বুধবার, ৯ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক ও দুর্গাপুর প্রতিনিধি:
রাজশাহীতে গেল মে মাসের শেষভাগে ১২ দিন বৃষ্টি হয়েছে। পাকা ও আধা পাকা ধানের উপরে বৃষ্টিপাতের কারণে সময়মত ঘরে কেটে তুলতে পারেনি বোরো চাষীরা। বেশ কিছুদিন একটানা বৃষ্টির ফলে জমিতে পানি জমে ধান থেকে অঙ্কুরোদমের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি সময়ে বাতাসে নুয়ে পড়া ও ঝরে যাওয়ার কারণে আশানুরূপ ফলন পায়নি চাষীরা। একই সঙ্গে জমিতে পচে নষ্ট হয়েছে ধানের খড় (আউড়)। এতে করে অর্ধিকভাবে ক্ষতির কথা বলছেন বোরো চাষীরা।
তবে কৃষি অফিস বলছে- ‘এই বৃষ্টিপাতে ক্ষতি হয়নি বোরো ধানের। তবে পাকা ধানের উপরে বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে চাষিরা সময় মত কাটতে পারেনি।’
তবে বোরো চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- যারা বৃষ্টিপাতের আগে ধান ঘরে তুলতে পেরেছেন, তাদের ধান ভালো আছে। কিন্তু যাদের ধান বৃষ্টিপাতের মধ্যে পড়েছে। তারা ধান ঘরে তোলা নিয়ে বেশ সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। বৃষ্টির পানি জমে ধানে অঙ্করোদম সৃষ্টি হয়েছে। তবে যারা ধান মাড়াই শেষে দ্রুত মেঝে বা খোলা জায়গায় ফ্যানের বাতাস দিতে পেড়েছে তাদের ধানের ক্ষতি হয়নি। যাদের ধান জমিতে নুয়ে ৫ থেকে ৬ দিন ছিল তারাই ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। এতে করে চাষীরা শুধু ধানের শীষ কেটে নিয়েছে। খড় জমিতেই থেকে পচে নষ্ট হওয়ায় অর্ধিকভাবে ক্ষতি হয়েছে তাদের।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, গেল ১৫ মে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫ মিলিমিটার, ১৮ মে ২ দশমকি ৬ মিলিমিটার, ২০ মে ৩১ মিলিমিটার, ২২ মে ৮৪ মিলিমিটার, ২৩ মে ৩৮ মিলিমিটার, ২৪ মে ৩১ দশমিক ৮ মিলিমিটার, ২৫ মে ২৫ মিলিমিটার, ২৬ মে ১৪ দশমিক ৬ মিলিমিটার, ২৭ মে ৬ দশমিক ২ মিলিমিটার, ২৯ মে ৫ দশমিক ২ মিলিমিটার, ৩০ মে ১৮ দশমিক ৩ মিলিমিটার ও ৩১ মে ৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
জানা গেছে- জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে বৃষ্টিপাতে বেশি ক্ষতি হয়েছে পবা ও পুঠিয়ায়। এই দুই উপজেলার নিচু ধানের খেতগুলোতে বৃষ্টির পানি জমে যায়। এছাড়া যে জমিগুলো থেকে বোরো ধান কেটে শুকাতে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো আবার পানিতে ভিজে যায়। ফলে বৃষ্টিপাতের কারণে ঠিকমত চাষিরা বোরো ধান ঘরে তুলতে পারেনি। এতে করে ধানের জমিতে অঙ্করোদম গজিয়ে যায়। একই চিত্র পুঠিয়া, দুর্গাপুর উপজেলায়। পুঠিয়া ভরভরিয়া গ্রামে ধান কেটে পানির মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের নিয়ে আসতে দেখা গেছে।
শ্রমিকরা জানায়, বৃষ্টিপাতের ফলে জমিতে পানি জমে যায়। শুধু ধানের শীষ বের হয়ে আছে। তারা শুধু ধানের শীষ কেনে নিচ্ছেন। বৃষ্টিপাতের সময় বাতাসের কারণে অনেক গাছ পড়ে গেছে। সেগুলো আবার পানিতে তলিয়ে গেছে। এই নুয়ে পড়া ধানগুলোর অঙ্করোদম গজিয়েছে।
মাড়িয়া গ্রামের কৃষক রাজিব জানান, বৃষ্টির আগে শ্রমিক নিয়ে জমির পাকা ধান কাটা হয়েছিল। এরপর কাটা ধান শুকানোর জন্য জমিতেই রেখে আসেন। পরের দিন থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টির কারণে ভেজা ধান ঘরে তুলতে পারিনি। এতে করে ধানে অঙ্করোদম দেখা গেছে। পরে অতিরিক্ত শ্রমিক লাগিয়ে জমির ধান ঘরে তুলেছি। কিন্তু ধনের খড় পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।
নগরীর বুধপাড়া গ্রামের বোরো চাষী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বৃষ্টির সময়ে বাতাসের কারণে তার প্রায় ১০ কাঠা জমির ধান নুয়ে যায়। টানা বৃষ্টিতে পানি জমে যায় জমিতে। এতে করে ধানের অঙ্করোদম দেখা গেছে। পরে তাড়াহুড়ো করে বেশি শ্রমিক দিয়ে ধান কেটে নেওয়া হয়। ধান মাড়াইয়ের দিন ও পরের দিন বৃষ্টিপাত হয়।
তিনি বলেন, মোট জমি ৩০ কাটা। ২৫ মণের বেশি ধান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রায় ২০ মণ ধান হয়েছে। জমির ধানের খড় পাওয়া যায়নি। গত বছর একই জমির খড় বিক্রি করেছিলাম ১২ হাজার টাকায়। কিন্তু এবছর জমি থেকে ধানের খড় পাওয়া যায়নি। বৃষ্টির পানিতে পচা গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। বিগত বছরে খড় বিক্রির টাকায় ধান কাটতে শ্রমিকের মজুরি দিয়েছিলাম। কিন্তু এবছর ধানের ফলনও কম হয়েছে। পাশাপশি খড়গুলো পচে নষ্ট হয়েছে। যেহেতু এই অঞ্চলের খড় পচে যাওয়ার ঘটনা ঘটায় গোখাদ্যে এক ধরনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
চাষি শফিকুল ইসলাম বলেন, তারা দুজনে মিলে প্রায় ৪ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। ৭০ মণের বেশি ধান হওয়ার টার্গেট ছিল। কিন্তু যে ধান মাড়াই করা হয়েছে সেই হিসেবে ৫০ মণ হতে পারে।
এই ধান উৎপাদনে খরচ বেশি। তাই প্রতিটা চাষি আশা থাকে খড় বিক্রি করার। কারণ গোখাদ্য হিসেবে খড়ের বাজারে চাহিদা ভালো। কিন্তু বৃষ্টিপাতের কারণে সব খড় নষ্ট হয়ে গেছে। কোনো মতে ধানটুকু ধরে তুলতে পেরেছি।
তিনি বলেন, কাটায় আধামণ (২০ কেজি) করে ধান হলেও ৪০ মণ ধান হওয়ার কথা। কিন্তু সেই ধানও পায়নি। বৃষ্টির সময় বাতাসে সব ধান নুয়ে গেছে। আর জমিতে পানি জমে ধান ডুবে গিয়েছিল। বৃষ্টির পানি কমায় ধানের শীষ কেটে নেওয়া হয়েছে। ধানের খড়গুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এতে করে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকার খড় নষ্ট হয়ে গেছে তার।
উপজেলার জয়নগর গ্রামের করলা চাষি জাবের আলী জানান, কয়েক দিনের বৃষ্টির কারণে তার করলা খেতে পানি জমে যায়। সেই জমে থাকা পানির কারণে গাছের গোড়া পচন রোগ ধরে। এতে অধিকাংশ করলা গাছ মরে গেছে।
বিষয়টি নিয়ে দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা পারভীন লাবনীর মুঠোফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করে বন্ধ পাওয়া গেছে। তাই এই বিষয়ে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, এই বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়নি বোরো ধানের। বৃষ্টিার আগেই চাষিরা ধান ঘরে তুলে নেয়। তবে পাকা ধানের উপরে বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে চাষিরা সময় মত কাটতে পারেনি। তবে বৃষ্টিপাতের কারণে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেনি।