পদ্মার বুকে চর প্রাণ-প্রকৃতিতে ঝুঁকি বাড়াচ্ছেই!

আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৪, ১০:১৫ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক


গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ৫৮ বছর পর ঢাকঢোল পিটিয়ে রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ থেকে ভারতের ময়া নৌবন্দরের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু এর কিছুদিন পরই পদ্মা নদীতে পাথরবোঝাই একটি জাহাজ আটকে পড়ায় এ বন্দর দিয়ে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ এটিকে ‘ট্রায়াল রান’ অ্যাখ্যা দিয়ে চালু করার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানালেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নব্যতা সংকটের কারণেই বন্ধ হয়ে গেছে নৌ-বন্দরের কার্যক্রম। যা আজও আলোর মুখ দেখে নি। সম্ভাবনাময় শুধু এই বন্দরটিকেই নয়; পদ্মায় জেগে ওঠা চর প্রতিনিয়তই ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এ অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতিতে!



নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতির মূল কেন্দ্রবিন্দু নদ-নদী। ফারাক্কা বাঁধ, দখল-দূষণ ও ত্রটিপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পের কবলে পড়ে সংকটের মুখে পড়েছে রাজশাহীর নদীগুলো। হারাচ্ছে স্বাভাবিক প্রবাহ। অনেক নদী দখল হতে হতে মৃত খালে পরিণত হচ্ছে। আবার প্রমত্তা পদ্মাও পড়েছে সংকটে। যে সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের শক্ত নীতি ও তার বাস্তবায়নের প্রত্যাশা এ অঞ্চলের মানুষের।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (বেলা) তথ্য বলছে, দখল আর দূষণে ধুকছে রাজশাহী বিভাগের অন্তত ৪০টি নদ-নদী। দুইপাড় দখলের কারণে বেশিরভাগ নদ-নদী মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে। আবার সরকারের গৃহীত ত্রটিপূর্ণ পদক্ষেপেও কিছু নদ-নদীর মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছে।

তথ্য বলছে, রাজশাহীর চারঘাট থেকে শুরু হওয়া বড়াল নদেরও মৃত্যু হচ্ছে। চারঘাটে পদ্মার শাখা হিসেবে বড়াল নদের উৎপত্তি। ২২০ কিলোমিটার এর দৈর্ঘ্য। এই নদের সঙ্গে সংযোগ ৫০ লাখ মানুষের। কিন্তু দখলের কারণে নাটোরের বড়াইগ্রামে প্রায় ১৮ কিলোমিটার এই নদের কোন অস্তিত্ব নেই।

১৯৮১ সালে বড়ালের উৎসমুখে স্লুইসগেট দেয় পাউবো। তারপর থেকেই এ নদে পানিপ্রবাহ কমতে থাকে। ১৯৮৫ সালে নদের ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে আটঘড়ি নামক স্থানে আরেকটি বাঁধ পড়ে। এরপর ১৯৮৫ সালে নদের ১২৫ কিলোমিটার ভাটিতে তিনটি ক্রসবাঁধ দেওয়া হয়। এতে নদের অবস্থা করুণ হয়ে ওঠে। এভাবে বিভাগের আট জেলার অন্তত ৪০টি নদ-নদী মৃতপ্রায় অবস্থায় রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদ-নদীকে বাঁচাতে প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে গবেষণা করতে হবে। করতে হবে নদীর ডাটাবেজ। সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সব নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। দখল-দুষণসহ নদীবিরোধী সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। নদীর ওপর নির্মিত ছোট ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে। শোধন ছাড়া কোন বর্জ্য নদীতে ফেলা যাবে না। শহরে নদীর দুইধারে পায়ে হাঁটা রাস্তাসহ বসার ব্যবস্থা করে নগর পরিকল্পনা করতে হবে। নদীপাড়ে লাগাতে হবে ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষ। লোকায়ত জ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়ে এলাকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিবেচনায় রেখে নদী সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি নদী রক্ষায় নিতে হবে আইনি পদক্ষেপ। তাহলেই নদ-নদীগুলো টিকে থাকতে পারবে।

ভারতের আগ্রাসী সিদ্ধান্তে পদ্মা নদীর স্বাভাবিকতা দিনকে দিনকে যেমন নষ্ট হচ্ছে, এতে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ – হয়ে দেখা দিচ্ছে দখল-দূষণ ও ত্রটিপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজশাহীর মূল নদী হলো পদ্মা। নদীটি এ অঞ্চলের জীব-বৈচিত্র্য ও আমাদেরও অস্তিত্বেরও রক্ষক। কিন্তু দিনকে দিনকে ফারাক্কা বাঁধের কারণে পলি জমে নদীর বুকে চর জেগে উঠছে। আবার নদীর বুকে দখলদারদের আগ্রাসনও চলছে। এই দুই আগ্রাসন অপসারণে তেমন কোন উদ্যোগ না থাকায় তা মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠছে।

পদ্মায় এখন সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন মাস যৌবন থাকছে। অর্থাৎ বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে নদীতে পানি থাকছে ৭ দশমিক ৫ মিটার। আর বর্ষা মৌসুমে এবার সর্বোচ্চ ১৬ দশমিক ৪৮ মিটার পানি পাওয়া গেছে। বছরের একটি বড় সময় অর্ধেকেরও কম পানি থাকছে পদ্মায়। যা জীববৈচিত্র্যের জন্য ঝুঁকি বাড়াচেছ।

এদিকে, দখল-দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচেছ না স্থানীয় প্রশাসনকে। বরং ভবিষ্যতে জন্য ঝুঁকি বাড়াতে পারে এমন প্রকল্পও বাস্তবায়ন হচ্ছে।

জানা গেছে, ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকে রাজশাহী মহানগরে পানির চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ সরবরাহ করে ওয়াসা। কিন্তু বর্তমানে পানির স্তর ক্রমশ নেমে যাওয়ায় পানির সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে ‘রাজশাহী ওয়াসা ভূ-উপরিস্থ পানি শোধনাগার’ শীর্ষক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের আওতায় পদ্মা নদীর পানি বিশুদ্ধ করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে মহানগরীসহ গোদাগাড়ী, কাটাখালী এবং নওহাটা পৌরসভায় সরবরাহ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মহানগরীর পাশাপাশি আশপাশের কয়েক লাখ মানুষের বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দূর হবে জানানো হয়েছে। তবে এ প্রকল্পের নেতিবাচক প্রভাবও জনজীবনে পড়তে পারে বলে শঙ্কা অনেকের।

জানা গেছে, প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় দশমিক ৫ কিউসেক পানি পদ্মা নদী থেকে তোলা হবে। এ পানি উত্তোলনের সঙ্গে ড্রেজিংসহ কার্যকর ব্যবস্থাপনা না থাকলে তা ঝুঁকি বাড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ভূতত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, পদ্মায় এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চর। ফারাক্কা বাঁধের কারণে যে চর পড়ছে, এটিকে অপসারণে নদী ড্রেজিং দরকার। এমনিতেই ফারাক্কা বাঁধের কারণে পানির প্রাপ্যতা ও স্বাভাবিকতা নষ্ট হচ্ছে। এই চর ও দখলের মতো বিষয়গুলো ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করতে পারে।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম অঙ্কুর বলেন, নদীতে জেগে ওঠা চরগুলো প্রতিনিয়ত ড্রেজিং করে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা গেলে ভালো হয়। কিন্তু এজন্য প্রকল্পের প্রয়োজন। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু ড্রেজিং হচ্ছে। তবে সেটা অপর্যাপ্ত। আর দখল-দূষণ এড়াতেও আমরা কাজ করছি। তবে আমাদের সকলকেও নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে।
রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকীর হোসেন (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, এই প্রকল্পটি জনগুরুত্বপূর্ণ। আর প্রকল্প হাতে নেয়ার আগেই তৎকালীন সরকার ওইসব বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করেছে। প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন প্রকল্প সরকার কখনোই হাতে নিবে না। এটাতেও সবকিছু যাচাই করেই কাজ করা হচেছ।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ