রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
শুভ্রারানী চন্দ
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর অন্যতম প্রধান চাহিদা নিরাপত্তার চাহিদা। শিশু তার মাতৃক্রোড়ে নিরাপদ। কিন্তু চিরকাল তো শিশু মায়ের ¯েœহের ছায়ায় থাকতে পারে না। ¯েœহশীল পরম মমতাময়ী মায়ের নিখাদ ভালোবাসার বন্ধন ছিঁড়ে একদিন তাকে বেরিয়ে পড়তে হয় শিক্ষা কিংবা জীবিকার প্রয়োজনে। কিন্তু মায়ের প্রতি পরিবারের সদস্যদের প্রতি সন্তানেরও থাকে ভালোবাসা, যদিও কর্তব্য ও দায়িত্বের কাছে অনেকক্ষেত্রেই সেটা ¤্রয়িমান হয়ে যায়। সন্তান মায়ের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কোন কিছুর বিনিময়েই মা তাকে বিসর্জন দিতে রাজি নয়। অতিসম্প্রতি রাজশাহীর নওদাপাড়া এলাকার আরবান হেলথ কেয়ারে জন্ম নেওয়া একটি শিশু চুরি হয়ে যায়। একটু দেরিতে হলেও অপরাধীকে চিহ্নিত করা গেছে এবং নবজাতক শিশুটিকে উদ্ধার করে তার মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সনাক্তকরণের কাজটি অনেকটা সহজ হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের সাহায্যে। সিসিটিভি-র ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হলে যে কোন ধরনের অপরাধ সনাক্তকরণের মাধ্যমে জননিরাপত্তা বাড়ানো সম্ভব হতো। এ বিষয়ে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।
নবজাতক চুরিটি যদি পাচারের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তবে তাকে অবশ্যই আইনের হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিৎ।
আর যদি এমন হয় ওই ভদ্রনারীর ছেলে সন্তানের জন্য আগ্রহ ছিল কিন্তু তিনি সন্তান ধারণে অক্ষম তাহলেও বিষয়টি শাস্তিযোগ্য এবং তার সুপরামর্শের প্রয়োজন। যতদূর জানা যায়, তিনি একজন কন্যা সন্তানের মা, নিঃসন্তান নন। কন্যাটিকেই তিনি পুত্রবৎ লালন-পালন করতে পারতেন। কিন্তু তার এ ধরনের অবিবেচক কাজের জন্য যেমন তিনি নিজে, তেমনি তার পরিবারকে নানা রকম ঝামেলা পোহাতে হবে।
ইতোমধ্যেই তাকে চাকরিচ্যূত করা হয়েছে। পারিবারিক সামাজিক ও আর্থিক সব দিক থেকেই তিনি নিজে হেয় হলেন এবং পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজনকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললেন। এটি একটি দৃষ্টান্তসূত্র যারা পুত্রসন্তান কামনায় একের পরে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন কিংবা নানা অনৈতিক কাজ করছেন, তাদের জেনে রাখা দরকার সুসন্তান সকলের কাম্য সে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে। এ বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো অতীব জরুরি। নতুবা তারা একদিকে অন্যের জীবনের নিরাপত্তা বা স্বাভাবিকত্ব নষ্ট করবে এবং প্রকারান্তরে নিজেরাও অনিরাপদ হয়ে পড়বে। ক্ষতির শিকার হবে অপরাধীর সাথে সম্পর্কযুক্ত সকলের।
সব চেয়ে বড় ক্ষতি হবে কার অবুঝ কন্যা সন্তানটির, যখন সে বুঝতে শিখবে মা সম্পর্কে তার ধারণা হবে নেতিবাচক। সুতরাং, তার জীবনের মোড়টা ঘুরে যেতে পারে। তার সামাজিক নিরাপত্তাও খানিকটা ঝুঁকির ভেতরে পড়ওেলা (কন্যা)।
শনিবার ২৮/০১/২০১৭ তারিখে নিহত হয়েছে হৃদয় গাজী নামে এক কিশোর। তার বাড়ি পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার চিংগুরিয়া গ্রামে। সে ছিল তার পিতার একমাত্র সন্তান। মেধাবী হওয়ায় বাবা ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য তাকে বরিশালে পাঠান। হোস্টেল থেকে সে পড়াশুনা করত। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে বখাটে ছেলেরা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করায় প্রতিবাদ করেছিল সে। তারই ফলশ্রুতি সমবয়সী একদল কিশোরের হাতে অকালে ঝরে গেলো একটা অমূল্য প্রাণ। বাবা নির্বাক। ছেলের ভালো করতে গিয়ে আজ তিনি সন্তানহারা। কেউ তার নিরাপত্তা দিতে পারেনি। সে শুধু মেধাবীই নয় সমাজসচেতন ও দায়িত্বসচেতন মানুষ ছিল। সে তার দায়িত্ববোধ থেকে ইভ-টিজিং এর প্রতিবাদ করেছে।
সাহসিকতার সাথেই সে তার নৈতিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছে। তাঁর এ আত্মদান সকলের অনুপ্রেরণা হয়ে রইলো। নৈতিকতা, দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ বয়সের সীমায় যে আটকে থাকে না হৃদয় তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আমরা আশা করি আমাদের কিশোরসমাজ অনুপ্রাণিত হবে তাঁর আদর্শ উদ্দীপনা ও সহযোগিতায়। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখবে। অনেকে হয়তো ভয়ও পেতে পারে এ নৃশংস হত্যাকা-ের জন্য। এক্ষত্রেও নিরাপত্তার বিষয়টি উঠে আসে। সমাজ তথা রাষ্ট্রকে এ দায়িত্ব নিতে হবে। তা না হলে শিশু কিশোররা বেড়ে উঠবে আতংকের ভেতরে যা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।
এ দেশের অনেক সন্তানই নিজ বাড়ির বাইরে অবস্থান করে শিক্ষা কিংবা জীবিকার প্রয়োজনে। যদি তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা না যায় তাহলে প্রয়োজনীয় সুযোগের অভাবে অনেকেরই মেধার বিকাশ ঘটবে না। অনেকেই তার অর্জিত জ্ঞান কাজে নিয়োগ করতে পারবে না। ফলে দেশই নয়, বিশ্ব বঞ্চিত হবে। অকালে যাতে আর কোন হৃদয়কে হারাতে না হয় সেক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ একান্তভাবে কাম্য। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি তার তদারকির মাধ্যমে একটা নিরাপদ বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সরকারসহ সকল সচেতন নাগরিকের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি আমাদের সন্তানদের সুকুমারবৃত্তির লালন ও বিকাশের ক্ষেত্রে। আপনার নিজের সন্তানকে সুশিক্ষা দিন এবং অন্য সন্তানদের সুশিক্ষার পথ সুগম করতে নিজের সন্তানকে অসৎ কাজ থেকে নিবৃত্ত করুন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধানে সামিল হোন। তাদের লেখা-পড়ার পাশাপাশি খেলাধূলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সাথে বেশি করে যুক্ত করুন। এগুলো একদিকে তাদের কাজে নিয়োজিত রাখবে, অন্যদিকে তাদের দেহ-মনের খোরাক যোগাবে এবং সংস্কৃতিবান, রুচিশীল, সৎ, কর্তব্যপরায়ণ, দায়িত্বশীল, নীতিবাদ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে তাদের সাহায্য করবে।
শুধুমাত্র লেখাপড়া শিখে সার্টিফিকেটধারী মানুষ নয়, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত সত্ত্বায় মনে প্রাণে একজন ভালো মানুষ তৈরিতে এগুলোর প্রয়োজন অপরিহার্য। আসুন ভালো মানুষ তৈরি করে আমরা এ পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তুলি এবং একই সাথে আমাদের এ দেশকে বিশ্ব সভায় গৌরবের আসনে উন্নীত করি।