রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক
সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে লোহার রড ও পাইপ দিয়ে নিষ্ঠুর কায়দায় পিটিয়ে দুই পা গুড়িয়ে দিলেও হামলার ১৮ দিন পরও থানায় মামলা করতে পারেনি নওগাঁর আত্রাই উপজেলার ভরতেতুলিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল কুদ্দুশ। উপরন্তু সন্ত্রাসীদের ভয়ে আত্রাই উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য যেতে পারেন নি। কুদ্দুশের ওপর নৃশংস হামলাকারী সন্ত্রাসীদের ক্ষমতার দাপট ও হুমকিতে কুদ্দুশের পরিবারও এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে কুদ্দুশ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা বলছেন, গুরুতর আঘাতের ফলে কুদ্দুশের দুই পায়ে গভীর ক্ষত ও জখম হয়েছে। তার দুই পায়ে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে। কুদ্দুশের শরীরের বিভিন্ন স্থানেও একাধিক ক্ষত হয়েছে।
এদিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের চিকিৎসক সাজেদুর রহমান জানান, কুদ্দুশের দুই পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গভীর ক্ষত ও জখম হয়েছে। শরীরে ও পায়ে ধারালো অস্ত্রের কোপও আছে। আপাতত তিনি আশঙ্কামুক্ত মনে হলেও জ্বর হচ্ছে। আর এর ফলে তার সেরে উঠতে সময় লাগছে। তবে আঘাতের কারণে শরীরের ভেতরে কোনো ইনজ্যুরি হয়েছে কি-না সেটা জানতে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ী কুদ্দুশ জানান, সন্ত্রাসীরা এর আগে দুই ভাই, চাচা ও চাচাত ভাইসহ তার পরিবারের ৪জনকে নৃসংশভাবে খুন করে। এসব মামলায় হত্যাকারীদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও হয়েছে। তবে রায় ঘোষণার পর খুনীরা তাকেও মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে একাধিকবার। আর সেই আতঙ্কে তিনি জমি-জমা চাষবাস ফেলে বছর তিনেক আগে গ্রাম থেকে আত্রাই উপজেলা সদরে এসে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য করেন কাঠ আর খড়ির ব্যবসা। কুদ্দুশ শ্রমিক লীগের স্থানীয় কমিটির সদস্যও। কুদ্দুশের অভিযোগ, সন্ত্রাসীরা কিছুদিন ধরে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে অব্যাহতভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল।
কুদ্দুশ ছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতাকর্মী বলেন, গত ৮ অক্টোবর দুপুরে আত্রাই উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে শ্রমিক লীগের সভা ছিল। ওই সভায় অন্যদের সঙ্গে কুদ্দুশও অংশ নেন। সভা চলার এক ফাঁকে সে দলীয় অফিসের সামনের চায়ের দোকানে গিয়ে চায়ের কথা বলেন। এসময় আত্রাই এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী আফসার আলীর ছেলে নাঈম (২৬), রাজ্জাকের ছেলে রাব্বী (২৫) বারিকের ছেলে শরিফ (২৬) ও আবুল প্রামাণিকের ছেলে এনামুলসহ (২৮) আরো ৬/৭ জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী আকস্মিকভাবে কুদ্দুশের ওপর হামলা করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানান, সন্ত্রাসীরা লোহার রড ও পাইপ ছাড়াও ধারালো হাঁসুয়া ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে। সন্ত্রাসী দলটি এক পর্যায়ে কুদ্দুশকে আওয়ামী লীগ অফিসের পেছনে টেনে হিচড়ে নিয়ে গিয়ে আবারো বেপরোয়াভাবে নির্যাতন করে। সন্ত্রাসীরা কুদ্দুশকে মৃত ভেবে ফেলে গেলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দ্রুত উদ্ধার করে আত্রাই উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে ভর্তি করেন। পরে সন্ত্রাসীদের অব্যাহত হুমকি ও শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। সেই থেকে কুদ্দুশ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনার পরদিন লোক মাধ্যমে কুদ্দুশ একটি এজাহার দিলেও আত্রাই থানা পুলিশ নৃশংস এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি তার এজাহারটি মামলা হিসেবে রেকর্ডও করেনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কুদ্দুশের ওপর হামলাকারী সন্ত্রাসী দলটির অন্যতম সদস্য নাঈমের বাবা আফসার আলী স্থানীয় সাংসদ ই¯্রাফিল আলমের ঘনিষ্ঠ। কয়েক বছর আগে বিএনপির সাবেক নেতা আফসার আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে উপজেলা কমিটির প্রচার সম্পাদক হন। আত্রাই থানা পুলিশও এই আফসারের হাতের মুঠোয় থাকেন। আর বাবার সঙ্গে পুলিশের দহরম মহরমের কারণে আফসারের দুই ছেলের সন্ত্রাসে জর্জরিত আত্রাই উপজেলার অনেক আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়না।
অন্যদিকে পুলিশও আফসারের কথায় উঠে বসে বলে অভিযোগ দিলেও কোনো লাভ হয় না। স্থানীয়রা আরো অভিযোগ করেন, বছর দুয়েক আগে আফসারের নির্দেশে শ্রমিক লীগ নেতা কালুকে এই আওয়ামী লীগ অফিসের সামনেই পিটিয়ে হত্যা করেছিল আফসারের দুই সন্ত্রাসী ছেলে ও সহযোগী সন্ত্রাসীরা। কিন্তু পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নাম প্রকাশ না করে আরো বলেন, অজ্ঞাত কারণে আফসারের মতো বিতর্কিত একজন লোকের প্রতি স্থানীয় সাংসদ ই¯্রাফিল আলমের নিরঙ্কুশ আস্থা। স্থানীয়ভাবে টেন্ডারবাজি থেকে ইজারাসহ লাভজনক সব কাজেই আফসারের কথায় শেষ কথা। আর এ কারণে তার ছেলেরা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। ব্যবসায়ী কুদ্দুমের ওপর হামলার পরও এসব সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এলাকায়। এমনকি তারা নিয়মিত থানাতেও যাতায়াত করছে।
অভিযোগের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতা আফসার আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমার এবং ছেলেদের ব্যাপারে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে তা সঠিক না। আমার ছেলেরা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সম্পৃক্ত না। এছাড়া আমার লোকজনও কুদ্দুশের ওপর হামলা চালাই নি বলে দাবি করেন তিনি।
ব্যবসায়ী কুদ্দুশের হামলার ঘটনায় দেয়া এজাহার মামলা হিসেবে রেকর্ড না করার বিষয়ে জানতে চাইলে আত্রাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহা. বদরুদ্দোজা জানান, তিনি এমন এজাহার পান নি। এমনকি কুদ্দুশের ওপর হামলার ঘটনাও শোনেন নি। তবে সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চাওয়ায় তিনি ঘটনাটি সম্পর্কে খোঁজ নেবেন।