মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৭ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
রেজওয়ানা পারভিন বন্যা:
নিপা ভাইরাস (বৈজ্ঞানিক নাম Nipa henipavirus) হল একটি বাদুড়বাহিত ভাইরাস যা নিপা ভাইরাস সংক্রমণ ঘটায় এবং এটি উচ্চ মৃত্যুহার সম্পন্ন। নিপা ভাইরাসের অপর নাম জুনটিক ভাইরাস। সাধারণত বাদুড় বা শূকরের মাধ্যমে এই ভাইরাস মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO এর মতে এদের লালারস, মূত্রের সংস্পর্শে আসা কোনো ফল যদি কেউ খায়, তখন নিপা ভাইরাস তার দেহে প্রবেশ করতে পারে। এ ছাড়া সংক্রমিত মানুষের সংস্পর্শে আসলে ও ছড়িয়ে পড়তে পারে নিপা ভাইরাস।
এ রোগটি ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রথম দেখা যায়। সুঙ্গাই নিপা নামক মালয়েশিয়ার একটি গ্রামের নামে এই ভাইরাসের নামকরণ করা হয়। ভাইরাসটি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শূকরের খামারে কাজ করা চাষীদের মাধ্যমে প্রথম ছড়িয়েছিল। আক্রান্ত শূকরের স্পর্শ, তাদের লালা ও সংক্রমিত মাংসের মাধ্যমে এর বিস্তার ঘটে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এর মতে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। দেশে গত ২০ বছরে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে ৩২২ জনের দেহে নিপা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২২৯ জন মারা গেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ৮ জন নিপা ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৫ জন মারা গেছেন।
চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশে আর কোনো সংক্রামক ব্যধিতে মৃত্যুর হার এত বেশি বলে জানা যায়নি। মৃত্যুর আশঙ্কা থাকার পরও এটি নিয়ে জনসচেতনতা প্রায় নেই বললেই চলে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওযার পর মৃত্যুর হাত থেকে যারা ফিরে আসেন, তারা বেঁচে থেকেও স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন চিরতরে। এই ভাইরাস করোনার থেকেও ভয়াবহ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ সায়েমুল হুদা।
রোগের সংক্রমণ: বাংলাদেশে এ ভাইরাসটি ছড়ায় মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওযার খবর পাওয়া যায়। এ সময়টাতে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে এবং রসের হাঁড়িতে প্রব করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা ও মূত্র মিশে যায়। সেই কাঁচা রস খেলে নিপা ভাইরাস মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। নিপা ভাইসার আক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে সরাসরি সুস্থ মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হওযার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভারতের শিলিগুড়িতে, ভাইরাসটির সংক্রমণ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায়। যেখানে আক্রান্ত মানুষের ৭৫ শতাংশ ছিল হাসপাতালের কর্মচারী বা হাসপাতালে আসা অন্য রুগী বা তাদের পরিজন।
২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেক সংক্রমণ রোগীদের সেবাযতœকারীদের মাধ্যমেই এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
রোগের রক্ষণ: নিপা ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পাঁচ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও ৪৫ দিন পর্যন্ত ভাইরাসটি সুপ্ত অবস্থায় শরীরের মধ্যে থাকতে পারে। শুরুতে প্রচন্ড জ¦র, মাথা ও পেশিতে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কাশি, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এ ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্ক আক্রান্ত করে এনসেফালাইটিস জাতীয় ভয়াবহ মস্তিষ্কের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। ফলে রোগী প্রলাপ বকতে শুরু করে, ঘুম ঘুম ভাব, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, খিঁচুনি এবং অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে রোগী মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়ে।
রোগ নির্ণয়: নিপা ভাইরাসের সংক্রমণের কোন নির্দিষ্ট প্রথমিক লক্ষণ এবং উপসর্গ নেই যা সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বাঁধা হতে পারে। উপরন্তু, ক্লিনিকাল নমুনার পরিমাণ, মান, টাইপ সংগ্রহের সময়জ্ঞান এবং পরীক্ষাগারে রোগীদের থেকে নমুনা স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ার ত্রুটি রোগনির্ণয়ের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রস্রাব, রক্ত, সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড ইত্যাদি শারীরিক তরল থেকে “প্রকৃত সময় পরিমারেজ চেইন প্রতিক্রিয়া (আর-টি-পিসিআর)(RT-PCR) ” সহ প্রধান পরীক্ষার পাশাপাশি এলাইসা, কোষ কালচার দ্বারা ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। রোগ থেকে মুক্তির পর ইমিউনো গ্লোবিউলিন জি এবং ইমিউনো গ্লোবিউলিন এম অ্যান্টিবডি শনাক্ত করে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত করা যায়।
প্রতিরোধ: নিপা ভাইরাস সংক্রমণের কোন কার্যকরী চিকিৎসা না থাকায় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বাদুড়ের প্রজননের সঙ্গে এই রোগের সম্পর্ক এখনো পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্ণীত হয়নি। হেন্ড্রা জি প্রোটিন নির্মিত একটি টিকা বানরদের হেন্ড্রা ভাইরাসের সংক্রমণে ব্যবহার করা হয়েছে, যা হেনিপাহ ভাইরাস ও নিপা ভাইরাসের বিরুদ্ধেও অ্যান্টিবডি তৈরি করে, কিন্তু মানুষের ওপর এই টিকার প্রভাব এখনও নির্ণীত নয়।
প্রতিরোধের উপায় হচ্ছে-
চিকিৎসা: বর্তমানে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের কোন কার্যকরী চিকিৎসা নেই। সাধারণত সহায়ক চিকিৎসা দ্বারা এই রোগ উপশমের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। নিপা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত এমন প্রত্যেক সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আলাদা রাখা প্রয়োজন এবং প্রগাঢ় সহায়ক চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। পরীক্ষাগারে রিবাভিরিনের কার্যকারিতা লক্ষ্য করা গেলেও মানব শরীরে এর প্রভাব এখনও প্রমাণিত নয়। নিপা জি গ্লাইকো প্রোটিনের বিরুদ্ধে উৎপাদিত একটি হিউম্যান মনোকেøানাল অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে টিকা তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। নিপা ভাইরাসের পূর্ণতা লাভের পক্ষে ক্লোরোকুইন অন্তরায় সৃষ্টি করলেও মানব শরীরে এর কার্যকারিতা এখনও পরীক্ষিত নয়।
নিপা ভাইরাসের হিউমোরাল অ্যান্টিবড়ি: ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে নিপা ভাইরাসে ফরিদপুর জেলায় ৫ বছরের কম বয়সী একটি মেয়ে ও তার মা সংক্রমিত হয়। তাদের উভয়েই খেজুরের কাঁচা রস পান করেন। এতে শিশুটি মারা যায়। তার মা গুরুতর স্নায়বিক জটিলতার শিকার হন। ২০২১ সালের নভেম্বরে ওই নারী আবার গর্ভধারণ করেন। এবার সন্তান প্রসবের আগে জাতীয় নিপা সার্ভেইল্যান্স কর্তৃপক্ষের নিবিড় তত্ত্বাবধানে সেবা পান ওই নারী। ২০২১ সালের আগস্টে সম্পূর্ণ সুস্থ শিশুর জন্ম দেন তিনি। রুটিন সারভাইভার ফলোআপের অংশ হিসেবে নবজাতকের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং ভার্টিকেল ট্রান্সমিশন বা মা থেকে শিশুতে সংক্রমণের সম্ভাবনা আছে কিনা দেখার জন্য লাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা করে নিপা সংক্রমণ পাওয়া যায়নি, কিন্তু অ্যান্টি-নিপা-আইজিজি- এর একটি উচ্চ টাইটার দেখতে পাওয়া যায়। এভাবেই প্রথমবারের মতো নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মা থেকে সন্তানের মধ্যে নিপা ভাইরাসের হিউমোরাল অ্যান্টিবডি পৌঁছায়।
লেখক : মাস্টার্স শিক্ষার্থী, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।