রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
রাবি প্রতিবেদক
বয়সসীমা বাতিলসহ নিয়োগের বিভিন্ন শর্ত শিথিলের দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ধারিত নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসহ বিভিন্ন ফটকে তালা ঝুলিয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। নিয়োগ পরীক্ষার হলে ঢুকে পরীক্ষার্থীদের বের করে দিয়ে বিক্ষোভ করেছেন তারা। গতকাল শুক্রবার তিনটি শিফটে নির্ধারিত পরীক্ষা বন্ধে দিনভর এসব ঘটনা ঘটে। এসময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। এছাড়া পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র ছিঁড়ে ফেলা ও অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীরা। অবরোধ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢোকার চেষ্টা করায় কয়েকজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বিজ্ঞান ভবনে ক্যাটাগলগার ক্যাটাগরিতে ৩টি পদের বিপরীতে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত এই পরীক্ষা বন্ধ করতে রাবি ছাত্রলীগ নেতকর্মী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতকার্মীরা কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেন। এরপর তারা কেন্দ্রের গেটগুলেতে তালা ঝুলিয়ে দেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গেটে অবস্থান নিয়ে গেট বন্ধ কর দেন। এসময় গেট দিয়ে কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
কয়েকজন পরীক্ষার্থী জানান, পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতকার্মীরা। এসময় পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলা হয় ও তাদের অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে ঢুকতে না পারায় ১০ থেকে ১১টা পর্যন্ত ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও বিকেল ৩টায় গ্রন্থগার সহকারী পদের নিয়োগ পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়নি। এছাড়া ক্যাম্পাসে প্রবেশের সময় শিক্ষকদেরও লাঞ্ছিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাতিল সিরাজ বলেন, সকালে আমিসহ কয়েকজন শিক্ষক বাজার করে কাজলা গেট আসি। এসময় আমরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে চাইলে আমাদের বাধা দেয়া হয় ও লাঞ্ছিত করা হয়।
ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়েই ঢুকতে পারছে না, ঘটনাটা খুবই দুঃখজনক। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনুরোধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে হচ্ছে, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জার।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ক্যাটাগরিতে ২৭টি পদের বিপরীতে গত ২৩ অক্টোবর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। গতকাল সকাল সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তিনজন ক্যাটালগার পদে, ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ২০ জন ড্যাটা এন্ট্রি অপারেটর এবং বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ৪ জন গ্রন্থাগার সহকারী পদের পরীক্ষা হওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল। তিনটি ক্যাটাগরিতে মোট ২৭টি পদের বিপরীতে আবেদন করেন ৩ হাজার ২২০ জন পরীক্ষার্থী। এতে প্রার্থীদের বয়সসীমা ১৮ থেকে ৩০ এবং মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য সর্বোচ্চ ৩২ বছর নির্ধারিত ছিল।
এদিকে পরীক্ষা দিতে না পারায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পরীক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়েন। পরীক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হন।
রংপুর থেকে পরীক্ষা দিতে আসা সুমনা আক্তার নামের এক পরীক্ষার্থী বলেন, ‘সাড়ে ১০টার দিকে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে আমার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গেটে এসে বাধার সম্মুখিন হই। এতদূর থেকে পরীক্ষা দিতে এসে আবার ফিরে যেতে হবে, যা সত্যিই দুঃখজনক।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, ‘স্থানীয়রা এসে ক্যাম্পাসে তালা ঝুলিয়ে রেখে প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করছে। এতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়মে, এখানে বাইরের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।’
রাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শাহ আজম বলেন, শিক্ষকদের যদি লাঞ্ছিত করা হয়ে থাকে তবে তা খুবই দুুঃখজনক। আমরা এ বিষয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলবো। এ ধরনের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত।
এ বিষয়ে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ‘চাকরি কে পাবে তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। তবে অস্বচ্ছতা দূর করে চাকরির নির্ধারিত বয়সসীমা উঠিয়ে দিয়ে পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে আমারা অবস্থান নিয়েছি।’ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ও এমনকি এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ধারিত কোনও বয়সসীমা ছিল না বলে তিনি দাবি করেন।
ডাবলু সরকার আরো বলেন, ‘এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দাবিতে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নাতি-নাতনিদের কোটা সংরক্ষণের দাবিতে অনশন করেছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের দাবিটিও আমলে নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, আমরা নিয়ম মেনে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত করেছিলাম। সে অনুযায়ী আমরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু বহিরাগতরা এসে বিশৃঙ্খলা করে পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে। দাবি বা অভিযোগ আমাদের লিখিতভাবে না জানিয়ে এভাবে পরীক্ষা বন্ধ করা দুঃখজনক। আমরা পরীক্ষা বাতিল করছি না। পরবর্তীতে মিটিং করে পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, এ নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ করতে বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহান ও আইসিটি সেন্টারের প্রশাসক অধ্যাপক খাদেমুল ইসলাম মোল্যার বাসায় গিয়ে তাদেরকে ক্যাম্পাসে আসতে নিষেধ করা হয়। অন্যথায় প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর রাবি স্কুলের একটি নিয়োগ পরীক্ষা সাক্ষাৎকার বন্ধ করে দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, পরীক্ষা বন্ধ করতে এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এসব ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।