রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১২ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বাঙালি জাতির ইতিহাসের ধারায় সংগ্রাম শব্দটি ওৎপ্রোতভাবে মিশে আছে। যুগে যুগে বাঙালিরা অধিকার ও ন্যায়ের পক্ষে লড়েছে। বিশ্ব দরবারে বাঙালিরা আজ বীরের জাতি হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে তাদের লড়াই সংগ্রাম আন্দোলনের কারণে। বাঙালি জাতি অনিয়ম, শোষণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা প্রাপ্তির বহুকাল আগ থেকে বাঙালিদের রয়েছে নানা ধরনের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। অধিকার আদায় ও ন্যায় সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে বাঙালিরা বরাবরই ছিল সচেতন। উপমহাদেশ থেকে বৃটিশ বিতাড়িত করার আন্দোলনে বাঙালি জাতির অবদান সবচেয়ে বেশি। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাঙালি বীরদের সংগ্রামের কথা অমর হয়ে আছে ইতিহাসে। জমিদারি প্রথা বিলোপ করার আন্দোলনে বাঙালিরাই উপমহাদেশে সোচ্চার হয়ে উঠে। বাঙালির নানা আন্দোলনের ফল স্বরূপ প্রজাস্বত্ব আইনসহ নানা আইন তৈরি হয় আর সবশ্রেণির মানুষের ভূমি অধিকার নিশ্চত হয়। বৃটিশ শাসনাধীন উপমহাদেশে তেভাগাসহ সকল ধরনের কৃষকের অধিকারের আন্দোলনে অগ্রণী ভুমিকায় ছিল বাঙালির নেতৃত্ব। তৃণমূল স্তরে এ সকল আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত করা অনেক সংগ্রামী বাঙালির কথা ইতিহাসে বা পুস্তকে গ্রন্থিত হয়নি। এ দেশে অধিকার আদায়ের এমন কিছু সংগ্রামী রয়েছেন, যারা বৈচিত্রতায় পরিপূর্ণ বাংলা সংস্কৃতির ধারায় বাঙালি সমাজের নানা সম্প্রদায়ের সমঅধিকারের প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছেন। তাদের মধ্যে এমন একজন বাঙালি ছিলেন ডা. কলিম উদ্দিন আহামেদ। এই নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ সংগ্রামী মানুষটি বৃটিশ শাসনামলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ এলাকায় জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। সেই সময়ে জমিদারের হাতে প্রতিনিয়ত নিগৃহিত হতো নি¤œবর্ণের মানুষ। জমিদার ও শাসক গোষ্ঠি মিলে নি¤œবর্ণের ও জাতের মানুষকে অত্যাচার করতো। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। কারণ নি¤œবর্ণের ও জাতের মানুষেরা ছিল নিরক্ষর। অফিস আদালত কোর্ট-কাচারি তারা চিনতো না। শিবগঞ্জ এলাকায় মনকষার জমিদার ঈসমাইল রেজা চৌধুরী নি¤œবর্ণের বাঙালিদের নির্দয়ভাবে নির্যাতন করতেন। নির্যাতনে এলাকায় বাস করা দুরহ হয়ে পড়েছিল পালকি বাহক বেহারাদের, রাজবংশী, কাহার, শীল, কুলু ও আদিবাসী সাওতাল সম্প্রদায়ভুক্ত রোকদের। পালকি বাহকরা ইচ্ছা করলেও এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় যেতে পারতো না। জমিদার এমন নিয়ম করেছিল যে, শত অত্যাচার সহ্য করে মুখ বুঁজে পালকি বাহকদের এবং রাজবংশীসহ নি¤œবর্ণের মানুষদের এলাকায় বাস করতে হতো। ছেড়ে যে জমিদারিতে এরা যাবে সেই জমিদারের সাথে ছিল এই জমিদারের সখ্যতা- তাই কেউ চলে গেলেও ফিরে আসতে হতো। আর এ রকমভাবে ফিরেআসাদের উপর চলতো স্ট্রিম রোলার। ডা. কলিম উদ্দিন এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন। তার নেতৃত্বে নি¤œবর্ণের অচ্ছুত হিসাবে আখ্যা দেয়া মানুষগুলি সংগঠিত হয়। নির্যাতনের প্রতিকারের জন্য ডা. কলিম উদ্দিন আন্দোলন কর্মসূচি নিয়েছিলেন। আর এই আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি জমিদার সেলিম রেজা চৌধুরীর রোষানলে পড়েন।
ডা. কলিম উদ্দিন আহামেদের জন্ম তৎকালীন মালদহ জেলার অর্ন্তগত শিবগঞ্জ থানার ( শিবগঞ্জ বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার উপজেলা) প্রত্যন্ত গ্রাম পিয়ালমারীতে ১৮৯২ সালের ২৫ জানুয়ারি। শিবগঞ্জের এম আই স্কুলে প্রথামিক শিক্ষা শেষ করে মুর্শিদাবাদের কাঞ্চনতলা হাই স্কুলে ভর্তি হন। কাঞ্চনতলা হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করে রাজশাহী কলেজে আইএ ভর্তি হন। কিন্তু গ্রামের মানুষের নিরক্ষরতা দূর করার মানসে তিনি আবার গ্রামে ফিরে আসেন। শিবগঞ্জের মনকষা ও দুর্লভপুর এমই স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। সেই সময়ে এলোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ওই অঞ্চলে পৌছায়নি। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ অকালে মারা যেতো। শিবগঞ্জ অঞ্চলের রোগক্লিষ্ট মানুষের মুখ তাকে পীড়া দিতো। এ জন্য সেই সময় তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি চিকিৎসক হবেন। চিকিৎসক হওয়ার উদ্যেশে ডা. কলিম উদ্দিন ১৯১৬ সালে কলকাতা ক্যাম্বেল স্কুলে ভর্তি হন। ক্যাম্বেল স্কুলে তার শিক্ষক ছিলেন ডা. বিধান চন্দ্র রায় ( ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ,কংগ্রেস নেতা ও তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন)। ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের সংস্পর্শে এসে তিনি সমাজসেবা এবং মানুষের অধিকার বিষয়ের রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত হন। ওই সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে কালাজ্বরের প্রার্দুভাব ছিল ব্যাপক। কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছরেরই মানুষ মারা যেতো। ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে পড়ার সময় তিনি কালাজ্বরের ইনজেকশান ইউরিয়া স্টিবামাইন এর আবিস্কারক ডা. উপেন্দ্রনাথ বম্মচারীর কাছ থেকে তদীয় সংক্রান্ত বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। তিনি প্রতিযশা চিকিৎসক ডা. নীল রতন সরকারের ¯েœহভাজন ছিলেন। ( বর্তমানে নীল রতন সরকারের নামে একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে)। ডা. কলিম উদ্দিন ১৯১৯ সালে ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল থেকে এলএমএফ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তিনি কোন সরকারি চাকরিতে যোগ দেন নাই। তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। তখনকার শিবগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য কোন ডাক্তার ছিল না। এসব মানুষের চিকিৎসা সেবায় তিনি মনোনিবেশ করেন। তার চিকিৎসা ব্যবস্থার খ্যাতি সমগ্র চাঁপাই নবাবগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রামের দরিদ্র মানুষকে তিনি বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। গ্রামে গ্রামে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য তিনি একটি বাইসাইকেল কিনেন। সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে করতেন অসুস্থদের চিকিৎসা। চিকিৎসা নিতে আসা সকলের প্রতি তার ছিল সমআচরণ। তৎকালীন সময়ে জাতপাত, ধর্ম বর্ণ বিচারে সমাজে মানুষকে মূল্যায়ন করা হতো। এই কারণে দেখা যেতো নি¤œবর্ণের বা পেশার মানুষ হতো নানা ধরনের নিগ্রহের শিকার। সামাজিক এই বৈষম্যমূলক প্রথাটি স্বয়ং মনকষার জমিদার কর্তৃক সৃষ্ট- তাই প্রচলিত প্রথাটির বাইরে কেউ কথা বলতে সাহস করতো না। কলিমউদ্দিন ডাক্তার অত্যন্ত সাহসিকতা নিয়ে এই প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তৎকালীন প্রচলিত বৈষম্যমূলক প্রথাগুলির বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেন। নি¤œবর্ণের হিসাবে চিহ্নিত পালকি বাহক, রাজবংশী, নাপিত, কুলু ( যারা ঘানিতে সরিষার তেল তৈরি করে) এই সম্প্রদায়ের মানুষকে সমাধিকারের দাবিতে তিনি সংগঠিত করেন। আর এই সকল কারণে তিনি পরিণত হন জমিদারের চক্ষুশুল হিসাবে। জমিদার কলিম উদ্দিন ডাক্তারকে তার প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে। কফিল উদ্দিন ডাক্তারের সমাধিকারের এই আন্দোলন দমন করতে মনকষার জমিদার নানা ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। রাতের অন্ধকারে দুবার জমিদারের পাইক পেয়াদারা তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। জমিদার নিরীহ প্রান্তিক চাষিদের জমি দখল করতো, কলিম উদ্দিন ডাক্তার তার প্রতিবাদ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশ করতেন। ফসলের নায্য হিস্যা পাওয়ার দাবিতে কৃষক সমাজকে তিনি সংগঠিত করেছিলেন। বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে এবং নানা কৌশল করেও জমিদার যখন কলিম উদ্দিন ডাক্তারকে দাবিয়ে রাখতে পারেনিÑ তখন কলিমউদ্দিন ডাক্তারকে দমন করতে তার নামে জমিদার অসংখ্য মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। প্রতিটি মামলায় তিনি জমিদারের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে লড়াই করেন। দীর্ঘ এক যুগ জমিদারের সাথে কলিম উদ্দিন ডাক্তারের মামলা চলে। ন্যায় ও সততার কারণে প্রত্যেকটি মামলায় কলিম উদ্দিন ডাক্তার জয়ী হন। কলিম উদ্দিন ডাক্তার এলাকার মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য পদক্ষেপ নেন। তৎকালীন রাতে তার বাড়িতে বয়স্কদের শিক্ষার জন্য তিনি একটি শিক্ষা কেন্দ্র চালু করেছিলেন। কলিমউদ্দিন ডাক্তারের সকল কর্মকা-ের প্রতি সমাজের সাধারণ মানুষের ছিল আকুণ্ঠ সমর্থন। শিবগঞ্জ অঞ্চলের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের কথা মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। আদিনা ফজলুল হক কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান রয়েছে। এই মহান সমাজ সংস্কারক মানবাধিকার কর্মী ডা. কলিম উদ্দিন ১৯৫৫ সালের ৫ এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন। তার ছেলে ডাক্তার মঈনুদ্দিন আহাম্মেদ মন্টু শিবগঞ্জ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ৭১ এর একজন বীর সেনানী।
লেখক:- কলামিস্ট