নির্বাচন-পদ্ধতির ওপর স্থায়ী আস্থা সৃষ্টিতে করণীয়

আপডেট: জানুয়ারি ২৩, ২০১৭, ১২:০২ পূর্বাহ্ণ

ড. সুলতান মাহমুদ রানা



নির্বাচন কমিশন গঠন এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র ক্রমেই প্রশস্ত হচ্ছে। কখনো ইতিবাচক রাস্তায় এগোচ্ছে আবার কখনো এর বিপরীতটা হাতছানি দিচ্ছে। একদিকে ইতিবাচক আর অন্যদিকে নেতবিাচক এমন অবস্থার মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূত্রপাত হঠাৎ করে দেখা দেয়নি। এর পেছনের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। আর এই দোদুল্যমান যাত্রার শেষ কোথায় সেটি সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের কারো জানা নেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কোনো সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা না জানানো এবং সহনশীল না হওয়ার প্রবণতা বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য হঠাৎ করেই বন্ধ হওয়ার সুযোগ নিয়ে যথেষ্ট সংকট রয়েছে। আর এই সংকটের সমাধানটি যেমন কঠিন তেমনি আবার সহজও বটে। এর জন্য সবচেয়ে আগে যে বিষয়টি প্রয়োজন সেটি হলো সকল রাজনৈতিক পক্ষের আন্তরিকতা। সম্ভবত এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলমান আলোচনার সূত্রে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বীকৃত ও জরুরি বিষয় সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। তাঁর এই বক্তব্যে আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারছি যে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুরোপুরি সংযত না হলেও অনেকটা সংযত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
অল্প কয়েকদিন আগে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করেপারেশন (নাসিক) নির্বাচনে সকল বড় দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত নির্বাচনে টিকে থাকার বিষয়টিও যথেষ্ট ইতিবাচক ছিল। পাশাপাশি বিএনপি কর্তৃক নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ঘোষণার মানসিকতাও দেশবাসীকে ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলো কিঞ্চিতভাবে দেখাতে পেরেছে। একদিকে সরকারের আগ্রহ অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এগিয়ে আসার মানসিকতা সব মিলয়ে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আর এই যাত্রা দীর্ঘমেয়াদী করতে পারলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে কোনো সংকট থাকবে না সেটিই আমাদের বিশ^াস।
বিভিন্ন কারণেই একটি বিষয় প্রমাণিত হতে চলেছে যে, শুধু নির্বাচন কমিশন কিংবা প্রশাসন নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মূল ক্রীড়নক নয়। এর জন্য মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই মূখ্য। তবে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যে বিস্তৃত আলোচনা শুরু হয়েছে তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে ধরে নিতে পারি। যদিও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও এমন ইতিবাচক আলোচনার পথ ধরেই বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়েছিলেন। আর সেই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই অনেক ভালো নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেসব নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে কিংবা যারা করেছে তারা নিজেরাই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সহযোগিতা করেছে। এর জন্য নির্বাচন কমিশন, সরকার কিংবা প্রশাসনকে দায়ী করার বিষয়টি নিতান্তই অমূলক। তবে কিছু নির্বাচন যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি সেটিও নয়। সেক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশনকে এককভাবে কিংবা ঢালাওভাবে অভিযোগ দেওয়া যায় না। সেজন্যও আমারা রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেকাংশে দায়ী করতে পারি। বিশেষ করে যে দলগুলো নির্বাচন বর্জন কিংবা প্রতিহত করতে চায়।
নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করে তুলতে হলে সরকারি দল ও সরকার-বিরোধী দলগুলোকে সমান ভূমিকা রাখতে হয়। শুধু সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গ্রহণের মানসিকতা ব্যক্ত করলেই হয় না। এক্ষেত্রে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলসমূহকে আন্তরিকভাবে নির্বাচনে টিকে থাকতে হয়। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন, বিগত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে নির্বাচন চলাকালীন বিএনপির বর্জনের ঘোষণা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সুযোগ করে দেয়। এক্ষেত্রে সরকার কিংবা প্রশাসনের কোনো অভিযোগ থাকার বিষয়টি মানানসই নয়। কারণ নির্বাচনে একটি বড় দল না থাকলে একটি বড় সমর্থকগোষ্ঠীও নির্বাচনের বাইরে চলে যায়। ফলে নির্বাচনটি খুব ন্যায্যভাবেই অংশগ্রহণমূলক হয় না। উল্লেখ্য, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মতো নাসিক নির্বাচন থেকেও বিএনপি সরে দাঁড়ালে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠতো। সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে বা বৈধ উপায়ে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম হয় না। সরকারের অধীনে প্রভাবমুক্ত শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে চার বছরের মাথায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন ও ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার-সমর্থিতদের ভরাডুবি এবং বিরোধীদল সমর্থিতদের জয়জয়কারের বিষয়টিও প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের অন্যতম উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, বিএনপি এখন ইতিবাচক রাজনীতির  দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই লক্ষ করেছি, বিএনপি চেয়ারপারসন নিজে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে নির্বাচন কমিশন গঠনে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। বিএনপি পূর্বের ভুলগুলোকে শুধরে হলেও তারা যে রাজনীতিতে এগিয়ে আসতে চায় তা কয়েকটি ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই প্রস্ফূটিত হয়েছে।
সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার পরিবশে তৈরির বিষয়ে রাষ্টপতির যে বক্তব্য তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং গঠনমূলক রাজনীতির প্রত্যয় হিসেবে ধরে নিতে পারি। আর এ বিষয়ে কারো দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। ইতোমধ্যেই সরকারি দলের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করেই বলে দেওয়া হয়েছে যে রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তারা তা মেনে নেবে। কিন্তু একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য শুধু একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনই যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ও অবস্থানও এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও মতৈক্য ছাড়া এ ধরনের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন। এ ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই সরকারি দলের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি থাকে। নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির নেওয়া উদ্যোগকে সরকারি দল তথা আওয়ামী লীগ যেভাবে মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তেমনি বিএনপিকেও স্থায়ীভাবে মানসিকতা ব্যক্ত করতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির যেকোনো আহ্বানকেও শ্রদ্ধা জানাতে হবে।
সাংবিধানিক সকল বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এগিয়ে যাওয়াই রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত হবে। অন্য কোনো মারপ্যাঁচে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি পা রাখলে তা হবে নিজেদের জন্য চরম ভুল। নির্বাচন কমিশন কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বেশি উচ্চবাচ্যের ইস্যু সামনে আসলে সাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে এক ধরনের অনীহা ও অনাস্থা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে বিএনপির যেকোনোভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে অটল থাকই শ্রেয় হবে।
বিএনপি সরকারের অধীনে অর্থাৎ কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার যে ঘোষণা ইতিপূর্বে দিয়ে আসছিল তা থেকে অনেকটা সরে যাওয়ার বিষয়টি আমরা লক্ষ করছি। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্তকে সকলেই ভালোভাবে দেখছেন। অন্যদিকে সরকারি দলও সংবিধানের বাইরে নতুন কোনো পদ্ধতিতে নির্বাচনে যাবে না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কারণ সংবিধানের ৫৬ (৪)ও ৫৭ (৩) অনুযায়ী অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙে গেলে যদি নির্বাচন নাও হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার দায়িত্ব পালন করে যেতে কোনো বাধা নেই। কাজেই সরকারি দলের ও বিরোধী দলের হার্ডলাইনে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা গণতন্ত্রের যাত্রায় হুমকি হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।
সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার যে আহ্বান জানিয়েছেন, সেই প্রক্রিয়া অবিলম্বে শুরু করা উচিত। এ ধরনের একটি উদ্যোগের সূচনা ঘটলে দেশের রাজনীতিতে যেমন একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটবে, তেমনি আগামী নির্বাচন নিয়ে এখন থেকেই একটি আশাবাদের পরিস্থিতি তৈরি হবে। একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা এবং নির্বাচন-পদ্ধতির ওপর নাগরিকদের স্থায়ী আস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থাই এখন সকলের প্রত্যাশা। আমাদের দেশে একসময় নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, বুথ দখল ও সিল মারার অপগণতন্ত্র ছিল। আজ সেই অধ্যায় নেই। এখন গণমাধ্যমের প্রভাবে কারও পক্ষেই ওই রকম জোরজবরদস্তি কারচুপি কিংবা ভোটচুরি করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। বরং এমন প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্টদের জন্য বুমেরাং হয়ে থাকে।
বিএনপি যেহেতু সংসদেও নেই, রাজপথেও সক্রিয় নেই। ফলে বর্তমান চলমান রাজনীতির ধারায়, নির্বাচন কমিশন গঠন ও আগামী সংসদ নির্বাচন তাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। নানা অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকারের সামনে অনেক কিছুই এখন পরিস্কার। রাজনীতিতে সরকারি দল তথা আওয়ামী একধাপ এগিয়ে আছে। আর বিএনপির অবস্থা ক্ষেত্র বিশেষে একধাপ এগিয়ে, আবার অনেক সময় দুই ধাপ পিছিয়ে। এক কথায় বলা যায়, বিএনপির সামনে এখনও অন্ধকার। কাজেই বিএনপির রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা,  নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন প্রভৃতি বিষয়কে সামনে রেখে জাতীয় রাজনীতিতে এগিয়ে যেতে হবে।  অতএব বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যেকার সহনশীল মনোভাবের ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যত রাজনীতির গতিপথ। বিশেষ করে নির্বাচনী সংস্কৃতিকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে শুধু নির্বাচন কমিশন, সরকার কিংবা প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত নয় বরং রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আস্থানির্ভর ক্ষেত্র তৈরিতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়।
ংঁষঃধহসধযসঁফ.ৎধহধ@মসধরষ.পড়স