পাকিস্তান দিবসে উড়লো বাংলাদেশের পতাকা

আপডেট: মার্চ ২৩, ২০১৭, ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক



২৩ মার্চ, ১৯৭১ : স্বৈরাচারী ইয়াহিয়ার সরকার চেয়েছিল ৩১ বার তোপধ্বনীর মাধ্যমে সূচনা করতে। আজ ছিল ‘পাকিস্তান দিবস’। বাংলার জনগণ তা হতে দেয়নি। বাঙালিরা এদিনটিকে প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে। এদিন ‘পাকিস্তান দিবস’ এর যা কিছু কর্মকাণ্ড হয়েছে তা সেনানিবাসগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেনানিবাস ছাড়া কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উড়েনি। শুধু উড়েছে বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা। কোটি কোটি মানুষের একই সেøাগান ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
এদিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দশ প্লাটুন গণবাহিনী নিয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। পল্টন মাঠে উপস্থিত হাজার হাজার নারী-পুরুষ পতাকা উত্তোলনকালে উঠে দাঁড়িয়ে নতুন পতাকার প্রতি অভিনন্দন জানায়। পল্টন ময়দানে বাঙালি যুব বাহিনীর সামরিক কুচকাওয়াজ ও যুদ্ধের মহড়া দর্শকদের স্বাধীনতা আন্দোলনের যাত্রাপথে প্রেরণা যোগায়। জয় বাংলা বাহিনীর ৫ শতাধিক সদস্য-সদস্যার চোখে-মুখে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের ভাব। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চারনেতা আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ ও আসম আব্দুর রব অভিবাদন গ্রহণ করেন। বাদ্যের তালে তালে মার্চ পাস্ট কালে উপস্থিত হাজার হাজার জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে।
গণবাহিনী মার্চ পাস্ট করে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে গার্ড অব অনার প্রদানের জন্য তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে গমন করে। এই নয়নাভিরাম কুচকাওয়াজ দেখার জন্য রাস্তার দু’পাশে হর্ষোৎফুল্ল ও স্লোগানমুখর হাজার হাজার নর-নারী ও শিশুরা ভিড় জমায়। বঙ্গবন্ধু মুজিব হাতে একটি নতুন পতাকা নিয়ে গণবাহিনীর উদ্দেশে উদ্দীপনামূলক ভাষণ দেন।
প্রতিরোধ দিবসে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলনের সময় ‘জয় বাংলা বাংলার জয়-।’ গানটি গাওয়া হয়। পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৪ নেতা উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকাকে সালাম জানায়।
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে এদিন ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাই কমিশন ও সোভিয়েত কনস্যুলেটে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
পাকিস্তান সরকারের ২৩ মার্চের পাকিস্তান দিবসের কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকাস্থ চিন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, নেপালী দূতাবাসে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। পরে ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও জনতা এসব দূতাবাসে গিয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে দেয়। মার্কিন দূতাবাস এদিন বিতর্ক এড়ানোর নামে কোন পতাকাই উত্তোলন করেনি।
এদিন বেতার ও টেলিভিশনে কবি রীবন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। পাকিস্তানের পতাকা ছেঁড়া হয় এবং জিন্নাহর ফটো পুড়িয়ে ফেলা হয়। এদিন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা, সরদার শওকত হায়াত খান, আব্দুল ওয়ালী খান, গাউস বক্স বেজেজেহা, মওলানা নূরানী যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর বাসভবনে দেখা করেন এবং একই সাথে চলে যান। এই সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি সর্বোত্তম আশা পোষণ করি। তবে নিকৃষ্টতম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকি।’
ভাসানী ন্যাপ পাকিস্তান দিবসকে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ হিসেবে পালন করে। এ উপলক্ষে পল্টনের এক সমাবেশে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া সভাপতিত্ব করেন। সভায় রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে ঘোষিত স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য সংগ্রামী শপথ নেয়া হয়। এর আগে সভায় মওলানা ভাসানীর একটি বাণী পাঠ করে শোনান হয়। তিনি অসুস্থতার জন্য সভায় উপস্থিত হতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধু মুজিব ও ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা এদিন প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রথমে সকালে ও পরে বিকেলে বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টারা ছিলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন। অপরপক্ষে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা ছিলেন, পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান এস.এম আহমদ, বিচারপতি এ. আর কর্নেলিয়াস, লে. জে. পীরজাদা ও কর্নেল হাসান। এ বৈঠকে আওয়ামী লীগ তাদের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রণীত একটা খসড়া শাসনতন্ত্রও পেশ করেন। পীরজাদা শাসনতন্ত্রের মূল প্রাতিপাদ্য বিষয়গুলো মেনে নেয়া হবে বলে আভাসও দেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এদিন সারাদিনই প্রেসিডেন্ট ভবনে অনুপস্থিত ছিলেন। কোথায় গিয়েছিলেন? ভুট্টোর সাথে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে অসামরিক পোশাকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এক ব্যক্তি কয়েকবার দেখা করে যায়। তার গাড়িতে কোন নম্বর প্লেট ছিল না। কে এই ব্যক্তি এবং কেনই বা হোটেলে তার এত ঘনঘন যাতায়াতের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল?
বিহারী অধ্যুষিত এলাকার মিরপুরে অল্প কিছু সংখ্যক যে সব বাঙালি গৃহে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন করা হয়েছিল, বিহারীরা সে সব বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। ঢাকা সেনানিবাস থেকে ছদ্মবেশে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার ও জওয়ানরা সশস্ত্র হয়ে মিরপুর এলাকায় টহল দেয় এবং বিহারীদের সশস্ত্র মদদ যোগায়।