‘পানকৌড়ির রক্ত’ ও কবি আল মাহমুদ

আপডেট: মে ১৬, ২০২৫, ২:৪৫ পূর্বাহ্ণ

আহমেদ সাদিক রওনক


‘পানকৌড়ির রক্ত’ চেতনার এক অপূর্ব দর্শন। এ এক অনন্য কাব্যিক শিরোনাম, যা শুধু শব্দের নয়, অনুভূতির, প্রতীকের, ও গভীর দার্শনিক ব্যঞ্জনার বাহক। এই বাক্যটি পাঠকের হৃদয়ে আলোড়ন তোলে, কারণ তা প্রাকৃতিক এক অস্তিত্বকে তুলে ধরে এমনভাবে, যেন সে হয়ে ওঠে সাহিত্য ও শিল্পের চিরন্তন প্রতীক। পানকৌড়ি শুধু এক জলচর পাখির নাম নয়, সে হয়ে উঠেছে সাহিত্যের শরীর, রক্ত নয় -তার সত্তা যেন গদ্য-কবিতার প্রাণরস। এখানে প্রতীকমূলক তাৎপর্য, সাহিত্যিক ব্যাখ্যা, দর্শন, প্রকৃতি ও সাহিত্যের আন্তঃসম্পর্ক এবং এর নানাবিধ ব্যঞ্জনা আপন আলোয় বিশেষভাবে উদ্ভাসিত। একটি সাধারণ পাখির রক্ত যে বাস্তবতা ছাড়িয়ে হয়ে উঠতে পারে সাহিত্যিক চেতনার প্রতীক, তা কবি আল মাহমুদ কাব্যসম্ভার দিয়ে বুঝিয়েছেন। পানকৌড়ি হলো একধরনের জলচর পাখি, যাদের দেখা যায় নদী, হাওর, বিল কিংবা সমুদ্রের ধারে। পানিতে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করা এদের স্বভাব। কালো রঙের দেহ, দীর্ঘ গলা এবং ধারালো ঠোঁট -দেখতে যেমন অনন্য, আচরণও তেমনি রহস্যময়।

এই পাখিটি যেন নিঃশব্দে কবিতা লেখে। তার মাছ ধরা মানে শুধু খাদ্য সংগ্রহ নয়, যেন প্রতিদিনের অস্তিত্বের জন্য এক লড়াই। সেই লড়াইয়ের মাঝে আছে সৃষ্টির, সাহিত্যের, শিল্পের ব্যঞ্জনা। তার শরীর থেকে ঝরে পড়া পানির ফোঁটা যেন ছন্দ, তার উড়ান যেন পদ্যের প্রবাহ, আর তার নিঃসঙ্গতা যেন সাহিত্যিক নির্জনতা, তার জলকেলি যেন যুগল প্রেমের জিয়ন্ত জবান। এখানে রক্ত, বাস্তবতার প্রতীক নাকি অনুভবের রূপ? এমন প্রশ্নে কবি অনুভবের অনন্ত আধার হিসেবে কাব্যাশ্রয়ী আয়োজনকে সত্যের আলোকে আন্দোলিত করেছেন। ‘রক্ত’ শব্দটি বহুবিধ অর্থ বহন করে। তা শরীরের জৈব উপাদান, আবার তা ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, সংগ্রাম, এবং ইতিহাসের চিহ্ন। কিন্তু কবি, বহুরৈখিক চিন্তক ‘পানকৌড়ির রক্ত শুধু রক্ত নয়’ অর্থাৎ এটা যে কেবল জৈবিক নয়, এর মধ্যে রয়েছে শিল্পের প্রগাঢ় বোধ তাকে বুঝিয়েছেন। এই রক্ত -হয়তো পানকৌড়ির যন্ত্রণা, হয়তো তার নিঃসঙ্গতা, হয়তো তার নিঃশব্দ মৃত্যু -তা আর কেবল রক্ত নয়, তা হয়ে ওঠে সাহিত্য। কারণ সাহিত্য তো অনেক সময়ই জন্ম নেয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। ব্যথা, নিঃসঙ্গতা, নিঃশেষতা -এই সবই তো সাহিত্যিক সৃষ্টির অনুঘটক।

এটাই হয়ে উঠেছে অমর সাহিত্য: সময়ের ঊর্ধ্বে এক অস্তিত্ব ‘অমর সাহিত্য’ শব্দযুগলটি বোঝায় এমন সাহিত্য যা সময়ের সীমা পেরিয়ে মানুষের অন্তরে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে। যেমন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুল, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা জয় গোস্বামীর কবিতা। পানকৌড়ির রক্ত যখন অমর সাহিত্যে রূপ নেয়, তখন বোঝা যায় -তার যন্ত্রণা, তার ক্ষুদ্র জীবন -তা হয়তো প্রকৃতির চোখে নগণ্য, কিন্তু সাহিত্যিক দৃষ্টিতে তা মহৎ। সাহিত্যের কাছে প্রতিটি অস্তিত্বই অর্থপূর্ণ, কারণ সাহিত্য রচনা করে মানবিক অনুভূতির ভাষা। সেই অর্থে পানকৌড়ির মৃত্যু মানে এক গল্পের শুরু -এক অমর কবিতার জন্ম।

প্রতীক ও ব্যঞ্জনা: সাহিত্যের ব্যাকরণে ‘পানকৌড়ি’ হলো সাহিত্যে প্রতীক যা এক অপরিহার্য উপাদান। যেমন কবিতায় ‘বৃষ্টির দিন’ বোঝায় বিষণœতা, ‘নদী’ বোঝায় সময় বা প্রবাহ, তেমনি ‘পানকৌড়ি’ এখানে হয়ে উঠেছে অস্তিত্ব ও শিল্পের প্রতীক। এই পাখির রক্ত রক্ত নয় -এর মানে, তার অস্তিত্ব এক বৃহত্তর বাস্তবতার অংশ, যার ব্যাখ্যা কেবল জীববিজ্ঞানের মাধ্যমে হয় না। সাহিত্যের দৃষ্টিতে, এই রক্ত কবির কলমে রূপ নেয় কালো কালির – যা দিয়ে লেখা হয় ইতিহাস, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ কিংবা প্রকৃতির আত্মজীবনী।

জীবন ও সাহিত্যের অন্তঃসম্পর্ক: জীবন সাহিত্যের উৎস, আবার সাহিত্যও জীবনকে ব্যাখ্যা করে। পানকৌড়ির জীবন ছোট, সাদামাটা, প্রায় নিঃশব্দ -কিন্তু সেই জীবনেই রয়েছে সাহিত্যিক সৌন্দর্য। অনেকটা জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো -যেখানে ‘বনলতা সেন’-এর মতো নারী আসে ইতিহাসের অন্ধকার থেকে, কিংবা ‘রূপসী বাংলা’র সৌন্দর্য উঠে আসে প্রকৃতির নিঃসীম নৈঃশব্দ্যে। সাহিত্য জীবনকে রূপ দেয় ব্যঞ্জনায়, প্রতীকে, ভাষায়। পানকৌড়ি এখানে জীবন ও সাহিত্যের সংযোগরেখায় অবস্থান করছে -যার রক্ত বাস্তবে হয়তো মাটিতে ঝরে পড়ে, কিন্তু সাহিত্যে তা রূপ নেয় চিরন্তন শিল্পে।

আধুনিক সাহিত্যে প্রকৃতি ও প্রাণীর স্থান: আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক সাহিত্যে প্রকৃতি ও প্রাণীর উপস্থিতি ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে। পরিবেশদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের হ্রাস -এসবের বিরুদ্ধে সাহিত্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘পানকৌড়ির রক্ত রক্ত নয়’ এটা একটা প্রতিবাদের ভাষাও হয়ে উঠে। এ যেন জীববৈচিত্র্যহীন এক ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে লেখা একটি সাহিত্যিক ঘোষণাপত্র। এ যেন বলা, এই পাখির রক্ত শুধুই ক্ষরণ নয় -এটা শিল্পের হারিয়ে যাওয়ার সংকেত।

সাহিত্যিক উদাহরণ: যখন প্রাণী হয়ে ওঠে প্রতীক বাংলা সাহিত্যে বহুবার প্রাণীরা সাহিত্যের উপাদান হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ‘নিশি পাখি’, ‘ঘুঘু’, ‘চিল’ -প্রতিটি পাখি যেন মানুষের অনুভবকে বহন করে। সুকুমার রায়ের ‘খিচুড়ি’ কিংবা ‘অবলীলায় খেলা যায়’ -সেখানে পশুপাখি হাস্যরসের মাধ্যম হলেও এক গভীর দর্শনের বাহক। জয় গোস্বামীর কবিতায়, শহরের ইট-কাঠের মাঝে প্রকৃতির ক্ষুদ্র উপাদানগুলোও হয়ে উঠেছে ভাবনার প্রতীক। এই ধারায় পানকৌড়িও একটা নতুন সংযোজন -তার রক্ত একটা দৃশ্যমান মৃত্যু নয়, বরং একটা অদৃশ্য জন্ম -সাহিত্যের জন্ম।

কবি আল মাহমুদের ‘পানকৌড়ির রক্ত’ কাব্যগ্রন্থে প্রেম, প্রকৃতি, দেশপ্রেম ও সমাজচিত্র গভীরভাবে মিশে আছে। প্রতিটি বিষয়ের বিশ্লেষণে আছে গভীর প্রেম – আল মাহমুদের প্রেম কবিতাগুলোতে রয়েছে এক ধরনের ঘন আবেগ, শারীরিকতা ও মানবিক টানাপড়েন। প্রেম এখানে শুধু রোমান্টিক নয়, বরং এক ধরনের প্রান্তিক বাস্তবতায় মোড়ানো আকাক্সক্ষা। নারী তার কবিতায় কখনো রহস্যময়, কখনো প্রতিবাদী, আবার কখনো সমাজের নিগ্রহে জর্জরিত এক চরিত্র। উদাহরণস্বরূপ, কবিতায় দেখা যায়-

‘তোমার শরীর থেকে মুছে গেছে যে গন্ধ / আমি তারই জন্য ব্যাকুল।’ আবার প্রকৃতির কথা বলতে গিয়ে কবি ভাষায় ফুটে উঠে- প্রকৃতি তাঁর কবিতায় কখনো দৃশ্যের পটভূমি, আবার কখনো চরিত্রের মতো জীবন্ত। গ্রামীণ বাংলার নদী, খাল, মাছ, পাখি, মাঠ, জলাভূমি তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে আসে। ‘পানকৌড়ির রক্ত’ নামেই বোঝা যায় প্রকৃতির একটি বন্য, প্রতীকী উপাদান কীভাবে কবিতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর প্রকৃতি যেন নিসর্গ নয়, জীবনের বাস্তবতা ও সংগ্রামের অংশ। যার মাঝে মিশে আছে দেশপ্রেম। আল মাহমুদ ছিলেন ভাষা আন্দোলনের কবি এবং পরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-চেতনাকে ধারণ করেন।

দেশপ্রেম তাঁর কবিতায় সরাসরি স্লোগান নয়, বরং অনুভূতির গভীরতায় মিশে থাকে। তিনি দেশকে ভালোবাসেন তার মানুষের দুঃখ, কৃষকের ঘাম, নদীর পলিমাটি ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায়। যেমন : ‘এই মাটি আমার বুকের ভিতর ধরা / এই দেশের জোয়ার আমার রক্তে বয়ে চলে।’ এরপর আসে সমাজচিত্র: তাঁর কবিতায় সাধারণ মানুষের জীবন, শোষণ, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা, এবং রাজনৈতিক অবস্থান ফুটে ওঠে। সমাজের নিচুতলার মানুষ, মেহনতি জনতা, গ্রামবাংলার হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে গভীরভাবে। কখনো তিনি বিদ্রোহ করেন, কখনো অভিশাপ দেন, আবার কখনো মৌন থেকে সমালোচনা করেন সমাজব্যবস্থাকে। তাঁর ভাষা সরল অথচ তীক্ষè ও দৃঢ় যেমন -‘যে সমাজে শ্রমিকের রক্ত সস্তা, সে সমাজে ভালোবাসা মরিচিকা।’

‘পানকৌড়ির রক্ত’ অমর রচনা। এখানে কাব্যিক অনুভব নয়, বরং একটি দার্শনিক, প্রতীকী এবং সাহিত্যিক প্রস্তাবনা। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় -প্রকৃতি ও জীবনের প্রতিটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সাহিত্য। প্রতিটি নিঃশব্দ যন্ত্রণা, প্রতিটি হারিয়ে যাওয়া প্রাণ -সাহিত্যের ভাষায় অমর হয়ে বাঁচে। সাহিত্য একমাত্র ভাষা যা পানকৌড়ির নিঃশব্দ মৃত্যুতেও সৌন্দর্য খুঁজে পায়। সেই সৌন্দর্য সময়কে ছাপিয়ে যায়, মৃত্যুকে অতিক্রম করে এবং রয়ে যায় আমাদের চেতনায়, হৃদয়ে চিরন্তন, অমর। পানকৌড়ির রক্ত, মানবিক চেতনায় সূর্যের মতোই প্রখর ও দীপ্তিময় আর পুরোধা। যার অন্তরে মিশে আছে সমাজের বিচিত্র ও বর্ণিল রূপ। কবি আল মাহমুদ কাব্যিক স্বতন্ত্রতায় অনন্য শক্তি যা পানকৌড়ির রক্তে মিশে বাংলা কাব্যধারার অমরত্ব লাভ করেছে।