নিজের বসতভিটায় পশুপাখির সাথে আকাশ কলি দাশের মিতালী

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৪, ১:৪০ অপরাহ্ণ


শাহীন রহমান, পাবনা :চারদিকে গাছগাছালি আর সবুজের হাতছানি। ঘন জঙ্গলের মতো পরিবেশের মাঝে দীর্ঘ বছরের পুরোনো টিনের ঘর। সইে ঘরকে ঘিরে চারিদিকে প্রকৃতির সমারোহ। জমজমাট আসর বসিয়েছে অতিথি পাখিরা। পাখিদের কিচির মিচির কোলাহলে সৃষ্টি হয়েছে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
পাবনার বেড়া উপজেলার কৈটোলা গ্রামে এমনই এক প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলেছেন আকাশ কলি দাশ। তার সাড়ে ৬ বিঘা জায়গার ভিটেমাটি উন্মুক্ত করেছেন পশুপাখিদের জন্য। গড়ে তুলেছেন পশুপাখির অভয়াশ্রম। আকাশ কলি দাশের সাথে থাকেন তার বোন ঝর্না দাশ। প্রকৃতির প্রেমে পড়ে চির কুমার-চিরকুমারী থেকে গেছেন ভাই-বোন।

অর্ধশত বিঘার জমির মালিক হয়েও অত্যন্ত সাদা-মাটা জীবনযাপন করেন আকাশ কলি দাশ। পশুপাখি ও প্রকৃতির প্রতি তার অগাধ মমতা। বন্যপ্রাণী আর প্রকৃতির ভালোবাসায় নিজের ভিটেমাটিকে করেছেন উন্মুক্ত। তাদের মায়ায় পড়ে এখনও চিরকুমারই রয়ে গেছেন তিনি। পশু পাখি শিকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার আকাশ কলি দাশের পাশে রয়েছে বন বিভাগ। এলাকাবাসীর কাছেও শ্রদ্ধা আর ভালবাসার মানুষ তিনি।

আলাপকালে আকাশ কলি দাশ জানান, তার বাবা চন্দ্র কুমার দাশ পাবনার নগরবাড়ি এলাকার শ্রী নিবাস দিয়ার জমিদার বাড়ির নায়েব ছিলেন। ১৬-১৭ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হলে সংসারের হাল ধরেন আকাশ কলি দাশ। তিন ভাই-তিন বোনের সংসারে তিনিই অভিভাবক ছিলেন। ছোট বেলাতেই এক ভাইয়ের মৃত্যু হয়। বাকি এক ভাই ও দুই বোনকে স্বাধীনতার আগেই ভারতে বিয়ে দেন। তারপর থেকে তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই আকাশ কলি দাশের।

এক সময় একই উপজেলার মাছখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ছিলেন আকাশ কলি দাশ। তখন থেকেই পশুপাখি আর প্রকৃতিকে ভালবাসতেন। ২৫ থেকে ২৭ বছর আগে অবসর নেবার পর এই ভিটেমাটি আর প্রকৃতির সাথে মিশে আছেন তিনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে তার সহযোগিতা রয়েছে। সাড়ে ৬ বিঘা বসতভিটার পাশাপাশি মাঠেও রয়েছে অর্ধ শতাধিক বিঘা জমি। বাড়িতে রয়েছে গরুর খামার।

শিক্ষকতা থেকে অবসর নেবার থেকেই পশু-পাখিগুলোই তাদের একমাত্র সঙ্গী। ইট-পাথরের নগরায়ণের ফলে পাখিরা যখন আপন নিবাস হারাচ্ছেন, ঠিক তখন আশ্রয় নেয়া পাখিদের নিরাপদে থাকার জন্য নিজের বসতভিটাই উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তিনি। কেউ সেখানে পাখি শিকারের চেষ্টা করলেও শক্তভাবে প্রতিরোধ করেন তিনি। চার যুগের বেশি সময় ধরে প্রকৃতি আর বন্যপ্রানীদের সংরক্ষণ করে আসছেন আকাশ কলি দাশ।

স্বাধীনতার আগে ও পরে আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে রাজনীতি করলেও সেখানেও রয়েছে তার একগুচ্ছ অভিমান। ১৯৭৪ সালে গ্রেফতার হয়ে জেলও খেটেছেন। পাবনা ও দেশের রাজনীতির অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের সাক্ষীও তিনি। কিন্তু সেসব বিষয়ে তিনি কাউকে কিছু বলতে চান না।

আকাশ কলি দাশের বয়স ৮৭ বছর, আর তার বোন ঝর্না দাশের বয়স ৭৩ বছর। এখনো তারা চিরকুমার-কুমারি। বৃদ্ধ ভাই বাড়ির আঙিনার বাহিরে হলেও, বোন থাকেন লোকচক্ষুর আড়ালে। প্রতিবেশীদের অনেকেই তাকে এখনো দেখেননি। আকাশ কলি দাসের দাবি, ঠিক কি কারণে তিনি বিয়ে করেননি আর বোন কি কারণে বিয়ে করেননি সেটি জানেন না তারা। পশু-পাখিগুলোই তাদের একমাত্র সঙ্গী।

আকাশ কলি দাশ মনে করেন, এই পৃথিবীতে এসেছেন একা, যেতেও হবে একা। জমি, সম্পদ কিছুই সাথে যাবে না। তাই মানুষকে প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা বাড়াতে হবে, সচেতন হতে হবে। নতুবা জেল জরিমানা করে সমাধান সম্ভব নয়। সরকার চাইলে তার অভয়াশ্রম ঘিরে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। যাতে কোনো পশুপাখি শিকার করা না হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রতিবেশী আরিফুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন সহ অনেকেই জানান, আকাশ কলি দাশ শিক্ষক হিসেবে যেমন ভাল মানুষ ছিলেন তেমনি প্রকৃতি পশুপাখিকে ভালবেসে নিজের সব উজার করে দিয়েছেন তিনি। এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তার উদ্যোগের সাথে রয়েছে গ্রামের মানুষ।

পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের চারপাশে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু বন্যপ্রাণী বা পশুপাখিদের যে আশ্রয়টুকু থাকা দরকার তা যেন দিনে দিনে কমে আসছে। এমন বাস্তবতায় আকাশ কলি দাশ পরিবেশ সংরক্ষণ ও পশুপাখিদের আবাসস্থল গড়ে তুলেছেন তা সত্যি প্রশংসনীয় ও অনন্য উদ্যোগ।

পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য নতুন প্রজন্মের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবেন হওয়ার আকাশ কলি দাশ।’
বেড়া উপজেলা বন কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, ‘কলি দাশ একজন বন্যপ্রাণী প্রেমিক ও সংরক্ষক। তিনি তার জমি থেকে কোনো গাছপালা কাটেননি। সেখানে শীত মৌসুমে অনেক পরিযায়ী পাখি আসে। বন্যপ্রাণীর প্রতি আকাশ কলি দাশের এমন নির্মোহ ভালবাসার বিষয়টি নজরে এসেছে।

এলাকাবাসীকে গাছ কাটা বা বন্যপ্রাণী শিকার না করার বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে। তার যেকোনো সহযোগিতায় পাশে রয়েছে বন বিভাগ।’
এ বিষয়ে বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোরশদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বিষয়টি শুনেছি। তবে এখনও সেখানে যেতে পারিনি। তার উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তার পাশে থাকবে উপজেলা প্রশাসন।’