকদিক থেকে উদ্বেগেরও। কেননা ইদের দু-একদিন আগেও হঠাৎ করে লবণের দাম বৃদ্ধির রেকর্ড রয়েছে।কি পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংক্ষণ করা হবে তা ব্যবসায়ীরা নির্ধারণ করেন শিল্প মন্ত্রণালয় চামড়ার দাম বেঁধে দেয়ার পর।ফলে লবণ ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মূলত ইদের দু-একদিন আগেই। ফলে ইদের দুই সপ্তাহ আগে লবণের দামের হ্রাস-বৃদ্ধি প্রভাব ফেলে না।
চামড়ার আড়ৎদার হাজী লুৎফর রহমান বলেন, যেহেতু এখন কোরবানি মৌসুম তীব্র গরমের মধ্যে শুরু হয়, সেহেতু চামড়া সংরক্ষণে প্রচুর লবণের প্রয়োজন হয়। বলা হচ্ছে এবার লবণের সরবরাহ বেশি। কিন্ত লবণের দাম কাক্সিক্ষত হারে কমছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা শুরুতেই বড় ধাক্কা খাচ্ছে। লবণের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিলে ব্যবসায়ীরা কিছুটা উপকৃত হবে।
চামড়া ব্যবসায়ী হালিম সিদ্দিকী বলেন, সরকার নির্ধারিত চামড়া ও লবণের দামে সামঞ্জস্য থাকা দরকার। সেই সাথে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। সিন্ডিকেট মূলত টার্গেট করে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। তারা না বুঝে, কী পরিমাণ চামড়া তারা সংগ্রহ করবে তার হিসেব না করে বিপুল পরিমাণে লবণ মজুদ করে। তখন লবণের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়।মৌসুমি ব্যবসায়ী না, আড়তদার ও অনান্য ব্যবসায়ীরা চামড়া সংরক্ষণ করে। তাই সরকারের উচিত ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া।
চামড়া ব্যবসায়ী মুঞ্জুরুল ইসলাম হিরু বলেন, গত ইদুল আজহায় লবণযুক্ত গরুর চামড়া ৪৫ থেকে ৫০ টাকা ফুট বেঁধে দেয় ট্যানারি মালিকরা। ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেয়া দামে নাটোর শহরের চকবৈদ্যনাথ এলাকায় দেড় শতাধিক আড়তে দুই বছর ধরে নাটোরের চামড়া বাজারে নগদ টাকায় চামড়া বিক্রি হওয়ায় গত বছর ইদুল আজহায় এই বাজারে প্রায় ৪ লাখ পিস গরুর চামড়া বিক্রি হয়। তবে এবার ৫ টাকা দাম বৃদ্ধি করে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় চামড়া কেনার ঘোষণায় চামড়ার সরবরাহ আরও বাড়বে।
জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি এসএম মকছেদ আলী বলেন, বর্তমান বাজারমূল্যে একটি খাসির চামড়া প্রক্রিয়াজাতের জন্য অন্তত ১ কেজি লবণ ব্যবহার করতে হবে। এতে অনান্য প্রক্রিয়া খরচ শেষে একটি চামড়ার দাম হওয়া উচিত ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। অথচ খাসির চামড়ার দাম ২০ থেকে ২৫ টাকার বেশি নয়। চামড়া শিল্পের গুরুত্ব আলাদাভাবে বিবেচনা করে শুধু চামড়ার জন্য ভর্তুকিমূল্যে লবণ সরবরাহ করা উচিত।
জেলায় লবণের সরবরাহকারি একতা ট্রেডার্সের সত্বাধিকারি দীলিপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, বর্তমানে জেলায় চাহিদার তুলনায় কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতের লবণের সরবরাহ বেশি আছে। ফলে কোনো রকম ঘাটতি হবে না, দামও বাড়বে না। এছাড়া বর্তমানে লবণের দাম নিম্নমূখী ।
নাটোরের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম জানান, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও ঐতিহ্যবাহী চামড়ার আড়তে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত ফড়িয়া ব্যবসায়ীসহ ট্যানারি মালিকরা যাতে নিরাপদে এবং নির্বিঘ্নে কেনা-বেচা করতে পারে, সেজন্য পুলিশ তৎপর থাকবে। কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সকল প্রকার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভুঁইঞা জানান, লবণ ব্যবসায়ী ও চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাথে মতবিনিময় করা হয়েছে। চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত লবণ থাকায় আমরা আশা করছি দাম বৃদ্ধিজনিত কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না। এছাড়া এবারই প্রথম চামড়া সংগ্রহে সক্ষম মাদ্রাসা ও এতিমখানায় জেলা প্রশাসন ও বিসিকের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করা হবে।
ব্যবসায়ীদের দাবী, সারা বছর নাটোরের এ চামড়ার বাজার থেকে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ পিস গরু ও ৭ লাখ পিস খাসির চামড়া বিক্রি হয়। রফতানি আয় বৃদ্ধি করাসহ সাভারের ট্যানারিগুলো সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করতে হবে। এরজন্য সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। আর সরকার’র সহায়তা পেলে চামড়ার বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।