নিবন্ধ হাসান আজিজুল হক সাহিত্য উৎসব ২০২৪ অবলোকন-অনুভব

আপডেট: মে ১২, ২০২৪, ১১:৩১ অপরাহ্ণ

সামসুল ইসলাম টুকু:


রাজশাহী লেখক পরিষদ ও রাজশাহী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত দু’দিনব্যাপী কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক সাহিত্য উৎসব সম্প্রতি শেষ হয়েছে। ন’টি পর্বে বিভক্ত এ আয়োজন ছিল সত্যই ভাবগম্ভীর, উপভোগ্য ও আকর্ষণীয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ছ’জন কবি সাহিত্যিকসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের দুশোজন বরেণ্য সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাবিদ এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ছিলেন বীর প্রতীক সহ ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা। যাঁদের একজন আব্দুল মান্নান যিনি উৎসবের স্মারক পত্রের মোড়ক উন্মোচন করেন। উপস্থিত ছিলেন বাংলা অ্যাকাডেমী ও পশ্চিমবাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত অন্ততপক্ষে ১৫ জন কবি সাহিত্যিক।

ছিলেন রাজশাহী শহরের বিভিন্ন বিদ্যাপীঠের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ। অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের প্রতিটি পর্ব উপভোগ করেছেন অংশগ্রহণকারী দর্শকরা। যারা এই বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, পরিচালনা করেছেন সম্পন্ন করেছেন নির্বিঘ্নে তারা নিঃসন্দেহে প্রশংসা দাবীদার। শুধ তাই নয়, এমন প্রসঙ্গও উঠে এসেছে যে, যারা এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা, তারা সবাই সত্য রুদ্ধ এবং নানা শারীরিক জটিলতার শিকার তাদের আবর্তনে আগামীতে এমন সুন্দর অনুষ্ঠান হবে তো? অনুষ্ঠানের প্রতিটি পর্ব নিয়ে অনেক কিছু দেখা যায়। কিন্তু আমি সে কথায় যাব না তবে বিক্ষিপ্ত কিছু চিত্র ও আমার অনুভূতির তুলে ধরবো।

অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সকল গুণী ব্যক্তি প্রয়াত হয়েছেন তাদের সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত রবীন্দ্র গবেষক সুবক্তা অর্থনীতির অব. প্রফেসর সনৎ কুমার সাহা। এমন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির নিজের বাড়ি নেই। সারাটা জীবন ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে দিলেন অকৃতদার এই ব্যক্তি। কি বিচিত্র!

অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম বাদশা, বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি।

তবে এসেছিলেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) তরফদার মো. আখতার জামীল। তিনি নেহাতই একজন আমলা ননÑ তিনি তার সাবলীল বক্তব্য উপস্থাপন করে প্রমাণ করলেন তিনি একজন সাহিত্যানুরাগীও বটে । আরো একজন সাবেক আমলা সচিব কবি আসাদ মান্নান দুদিনের অনুষ্ঠানেই উপস্থিত থেকে কাব্যানুরাগ প্রমাণ করেছেন এবং সাহিত্য বিষয়ক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন ও গঠনমূলক বক্তব্য দিয়ে দর্শকদের চমৎকৃত করেছেন।

এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার। শুধু তাই নয়, এ অনুষ্ঠানের অংশীদার হয়ে এবং দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানের পুরো দায়িত্ব নিয়ে মহানুভবতা দেখিয়েছেন। একইভাবে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক এ অনুষ্ঠানে যেমন অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন তেমনি রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষও কলেজ সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠান করার সুযোগ দিয়ে আয়োজকদের বাধিত করেছেন।

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. অলীউল আলম এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন এবং ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্র ধরে রাজশাহীকে ‘সাহিত্যের শহর’ বলে এত সুন্দর ও নাটকীয় ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন যা দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। ভাষা সংগ্রামে মোশারফ হোসেন আখুঞ্জী প্রাপ্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল লেখক ও সাহিত্যিক শফিক ও এনজিও কর্মীরাও এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনৈক কর্মকর্তা তার বক্তব্যের শুরুতে অতিথিদের সম্বোধন করতে গিয়ে অনুপস্থিত প্রধান অতিথিকেও সম্বোধন করলেন। এই শুনে জনৈক দর্শক বললেন কানে কানে অতিভক্তি এর আনুগত্য দেখানোর নমুনা বটে।

অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা তার বক্তব্য শেষে বেশ আওয়াজ করে বললেন ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। যদিও সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ চিরজীবী হোক- এই স্লোগান ৩টি বলা নিশ্চিত করেছে।

আর একজন বক্তা বক্তব্য শেষে (জয় বাংলা) না বলেই মঞ্চ ছেড়ে যেতেই জনৈক দর্শক আওয়াজ করে বললেন জয় বাংলা? যদিও সেই বক্তা সরকারি চাকরি করেননি। তবে সঞ্চালক নিজে জয় বাংলা উচ্চারণ করে তার প্রক্সি দিলেন। কিছুদিন আগে নিয়োগপ্রাপ্ত জনৈক কর্মকর্তা বক্তব্য শেষে পুরো স্লোগানটি দিলেন তার বক্তব্য শেষে।

প্রথম পর্বের শেষের দিকে সঞ্চালক পরিচয় করিয়ে দিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামের সংগঠক মমতাজ বেগমের কুসংস্কারছন্ন গ্রামে প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ওই নারী গ্রামের নারীদের অধিকার সচেতন করার পাশাপাশি পিঠা উৎসব পালন করার কথা। নিয়মিত তাকে লড়াই করতে হয় গোঁমাড়ির সাথে। মমতাজ অনুষ্ঠানে লেখা একটি কবিতাও পাঠ করলেন। অনুষ্ঠান শেষে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে আসতেই রাজশাহী মহিলা পরিষদের নেত্রীরা মমতাজ বেগমকে জেঁকে ধরলেন তাকে দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মহিলা পরিষদের নেতৃত্বের অভাবটা পূরণ করা যায় কিনা এই আশায়।

কিন্তু মমতাজ বেগম বাস করেন জেলা শহর থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে রহনপুরের এই প্রত্যন্ত গ্রাম বাবুলখানায়। ফলে রাজশাহী মহিলা পরিষদের নেত্রীরা হতাশ হলেন তাদের প্রয়োজন জেলা শহরের একজন শিক্ষিত লড়াকু নারী।

দ্বিতীয়দিন কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি চত্বরে লেখকদের জমায়েত। লেখকদের সাথে আলাপক্রমে রাজশাহী থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক বললেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে থিয়েটারে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। গত ৩০ বছর ধরে শাহজাহান প্রামানিক চাঁপাইনবাবগঞ্জ থিয়েটারের হাল ধরেছিলেন। তিন বছর আগে তার মৃত্যুর পর নেতৃত্ব আজও গড়ে ওঠেনি। বুঝলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জেও প্রগতিশীল সংগঠকের নেতৃত্ব দানের যোগ্য এ তার আকাল পড়েছে।

রজনীকান্ত সেনকে নিয়ে আলোচনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর অনীক মাহমুদ সহ কয়েকজন বক্তা বললেন, তিনি এই রাজশাহী শহরেরই বাসিন্দা। রাজশাহী কলেজে হাইস্কুল ও রাজশাহী কলেজে লেখাপড়া করেন। ছাত্র থাকাকালীনই তিনি গান গাওয়া শুরু করেন এবং ভিন্নধর্মী গানের অসাধারণ গায়ক হয়ে ওঠেন। কিন্তু মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই তিনি দেহত্যাগ করেন।

এই অল্প বয়সে গানের জগতে যে স্বাক্ষর রেখে গেছেন সেগুলো নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা প্রয়োজন। বক্তাগণ বলেন, সেই শহরে রজনীকান্ত সেনের একটি বাড়ি ছিল। সেটির রক্ষণাবেক্ষণ ও অবৈধ দখলমুক্ত করা হচ্ছে না বলে অসহায় অপারগতা প্রকাশ করেন। স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত এই সরকারের আমলে তো এমন হবার কথা নয়।

একুশে পদকপ্রাপ্ত শিশুসাহিত্যিক আক্তার হোসেন এই উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। শিশুর মতোই ভুলোভালা মানুষ তিনি। অনুষ্ঠানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সবার সাথে আলাপে ব্যস্ত থাকছেন সারাক্ষণ। শিশুসাহিত্য বিষয়ক আলোচনা পর্বে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি ভুলক্রমে সকলকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি শ্রদ্ধেয় সভাপতি হিসেবে নিজের নাম উল্লেখ করে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করতে যাচ্ছিলেন। পাশে বসা অতিথিরা তার ভুল ভাঙ্গিয়ে সভা শুরু করতে বললেন। পরে তিনি শিশু সাহিত্য নিয়ে সাধারণ বক্তব্য রাখেন।

দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানটি হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে। অনুষ্ঠানের কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনা পর্বে প্রবীণ আলোচক বাংলা একাডেমীর পরিচালক মনির হায়দার তার বক্তব্যে বলেন, এই সিনেট ভবনটি শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এর নাম অনুসারে করা হয়েছে বটে। কিন্তু সিনেট হলের ভিতরের দেওয়ালে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের প্রায় ২০টি বড়-বড় ছবি শোভা পাচ্ছে অথচ তাজউদ্দিন আহমদের একটিও ছবি সেখানে স্থান পায়নি। থাকলে ভালো লাগতো।

অনুষ্ঠানের ৯টি পর্বের মধ্যে অন্যতম পর্বটি ছিল ৬ জন গুণীকে সংবর্ধনা প্রদান। রাজশাহী লেখক পরিষদ এই ৬ জন গুণী মানুষকে তাদের জীবদ্দশায় হাসান আজিজুল হক সাহিত্য পদক প্রদান করে। এরা শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ সাহিত্য, গবেষণা, কথাসাহিত্য ও ভ্রমণ সাহিত্যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। জাতি তাদের কাছে বিভিন্নভাবে ঋণী। সেই ঋণের খানিকটা পরিশোধ হয়েছে এই পদক প্রদানের মাধ্যমে। যারা এই সংবর্ধনার শুরুতে দায়িত্ব পালন করলেন। তারাও তো গুণীজন এবং বয়স্ক মানুষ তারা তাদের জীবদ্দশায় গুণীজন সংবর্ধনা পাবেন তো?

৪০ বছর পরেও একটি আঞ্চলিক সংগঠন উজ্জীবিত হতে পারে এবং দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে তার বড় উদাহরণ রাজশাহী লেখক পরিষদ। সর্বশেষ ২০০৭ সালে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এ সংগঠনটি। এর ১৭ বছর পর হাসান আজিজুল হক সাহিত্য উৎসব সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে সুচারুরূপে সম্পন্ন করে এক বিরাট চমক দেখিয়েছে।

এ অনুষ্ঠানে আগত ৬ জন পশ্চিমবঙ্গের কবি সাহিত্যিকদের আলোচনার জন্য একটি পৃথক পর্ব ছিল। সেখানে স্বাধীনভাবে তাদের পরবর্তী পরিচালনার জন্য ফ্লোর দেওয়া হয়। তারা তাদের বক্তব্য বলেছেন সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। হিন্দু-মুসলমান হলেও ভাষা তো একটি। ভৌগলিক সীমারেখা তারের বেড়া দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে কিন্তু ভাষার বন্ধনকে প্রতিরোধ করা যায় না। একজন কবি তো তার কবিতায় বৃহৎ বাংলার স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করেছেন।

বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতীতে গুণীজন অংশগ্রহণকারীদের একটি অংশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মানুষ। তাদের নিরবতা রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাটিতে। কিন্তু লেখাপড়া করতে এসে রাজশাহীতে থেকেছেন চাকরি করেছেন, অবশেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মায়া ভুলে রাজশাহীর মাটিতে থিতো হয়েছেন। তাদের শিক্ষা-দীক্ষা কর্ম এবং অন্যান্য গুণাবলী দিয়ে রাজশাহীকে আলোকিত করেছেন, বঞ্চিত করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জকে।

লেখক- সাংবাদিক