পঙ্গু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা গণপিটুনিতে নিহত শয্যাশায়ী মা, নবজাতককে নিয়ে স্ত্রী হাসপাতালে

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪, ১০:৪২ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক


রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। তিনি ২০১৪ সাল থেকে হামলায় পঙ্গুত্ব বরণ করেন। শনিবার দিবাগত (৭ সেপ্টেম্বর) রাত একটার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।



নিহত মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। তিনি রাবির মেডিকেল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন। নগরীর বুধপাড়া এলাকায় থাকতেন তিনি। এর আগে শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে বিনোদপুর এলাকা থেকে তাকে আটক করে ছাত্র-জনতা। এরপর তিন দফায় গণপিটুনি দিয়ে বোয়ালিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয় রাজশাহী মেডিকেলে। সেখানে রাতে তিনি মারা যান বলে নিশ্চিত করেছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

মহানগরীর বোয়ালিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এসএম মাসুদ পারভেজ বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে রাতে বিনোদপুর বাজারে মাসুদের ওপর হামলা হয়। পরে একদল শিক্ষার্থী তাকে প্রথমে মতিহার থানায় নিয়ে যায়। কিন্তু মতিহার থানায় ৫ আগস্টের সহিংসতার কোনো মামলা নেই; তাই তাকে বোয়ালিয়া থানায় আনা হয় যেন তাকে কোনো সহিংসতার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

ওসি বলেন, গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হয়েছিলেন মাসুদ। তার শারীরিক অবস্থা দেখে সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়। এখন পরিবার চাইলে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সামনে দুর্বৃত্ত দ্বারা হামলার শিকার হয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল মাসুদ। এতে মাসুদের ডান পায়ের নিচের অংশ গোড়ালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাম পা-ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেটে দেওয়া হয়েছিল হাতের রগও। এ হামলায় পা হারিয়ে মাসুদ একটি প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাচল করতেন। তার অন্য পা শনিবার রাতে ভেঙে দেওয়া হয়।

বোয়ালিয়া থানা হাজতে শুয়ে থাকা অবস্থায় মাসুদ বলেন, ‘আমি বিনোদপুরে ওষুধ নিতে এসেছিলাম ভাই। আমি ছাত্রলীগ করতাম ওই জন্য ধরেছে। কিন্তু আমার পা ২০১৪ সালে কেটেছে ভাই। রগ-টগ সব কাটা ভাই। আমি তো অনেক দিন আগে থেকেই ছাত্রলীগ করা বাদ দিয়েছি ভাই।’

মাসুদকে যখন আনা হয়, তখন বোয়ালিয়া থানায় ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার। ৫ আগস্ট এক ছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে দুই যুবককে ধরে থানায় এনেছিলেন তিনি। থানায় তিনিও মাসুদকে দেখেন।

মাসুদের মৃত্যুর খবর শুনে সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, আমরা যে দুজনকে নিয়ে গিয়েছিলাম, তাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। তার মধ্যেই আহত অবস্থায় একজনকে আনতে দেখলাম। কিন্তু কারা তাকে এনেছিল তা চিনতে পারিনি। পুলিশের এটা ভালোভাবে দেখা উচিত ছিল।

জানা গেছে, দীর্ঘ দিন বেকার থাকার পর নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে একটি চাকরি চেয়ে ২০২২ সালের শেষের দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লেখেন মাসুদ। এরপর ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৭ মীর তাফেয়া সিদ্দিকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে পাঠানো চিঠিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে নিয়োগ দিতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করেন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নিয়োগপত্র পেয়ে ২২ ডিসেম্বর চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। সেই থেকে তিনি এ পদেই চাকরি করতেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর কন্যা সন্তানের বাবা হন মাসুদ।

এদিকে, পাঁচ দিন আগে এক ফুটফুটে মেয়ে সন্তানের বাবা হয়েছেন তিনি। নিজের নামানুসারে মেয়েটির নাম রাখার পরিকল্পনা ছিল মাসুমা। ছোট্ট শিশুটিকে পৃথিবীর আলো দেখাতে স্ত্রী বিউটি আরার সিজারিয়ান অপারেশন হওয়ায় তিনিও অসুস্থ। বাবা বেঁচে নেই। মা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন গ্রামে। নিজেও পঙ্গু। তার এই কষ্টের পৃথিবীতে আশার প্রদীপ হয়ে কন্যা সন্তানটিই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।

ছোট্ট মেয়ে শিশুটির এই পরিবারটিকে নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনের ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে ছাত্র উপদেষ্টা ড. আমিরুল ইসলাম কনক বলেন, ‘উপাচার্যের পরামর্শে আমি এবং প্রক্টর মিলে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ওর পরিবারে চার দিন বয়সের একটি কন্যাসন্তান, স্ত্রী ও তার অসুস্থ মা রয়েছেন। তার স্ত্রীর চার দিন আগেই সিজার হয়েছে। তারা তাদের নিজ এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে গেছেন। এখানে অভিভাবক বলতে তার মামা রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত বিধি অনুযায়ী তার বাচ্চার ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে সেই পরিবারটির জন্য আমরা সাহায্য করবো।’

এদিকে আব্দুল্লাহ আল মাসুদের এমন মৃত্যুর পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে নানা আলোচনা। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহিদ নেওয়াজ খান তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে এক পোস্টে বলেন, ‘রাজশাহীতে পিটিয়ে পঙ্গু মানুষটাকে মেরে ফেলা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এরকম বর্বর খুনিদের হাতে জুলাই-আগস্ট মাসে শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন। ওরা ছিল পোশাকে, এরা পোশাক ছাড়া। এটাই পার্থক্য। তিন দিন আগে পিতা হওয়া মানুষটার বাচ্চাটা জীবনেও জানবে না বাবা কী জিনিস। মাসুদের প্রত্যেকটা খুনিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে- যেমন জুলাই-আগস্ট মাসের খুনিদের। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের এক মাসেরও বেশি সময় পর একটা হত্যাকাণ্ডকে জনরোষ বলার সুযোগ নেই। জনরোষও কোন যুক্তি না। আগের সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কতটা মানবিক, কতটা মানবাধিকারে বিশ্বাসী, সেটা বোঝা যাবে পঙ্গু মাসুদ হত্যাকাণ্ডে সরকার কত দ্রুত কী ব্যবস্থা নেয় তার ওপর।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান তার ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করে বলেন, ‘এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চরম বর্বরোচিত এবং জঘন্য। সে যেই হোক না কেন আর তার বিরুদ্ধে যত বড় অভিযোগই থাকুক না কেন এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমি ধিক্কার জানাই। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো নেই।’

এদিকে আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নিহতের ১৮ ঘণ্টা পরও পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও প্রকার মামলার খবর পাওয়া যায় নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি এস এম মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘আমাদের এখানে কেউ কোনও অভিযোগ করে নি। তার বিষয়ে পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া মতিহার থানায় হবে, সেখানে কেউ মামলা দায়ের করছে কি না আমি জানি না।’
এ বিষয়ে মতিহার থানার ওসি আরিফুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেন নি।