পাকিস্তানের স্কুল-কলেজে একাত্তর ও বাংলাদেশ নিয়ে কী পড়ানো হয়

আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৪, ২:৩০ অপরাহ্ণ

ইতিহাস ক্লাসে পাঠদান করছেন এক শিক্ষিকা, ইনসেটে পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ

সোনার দেশ ডেস্ক :


বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের জেরে ক্ষমতার কেন্দ্রে যে নাটকীয় পালাবদল হয়েছে, তাকে দেশের অনেকেই ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে বর্ণনা করছেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে পাকিস্তানেও এই ঘটনাপ্রবাহকে অনেকেই স্বাগত জানাচ্ছেন। গত মাসে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে সে দেশের মাটিতে বিজয় মিছিল পর্যন্ত হয়েছে, যা এক অতি বিরল ঘটনা!

পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কী ধরনের সম্পর্ক রাখা দরকার, সে বিষয়টি নিয়েও ইদানীং সরকারের ভেতরে ও বাইরে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের জনক কায়েদ-ই-আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকীও প্রকাশ্যে ঢাকার মাটিতে পালিত হয়েছে বহু বহু বছর পর, যা মাত্র কিছুদিন আগেও প্রায় অভাবনীয় ছিল।

ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার নিয়মিত অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। অথচ কিছুদিন আগে তার জন্য এমন শীর্ষ নেতৃত্বের সাক্ষাৎ পাওয়াই কঠিন ছিল।

গত মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় এরকমই এক বৈঠকে বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ আহমেদ মারুফ বাংলাদেশের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিধানরঞ্জন রায় পোদ্দারের সঙ্গে দুই দেশের ‘পাঠ্যক্রম’ নিয়ে আলোচনা করেন। পরে জানা গেছে, দুই দেশের স্কুল-কলেজে পরস্পরের সম্পর্কে ঠিক কী পড়ানো হয়, সেটা নিয়েই তাদের মধ্যে বিস্তারিত কথাবার্তা হয়েছে।

এই পটভূমিতে পাকিস্তানে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে ঠিক কী পড়ানো হয়, সে প্রশ্নটি এখন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই প্রতিবেদনে নজর দেওয়া হয়েছে ঠিক সেদিকেই। পাকিস্তানে স্কুলপাঠ্য সরকারি ইতিহাস বইয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির যে ‘পটভূমি’ ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা এরকম—

এক. ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল (১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি পেয়ে), আর পশ্চিম পাকিস্তানে বিজয়ী হয়েছিল পিপলস পার্টি (১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮৭টি পেয়ে)। তবে আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে একটিও আসন পায়নি, আবার পিপলস পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে একটিও আসন পায়নি।

দুই. তখন ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার ‘বিজয়ী দলগুলোর’ হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিষয়টি নিয়ে অযথা গড়িমসি করতে থাকে এবং এই দেরির ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষোভ মাথাচাড়া দেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ উসকে দিয়ে সামরিক সরকার নিজেদের কর্তৃত্ব আরও কায়েম করতে চেষ্টা চালায়।

পূর্ব পাকিস্তানে আইন অমান্যের পরিস্থিতি তৈরি হলে জাতীয় প্রতিরক্ষার স্বার্থে তা দমন করার জন্য সামরিক শাসকরা সেখানে সেনা নামানোর সিদ্ধান্ত নেন। তারা আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেফতার করে।

তিন. এই রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের ফায়দা নিতে ভারত তখন পূর্ব পাকিস্তানে হস্তক্ষেপ করে, যাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারত তার সেনাবাহিনীর সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলি ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

এ থেকে এটা সহজেই অনুমেয় যে, বাংলাদেশের সৃষ্টিকে বাঙালিদের ‘অর্জন’ হিসেবে না দেখিয়ে পাকিস্তান তার নতুন প্রজন্মের সামনে ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ হিসেবেই তুলে ধরতে চেয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধকেও তারা কখনোই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করে না, বরং এটিকে তারা একটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবেই তুলে ধরেছে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, দেশটির স্কুলের ইতিহাস বইয়ের রচয়িতারা মনে করছেন, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানে একটি নয়, দুটি ‘বিজয়ী দল’ ছিল। আর তারা হলো আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টি। গোটা পাকিস্তানের মোট আসনসংখ্যার নিরিখে আওয়ামী লীগ যদিও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছিল; বইটি দাবি করছে, যেহেতু আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনও আসন জেতেনি, তাই তাদের সেই জয় ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বরং ভুট্টোর পিপলস পার্টিরই যে তখন পশ্চিম পাকিস্তানে ক্ষমতায় আসা উচিত ছিল, পরোক্ষভাবে সেটার জন্যও সাফাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে ওই বইয়ে।

বর্তমানে দিল্লিপ্রবাসী বাংলাদেশি মিডিয়া কর্মী ও গবেষক জেরিন হোসেন গত কয়েক সপ্তাহে পাকিস্তানে বহু শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন এবং তাদের যেসব বইপত্র পড়ানো হয়, সেগুলোও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন, অনুবাদ করিয়ে নিজেও পড়েছেন।

তিনি বলছিলেন, ‘আমাকে সে দেশের ছাত্রছাত্রীরা সবাই প্রায় একবাক্যে বলেছেন, বাংলাদেশ যে ভারতের ষড়যন্ত্রের ফলেই সৃষ্টি, এটাই তাদের চিরকাল শেখানো হয়ে এসেছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম যে আদৌ কোনও দিন বঞ্চনা করেছে বা পূর্বের বাঙালিদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের সঙ্গত কারণ ছিল, এটা তাদের কখনও জানতে দেওয়া হয়নি।’

জেরিন হোসেন পাকিস্তানের স্কুল পর্যায়ের নবম শ্রেণির একটি উর্দু ইতিহাস বই থেকেও এ প্রসঙ্গে একটি চমকপ্রদ উদাহরণ দিচ্ছেন। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ কেন সৃষ্টি হলো, ইতিহাস বইয়ে তার সাতটি নির্দিষ্ট কারণ দর্শানো হয়েছে, যেগুলো খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। সংক্ষেপে কারণগুলো বর্ণনা করা হলো—

১. ভৌগোলিক দূরত্ব: ‘দুর্ভাগ্যবশত’ পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের মধ্যে ব্যবধান ছিল ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার, যার মাঝে অবস্থিত ছিল ভারত। এই দূরত্বের ফলে প্রতিরক্ষাগত জটিলতা যেমন তৈরি হয়েছিল, সমস্যা হয়েছিল যোগাযোগ ও পরিবহনের ক্ষেত্রেও।

২. ভাষার প্রশ্ন: পাকিস্তান সৃষ্টির পর যেহেতু শুধু উর্দুকেই রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছিল। কারণ তাদের মুখের ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তাদের আলাদা একটা আবেগ ছিল। এই ভাষাগত বঞ্চনার ইস্যু থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম।

৩. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতি: প্রায় দীর্ঘ ৯ বছর পাকিস্তানে কোনও সংবিধান ছিল না। ১৯৫৬-তে একটা সংবিধান প্রণীত হলেও পরে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসক দেশ শাসন করতে থাকেন। পাকিস্তানে কোনও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ছিল না বলেই ১৯৭০-এর নির্বাচনে জেতার পরও আওয়াম লীগকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

৪. অর্থনৈতিক কারণ: প্রথম থেকেই পাকিস্তানের সব অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ছিল না। তবে বিভিন্ন কারণের জেরে পূর্ব পাকিস্তানে দারিদ্র্য ছিল চরম। সেখানকার বাংলাভাষী মানুষ বিশ্বাস করেছিল, আলাদা পাকিস্তান তৈরি হলে তাদের দুর্দশার অবসান হবে, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পরে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদের বঞ্চনার কারণেই শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় ও তিনি ছয় দফা নিয়ে আসেন।

৫. সামরিক অভিযান: পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ‘সশস্ত্র আন্দোলন’কে পাকিস্তান সরকার একটি ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে গণ্য করেছিল এবং তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল। এতে বহু নিরীহ সাধারণ মানুষ মারা যায়, সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের শেষ গভর্নর ড. এম এম মালিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে রাজনৈতিকভাবে সংকট সমাধান করতে বলেছিলেন, কিন্তু তার পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়েছিল।

৬. ভারত ও পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা: পাকিস্তানের এই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের সুযোগ নিয়ে সেই সময়ের পরাশক্তিগুলো, সঙ্গে ভারত, পূর্ব পাকিস্তানে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের ভারত শুধু সামরিক প্রশিক্ষণই নয়, তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্রও তুলে দিতে থাকে। একটা পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রও ঘোষণা করে তাদের সপ্তম নৌবহর (সেভেনথ ফ্লিট) ভারত মহাসাগর অভিমুখে যাচ্ছে–কিন্তু তা পূর্ব পাকিস্তানকে নয়, বরং পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করতে! সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রও ‘নীরবে’ সায় দিয়েছিল।
৭. হিন্দু শিক্ষকদের নেতিবাচক ভূমিকা: পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষক ও অধ্যাপকদেরই প্রাধান্য ছিল, কারণ বাঙালি মুসলিমরা তখন শিক্ষা-দীক্ষায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে ছিলেন। এই হিন্দু শিক্ষকরা তরুণ প্রজন্মকে পাকিস্তানের চেতনার বিরুদ্ধে ক্রমাগত উসকানি দিতে থাকেন, যা পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার দাবিকে প্রশস্ত করে।

সোজা কথায়, বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানের লেখকরা নানা সাম্প্রদায়িক, ভূরাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কারণকেই দায়ী করছেন। কিন্তু তারা বাংলাদেশিদের মুক্তিসংগ্রাম বা স্বাধীনতার লড়াইকে তারা ছিটেফোঁটাও কৃতিত্ব দিতে রাজি নন!
ইসলামাবাদের কমস্যাটস ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিলাল খান নিজের স্কুলজীবনে এই ইতিহাস বই পড়েই একাত্তরের যুদ্ধ ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জেনেছেন।

সেই বিলাল খান এদিন বলছিলেন, ‘আলাদা একটা স্বাধীন দেশ তৈরি করতে পারাটা যে মাশরিকি (পূর্ব) পাকিস্তানের কত বড় কৃতিত্ব, সেটা আমাদের কখনোই বুঝতে দেওয়া হতো না। আমাদের মাগরিবি (পশ্চিম) পাকিস্তানে সব সময় বলা হতো, ওটা আসলে সবটাই হিন্দুস্তানের ‘সাজিশ’ (চক্রান্ত)।’

‘এটা যে মাগরিবি পাকিস্তানের কত বড় ব্যর্থতা, সেটাও খুব সযত্নে আড়াল করে যাওয়া হতো!’ বলছেন তিনি।
তবে এ ধরনের ‘প্রোপাগান্ডা’ চালানো সত্ত্বেও বাংলাদেশের ‘মুসলিম ভাই’দের প্রতি পাকিস্তানের যে একটা সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির আবহ চিরকালই ছিল, বিলাল খানের সেটাও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই।

প্রসঙ্গত, বছর চারেক আগে (২০২১ সালে) বাংলাদেশ সৃষ্টির সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে বিবিসির উর্দু বিভাগ একটি প্রতিবেদন করেছিল, যাতে পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে একাত্তরকে কীভাবে তুলে ধরা হয়েছে, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। আজও সেই অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।

বিবিসির সাংবাদিক সাদ সোহেইলের ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার নামে একটা নাটক করে সফল হন।’ এবং ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি ছিল বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে এক গোপন চুক্তির ফল।’

পাকিস্তানে সরকারের অনুমোদিত ‘পাকিস্তান স্টাডিজ’ নামে এক পাঠ্যপুস্তকে এভাবেই লেখা আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস। এই বইয়ে পূর্ব পাকিস্তান যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, এর জন্য অনেক অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের কারণকে দায়ী করা হয়।

পাকিস্তানে বাংলাদেশের জন্ম সম্পর্কে স্কুলশিক্ষার্থীরা প্রথম জানার সুযোগ পায় নবম শ্রেণিতে উঠে, যখন তাদের বয়স ১৫ বা ১৬। সরকারিভাবে স্কুলে যেসব পাঠ্যবই পড়ানো হয়, সেখানে খুবই অস্পষ্টভাবে ১৯৭১ সালের ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়। এই বিবরণ দুই বা তিন পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ, খুব বিস্তারিত কিছু সেখানে নেই।

তবে এর বিপরীতে বেসরকারি স্কুলগুলোতে ও-লেভেলে ‘পাকিস্তান স্টাডিজ’ বলে যে বই পড়ানো হয়, সেখানে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে যেসব অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তবে সরকারি বা বেসরকারি স্কুল—উভয় ক্ষেত্রেই পাঠ্যক্রমে একটা বিষয় অভিন্ন, তা হলো সেখানে বাংলাদেশের তোলা অভিযোগগুলো মোটামুটি উপেক্ষিত।

এসব কারণ ব্যাখ্যা করার সময় ভারতকে যে কেবল শত্রু-রাষ্ট্র বলে বর্ণনা করা হয়, শুধু তা-ই নয়, ‘বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে’ পাকিস্তান ভাঙার জন্য ভারতকেই আসল অপরাধী বলে দোষ দেওয়া হয়।

পাকিস্তানের শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এ এইচ নাইয়ার বিবিসিকে বলেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সরকারের লোকজন মনে করেছিল পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানকে একমাত্র ধর্মই এক রাখতে পারে। কাজেই তারা ‘এমনভাবে ইতিহাস শিখিয়েছে, যাতে একটা ধর্মীয় পরিচয় তৈরি করা যায়!’

পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, কীভাবে ‘তরুণ বাঙালিদের মন বিষিয়ে তুলতে হিন্দু শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’ এতে আরও বলা হয়, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে’ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর পর আর কোনও ‘দেশপ্রেমিক’ নেতা তৈরি হননি, সেটাও পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার একটা কারণ।

বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে বাঙালিদের পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ কীভাবে দেখতো, সে কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক নাইয়ার বলেন, ‘আমাদের চোখে বাঙালিরা ছিল এক অভুক্ত, পাঁচ ফুট উচ্চতার দুর্বল জাতি। আর আমরা হচ্ছি উঁচু জাতের মানুষ। কাজেই একধরনের হেয় চোখে দেখা হতো তাদের।’

পাকিস্তানি নির্মাতা ও পরিচালক নাবিল কুরেশি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষেই ‘খেল খেল মেঁ’ নামে একটি সিনেমা তৈরি করেছিলেন, যাতে অভিনয় করেছিলেন সজাল আলি ও বিলাল আব্বাস খানের মতো জনপ্রিয় পাকিস্তানি তারকারা। কিন্তু সেই ছবি নিয়ে পাকিস্তানে বিতর্কও কম হয়নি।

ওই ছবিতে দেখানো হয়েছিল, পাকিস্তানের একটি ইউনিভার্সিটির ড্রামা ক্লাবের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের প্রোডাকশন নিয়ে ঢাকায় একটি নাট্যোৎসবে যোগ দিতে যাচ্ছে। তারা স্থির করে, যেহেতু উৎসবটা ঢাকায় হবে, তাই তারা বাংলাদেশ সৃষ্টির আসল ইতিহাস নিয়েই নাটকটি করবে।

কিন্তু এরপরই তাদের পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয় কারণ ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে তাদের সহপাঠী ছাত্র-ছাত্রীরা প্রশ্ন তুলতে থাকে, ৫০ বছর আগে পাকিস্তান কী রকম শোচনীয়ভাবে যুদ্ধে হেরেছিল, সেই লজ্জার কাহিনিই কি তারা নাটকে তুলে ধরতে চায়?

সিনেমায় দেখানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও তাদের সটান জানিয়ে দিচ্ছেন, আজকের প্রজন্মের পাকিস্তানি তরুণ-তরুণীরা যতই স্বাধীনচেতা হোক, দেশের ‘প্রকৃত ইতিহাস’ তুলে ধরাটা তাদের দায়দায়িত্ব নয়!

একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আজও যে একটা অন্তর্লীন স্ববিরোধিতা ও তীব্র অস্বস্তি কাজ করে, ‘খেল খেল মেঁ’ নামে ওই সিনেমাটিই ছিল তার প্রমাণ।

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর পাকিস্তানে এই চর্চা বা ‘ডিসকোর্স’ কোনও নতুন মোড় নেয় কি না, সেটাই হবে দেখার বিষয়!
তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন