বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
সুফি সান্টু, নাটোর
আধুনিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পপণ্য। এক সময় মাটির তৈরি তৈজসপত্রের প্রচুর ব্যবহার ছিল। সেই তৈজসত্রের স্থান দখল করে নিয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও পাস্টিকের তৈরি তৈজসপত্র। এসবের দাম বেশি হলেও অধিক টেকসই হওয়ার কারণে এসব পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন সাধারণ মানুষ।
বর্তমানে গ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন উৎসব, মেলায় তৈরি খেলনা পুতুল ছাড়া অন্য কোন মৃৎ শিল্পের গ্রাহক নেই বললেই চলে। শীত মৌসম এলে মাটির তৈরী কোর, (খেজুর গাছে রস সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হয়) এবং ফুলের টবের ব্যাপক হারে চাহিদা বেরে যায়। বর্তমানে অ্যালুমিনিয়াম, পাস্টিক ও স্টিলের জিনিসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে এ পেশার সাথে জড়িত নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপর, বড়াইগ্রাম, লালপুর, বাগাতিপাড়া, নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা এ সাতটি উপজেলার শত শত মৃৎশিল্প ব্যবসায়ীরা এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এরপরেও কিছু কিছু এলাকা সিংড়ার কলম পালপাড়া, পারসাঐল, সেরকোল, ধুলাউরি পালপাড়া, বাগাতিপাড়ার জামনগর, পাকা, প্যাড়াবাড়িয়া, লালপুরের ওলিয়া, বিলমাড়িয়া, লালপুরের পালপাড়া, বড়াইগ্রামের জোনাইল, জুয়ারী, লক্ষীকোল পালপাড়া, নাটোর সদরের তেবারিয়া, উত্তর বড়গাছা দিঘাপতিয়া পালপাড়া, চানপুর, করের গ্রাম, বাঙ্গালখলসী, গুরুদাসপুরের নাজিরপুর, নাড়ীবাড়ী এসব এলাকার সহ¯্রাধিক পরিবার তাদের পূর্ব পুরুষের আদি পেশাকে ধরে রেকেছেন। বিশেষ করে এটাই যাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। তাদের জীবনযাপন একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে নাটোর তেবাড়িয়ার পালপাড়ার মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী হীরেন্দ্র নাথ পাল বলেন, আগে আমাদের ব্যবসা ভালো চলত। তখন এত শিসা, পাস্টিক, সিলভারের মাল ছিল না। আর এখন মাটির তৈরি জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ নেই। এখন মাটির জিনিস চলে কম। তাছাড়া জ্বলানি, রং, মাটির দাম দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। এক ট্রলি মাটি কিনতে হয় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকায়। মাটির কাজ করে এখন আর এ পোশায় থাকতেও পারি না আবার পূর্ব পুরুষের পেশা ছাড়তেও পারছি না। কোনো মতে টিকে আছি। যা ইনকাম করি তাই দিয়ে সংসার চলে।
সিংড়ার ধুলাউরি পালপাড়ার নিতাই কুমার পাল জানান, আমার বয়স যখন ৮ বা ১০ বছর তখন আমি ১ টাকা থেকে ৪ টাকা করে পাতিল বিক্রি করতাম। আগে অনেক লোকজনই এই ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমানে অনেকেই এই ব্যবসায় ছেড়ে দিচ্ছে। আগে যে পরিমাণে বিক্রি হতো, তার থেকে এখন ৪ ভাগের ১ ভাগ বিক্রি হয়। আবার অনেক সময় চলেই না। শীত মৌসম এলে রসের কোর (হাড়ী) এবং কোলা কদর বেড়ে যায়। বেচা বিক্রি ভালো হয়। অন্য সময় এ ব্যবসা চলে না, শুধু স্মৃতি হিসেবে এ ব্যবসাকে ধরে রেখেছে। মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী অমূল্য পাল বলেন, আমাদের এই ব্যবসায় এখন ১৬ আনার মধ্য ৬ আনা চলে, ১০ আনাই চলে না। আমাদের ছেলে-মেয়ে আছে, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে গেলে যে অর্থের দরকার, এই ব্যবসায় থেকে তা উঠানো যায় না। চাকরির ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগতেছে, এই টাকা দিবে কে? আর এই জন্যই আমরা ভাত পাই বা না পাই, বাধ্য হয়েই এই কাজ করছি।
নাটোর সদরের হাট তেবাড়য়িার মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী রাধা রমন পাল বলেন, বৃদ্ধ বয়সে এখন কি করব, তাই জোর করেই এই ব্যবসা করি। সিলভার, পাস্টিক, স্টিলের পণ্য নামার কারণে এই ব্যবসায় অচল হয়ে যাচ্ছে। কসলি, হাড়ি পাতিল এগুলো এখন একদমই চলে না। একই এলাকার মৃৎশিল্পী কার্তিক পাল বলেন, এই কাজ করে আমাদের সংসার খরচও উঠতে চায় না। আমাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করানো খুব কষ্ট হয়ে পড়ে। এটা আমাদের পেশা, ক্ষতি হলেও আমাদের এই ব্যবসা চালিয়ে যেতে হবে। এ কাজ করে জায়গা-জমি, গাড়ি-বাড়ি কিছুই করতে পারি নাই। ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্পকে বাঁচাতে কারিগরদের আধুনিক মেশিন ও ব্যাংকলোন দেয়ার আহবান জানিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাজী আতিউর রহমান বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে টিকে রাখা প্রয়োজন আছে। সরকারিভাবে এর ওপর কোন প্রকল্প নেই, তবে স্থানীয়ভাবে যারা মৃৎশিল্প ও কারিগর রয়েছেন তারা যদি কোনো স্বারকলিপি দেয়, তাহলে আমরা এ বিষয়ে প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি।