পাবনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আপডেট: আগস্ট ১১, ২০১৭, ১২:৪৬ পূর্বাহ্ণ

হাবিবুর রহমান স্বপন


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাবনা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতি নদী পথে শিলাইদহ থেকে শাহজাদপুরে যাতায়াত করতেন। চলার পথে নৌকা থেকে তিনি এই জনপদের মানুষের কর্মকা- অবলোকন করতেন। এমনই একটি দিনের বর্ণনা তিনি চিঠিতে লিখেছেন।
“সন্ধ্যাবেলায় পাবনা শহরের একটি খেয়াঘাটের কাছে বোট বাঁধা গেল। ওপার থেকে জনাকতক লোক বাঁয়া তবলার সঙ্গে গান গাচ্ছে, ভিন্ন রাস্তা দিয়ে স্ত্রী-পুরুষ যারা চলেছে, তাদের ব্যস্ত ভাব… গাছপালার ভিতর দিয়ে দীপালোকিত কোঠা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, খেয়াঘাটে নানা শ্রেণীর লোকের ভিড়।
… বৃহৎ জনতার ভালমন্দ, সমস্ত সুখ দুঃখ এক হয়ে তরুলতাবেষ্টিত ক্ষুদ্র বর্ষা নদীর দুই তীর থেকে একটি সকরুণ সুন্দর সুগভীর রাগিনীর মতো আমার হৃদয়ে এসে প্রবেশ করতে লাগলো। আমার ‘শৈশব সন্ধ্যা’ কবিতায় বোধ হয় কতকটা এই ভাব প্রকাশ করতে চেয়েছিলুম।”
-(ছিন্নপত্র, জুলাই ১৮৯৪।)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ১৫৭ তম জন্মজয়ন্তীতে অর্ঘ্য নিবেদনের প্রয়াস আজ বিশ্বব্যাপী বাঙালি মননে-সমাজে। যুক্ত বাঙলা ও নিখিল বিশ্বের বাংলা ভাষা-ভাষি অধ্যুষিত অঞ্চলে-জনপদে। রবীন্দ্রনাথ আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের প্রান্ত থেকে প্রান্তরে-পদস্পর্শ দেননি সত্য। এও সত্য যে আমাদের পুণ্যভূমি পাবনার মাটি তাঁর পদচারণায় ধন্য হয়েছে। পাবনা অঞ্চলের জল-বায়ু, মানুষ-জনপদ কবি মনকে নাড়া দিয়েছে নানা কারণে।
জমিদারি তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শনে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর পাবনা জনপদে বহুবার পরিভ্রমণ করেছেন। তবে পাবনা শহরে অনুষ্ঠিত অন্ততঃ দু’টি অনুষ্ঠান মঞ্চের মধ্যমণি হ’তে তাঁকে পাবনায় আসতে হয়েছে, এ সন্দেশ আজ বিস্মৃত-সত্য। প্রথমতঃ ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে পাবনায় অনুুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মিলনী। যেখানে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিতীয়তঃ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ৭ম উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। ‘নোবেল প্রাইজ’ প্রাপ্তি উপলক্ষে যে সম্মেলনে কলকাতার বাইরে প্রথম রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধিত করা হয়। সেটিও এই পাবনায়!
(প্রাদেশিক সম্মিলনী, ১৯০৮)।
কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মিলনীর স্থান নির্ধারিত হয় পাবনা। তারিখটি ছিল ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে সম্মিলনী অনুষ্ঠিত হয় সুরাটে। কংগ্রেসের নরম ও চরমপন্থাদের বিবাদ-বিসম্বাদে বিষম গোলযোগ হয় সুরাটে। এ তিক্ত অভিজ্ঞতাকে স্মরণে রেখে অপেক্ষাকৃত ‘নিরপেক্ষ ব্যক্তি’কে সভাপতি নির্বাচন ও সম্মিলনী সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবার উদ্দেশ্যে নানা কর্মপন্থা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যথারীতি সম্মিলনী অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। চাটমোহরের হরিপুরের চৌধুরী বংশের কৃতী সন্তান আশুতোষ চৌধুরী ও যোগেশচন্দ্র চৌধুরী যথাক্রমে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন। এঁরা পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’কে সভাপতি হিসাবে স্থির করেন। যোগেশচন্দ্র চৌধুরী (১৮৬৪-১৯৫১) শিলাইদহে যান এবং সভাপতিত্ব গ্রহণের জন্য কবিকে আমন্ত্রণ জানান। বন্ধু’র কথা ফেলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সম্মতি পাওয়ার পরে, ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ৪ঠা মাঘে, কংগ্রেসের এ সম্পর্কিত এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। পাবনার জমিদার শ্রীজ্ঞানদা গোবিন্দ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কংগ্রেস নেতা শ্রীকালাচরণ সেন আসন্ন সম্মিলনীর সভাপতি হিসাবে কবি রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাবের সমর্থন ও অনুমোদন করেন যথাক্রমে গোপালচন্দ্র সাহা ও প্রমদা গোবিন্দ চৌধুরী। এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন ৪৫ জন নেতা। ৪ জন নেতা ভোট দানে বিরত থাকেন। এভাবেই সর্বসম্মতিক্রমে পাবনায় অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিক সম্মিলনীর সভাপতি নির্বাচিত হন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
যদিও সর্বসম্মতিক্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারপরেও তার শান্তি ভঙ্গের নানা সবিস্তার কারণ ও উষ্মার বিবরণী তার বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠিপত্রে রয়ে গেছে। বিশেষ করে মনোরঞ্জন বন্দোপাধ্যায় ও রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর (১৮৬৪-১৯১৯) কাছে লেখা পত্রদ্বয়ে তার শঙ্কার ছবি অঙ্কিত রয়েছে। সমসাময়িককালের খবরের কাগজেও এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ নানা বাক্যজাল প্রকাশিত হয়েছিল। অবশেষে, পাবনার প্রাদেশিক সম্মিলন সফল ও সার্থকভাবেই অনুষ্ঠিত হয়।
পাবনায় আসবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তার ব্যক্তিগত বাহন পদ্মা বোটে চড়ে শিলাইদহ ত্যাগ করেন এবং ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে পাবনায় এসে পৌঁছান। সকালের জল খাবার সম্পন্ন করে কয়েকজন কংগ্রেস নেতার সাথে কথাবার্তা বলেন। পরে দুপুরের আহারের পর সামান্য বিশ্রাম শেষে সম্মিলন স্থলে পৌঁছান। সম্মিলন স্থানটি ছিল পাবনা শহরের কেন্দ্রস্থলে টমসন টাউন হল সংলগ্ন পেছনের মাঠ (উক্ত স্থানেই পরে বনমালী ইন্সস্টিটিউট নির্মিত হয়)। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৮-১৯২৫) প্রমুখ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তাকে সভাস্থলে নিয়ে পৌঁছুলে উপস্থিত প্রায় ছয় হাজার প্রতিনিধি ও জনতা হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁদের স্বাগত জানান। সুরাট অভিজ্ঞতার কারণে নিরাপত্তার জন্য ছিল বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি। সম্মিলনীর শুরুতেই অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী স্বাগত ভাষণ দেন। এরপর ব্যারিস্টার আবদার রসুল সভাপতিত্ব করবার জন্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সমর্থন করেন শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০) ও শ্রীমতিলাল ঘোষ (১৮৪৭-১৯২২)। শ্রীভূপেন্দ্রনাথ ১৯২৪) তা’ অনুমোদন করেন। অতীতের প্রথা ভেঙে সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলায় তাঁর ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণের পরপরই প্রথম দিনের অধিবেশন সমাপ্ত হয়। ওই দিনই সন্ধ্যায় বিষয় নির্বাচনী কমিটির বৈঠকে অনুষ্ঠিত হয়। মধ্যরাত অতিক্রম করলে বৈঠক পরদিনের জন্য মুলতবি রাখা হয়। পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি সকালে মুলতবি বৈঠক নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ দিন অধিবেশন শুরু হয় দুপুর দু’টায়। অধিবেশনে স্বদেশি জাতীয় শিক্ষা, বঙ্গভঙ্গ, সালিশি, ধর্মগোলা, ট্রান্সভালে ভারতীয় নির্যাতন, বিচারক ও পুলিশ, পথকর, কার্যকরি সমিতি, কেন্দ্রীয় সমিতি, নমঃ শূদ্র্র, শরীর চর্চা, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, পরবর্তী সম্মিলন, শোক জ্ঞাপন, রাজনৈতিক নিপীড়িতদের সাহায্য ও স্বরাজ বিষয়ে আলোচনা হয়। ‘স্বরাজ’ বাদে প্রায় সবগুলি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
উক্ত অধিবেশনে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ জাতীয় শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বেচারাম লাহিড়ী তা’ সমর্থন করেন। ধন্যবাদ প্রস্তাব উত্থাপন করেন ডা. প্রাণকৃষ্ণ আচার্য্য। সিরাজগঞ্জের কৈলাস চন্দ্র বসু তা’ সমর্থন করেন। পরে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সভাপতির সংক্ষিপ্ত ভাষণ দানের পর সম্মিলনীর সমাপ্তি ঘটে। মূল অধিবেশনের পরদিন সকালে প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় শিল্প সম্মিলনী। সম্মিলন শেষ করে রবীন্দ্রনাথ ইছামতি নদী থেকে পদ্মা হয়ে শিলাইদহে ফিরে যান।
প্রাদেশিক সম্মিলনীর উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বভাব সুলভ সুললিত কণ্ঠে যে ভাষণ দান করেন, তার সারাংশ এমন :
“গ্রামের মধ্যে চেষ্টার কোন লক্ষণ নাই। জলাশয় পূর্বে ছিল। আজ তাহা বুজিয়া আসিতেছে। কেননা দেশের স্বাভাবিক কাজ বন্ধ। যে গোচারণের মাঠ ছিল তাহা রক্ষণের কোন উপায় নাই; যে দেবালয় ছিল তাহা সংস্কারের কোন শক্তি নাই; যে সকল প-িত সমাজের বন্ধন ছিলেন তাহাদের গ-মূর্খ ছেলেরা আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যবসায় ধরিয়াছে। যে সকল ধনীগৃহে ক্রিয়া-কর্মে যাত্রায়, গানে সাহিত্য রস ও ধর্মের চর্চা হইত, তাহারা সকলেই শহরে আকৃষ্ট হইয়াছে। যাহারা দুর্বলের সহায়, শরণাগতের আশ্রয় ও দুষ্কৃতকারীর ‘দ-দাতা’ ছিলেন তাহাদের স্থান পুলিশের দারোগা আজ কিরূপভাবে পূরণ করিতেছে তাহা কাহারও অগোচর নাই। লোকহিতের কোনো কোনো বিধি নিষেধের শক্তি ভিতর হইতে কাজ করিতেছে না। আইনে যে কৃত্রিম বাঁধ দিতে পারে তাহাই আছে মাত্র। পরস্পরের বিরুদ্ধে মিথ্যা মকদ্দমায় গ্রাম উন্মাদের মতো নিজের নখে নিজেকে ছিন্ন করিতেছে। তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিবার কেহ নাই। জঙ্গল বাড়িয়া উঠিতেছে, ম্যালেরিয়া নিদারুণ হইতেছে, দুর্ভিক্ষ ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছে। আকাল পড়িলে পরবর্তী ফসল পর্যন্ত ক্ষুধা মিটাইয়া বাঁচিবে এমন সঞ্চয় নাই, ডাকাত অথবা পুলিশ চুরি অথবা চুরি তদন্তের জন্য ঘরে ঢুকিলে ক্ষতি ও অপমান হইতে আপনার গৃহকে বাঁচাইবে এমন পরস্পর ঐক্যমূলক সাহস নাই। তাহার পর যা খাইয়া শরীরে বল পায় ও ব্যাধিকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারে তাহার কি অবস্থা! ঘি দুষিত, দুগ্ধ দুর্মূল্য, মৎস্য দুর্লভ, তৈল বিষাক্ত। যে কয়টা দেশী ব্যাধি ছিল তাহারা তাহাদের যকৃৎ প্লীহার উপরে সিংহাসন পাতিয়া বসিয়াছে। তাহার উপর বিদেশী ব্যাধিগুলো অতিথির মত আসে এবং কুটুম্বের মত রহিয়া যায়। ডিপথিরিয়া, রাজ যক্ষ্মা, টাইফয়েড সকলেই এই রক্তহীনদের প্রতি এক্সপ্লয়টেশন নীতি অবলম্বন করিয়াছে। অন্ন নাই, স্বাস্থ্য নাই, আনন্দ নাই, ভরসা নাই, পরস্পরের সহযোগিতা নাই; আঘাত উপস্থিত হইলে মাথা পাতিয়া লই, মৃত্যু উপস্থিত হইলে নিশ্চেষ্ট হইয়া মরি, অবিচার উপস্থিত হইলে নিজের অদৃষ্টকেই দোষী করি এবং আত্মীয়ের বিপদ উপস্থিত হইলে দৈবের উপর তাহার ভার সমর্úণ করিয়া বসিয়া থাকি।”
মূলতঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাদেশিক সম্মিলনীতে চিরায়ত বাংলার পল্লী সমাজের  ভিতর-বাইরের জীর্ণদশার কথা অনায়াস অভিজ্ঞতার আলোয় নিপুণভাবেই তাঁর ভাষণে তুলে ধরেন। এই জীবন রুদ্ধকর অবস্থার অবসান উত্তরণের পথ নির্দেশও দান করেন। মানুষের প্রতি সচেতন অবলোকন, সমাজ নিরীক্ষণ এবং সর্বোপরি মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও ভালবাসা থেকেই তাঁর এই পথ নির্দেশনা। বাস্তবতা এই যে, আমরা তাঁর পরামর্শ ও উপদেশ এবং আহ্বান ও করণীয় কাজে বাস্তবায়ন করিনি। সময়ের হিসাবে একশ’ নয় বছর গত হলেও- সমস্যা সমূহ যেখানে ছিল এখনো সেখানেই রয়েছে, কোন কোন ক্ষেত্রে তা  আরও বহুগুনে বেড়েছে।
পাবনা সম্মিলনীর ঠিক ছয় বছর পরে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের শুরুতেই পাবনায় অনুষ্ঠিত হয় ‘উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’র ৭ম অধিবেশন। ইতোমধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম ভারতীয়ই শুধু নয় প্রথম এশীয় নাগরিক যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। মহানগর কলকাতার বাইরে একটা বড় ধরনের গুণীজন সমাবেশ সংগঠনের উদ্যোক্তারা যথার্থই পাবনা’র পাশের শিলাইদহে’র রবীন্দ্রনাথকে নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তি উপলক্ষে সংবর্ধনা দান করবেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না। কারণ এই জনপদের শিলাইদহে বসেই  তিনি গীতাঞ্জলি’র সিংহভাগ কবিতা রচনা করেন এবং অনুবাদ করেন।
সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় পাবনার জজ আদালতের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের গোপালচন্দ্র লাহিড়ী ইন্সস্টিটিউট প্রাঙ্গণে। এ সম্মেলনটিও যথারীতি দু’দিনের কর্মসূচি ঘিরে আবর্তিত হত। নৌপথে পাবনা শহরে যাতায়াত করা ছিল সে সময়ে সুবিধাজনক। ঈশ্বরদীর সাড়াঘাট থেকে বাজিতপুর ঘাট পর্যন্ত ছিল ইস্টিমার যোগাযোগ। এছাড়া নৌকা ছিল সার্বক্ষণিক বাহন। আর দামুকদিয়া থেকে ট্রেনে কলকাতা। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, রায়গঞ্জ, গৌহাটি প্রভৃতি স্থানের প্রতিনিধি-অতিথিরা সাড়ার রেলওয়ে স্টেশনে নেমে ইস্টিমার ও বজরা যোগে পাবনার বাজিতপুর ঘাটে নেমে টমটমে চড়ে এসেছিলেন সম্মেলন স্থলে। সে সময়ে যথারীতি এ জনপদে মশার দাপট ছিল বর্ণনাতীত এবং তার আগের বছরের তুলনায় এ বছরে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুবরণ করেছিল আট হাজারেরও বেশি মানুষ।
দু’দিনব্যাপি সাহিত্য সম্মেলনের কর্মসূচি বিন্যস্ত হয়েছিল যে ভাবে। প্রথম দিন দুপুর দুটোয় সম্মেলনের উদ্বোধন। অভ্যর্থনা পরিষদের সভাপতির স্বাগত ভাষণ, সম্পাদকের প্রতিবেদন উপস্থাপন, সমাপ্তি। রাতে গম্ভীরার আসর। সাথে বিষয় নির্বাচন পরিষদের সভা। দ্বিতীয় দিন সকালে অধিবেশন শুরু। সম্মেলন সম্পর্কে আলোচনা, স্থানীয় ইতিহাস প্রসঙ্গ, নানা প্রসঙ্গ, প্রবন্ধ উপস্থাপন এবং সব শেষে কবিগুরুর ভাষণ ও সভাপতির সমাপ্তি ঘোষণা, ধন্যবাদ প্রস্তাব ইত্যাদি।
পাবনা সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন নাটোরে মহারাজা শ্রীযুক্ত জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮-১৯২৬)। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী (১৮৬০-১৯২৪)। মূল আকর্ষণ তথা প্রধান অতিথি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। ‘মানসী’ পত্রিকার ৬ষ্ঠ বর্ষ ২য় সংখ্যা অর্থাৎ ১৩২০ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় পাবনা সম্মেলনের বিস্তারিত বিষয়াদি প্রকাশিত হয়। মানসী’র ১৬১-১৬৬ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয় অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণ
‘মহারাজ ও সমাগত বন্ধুবর্গ,
দরিদ্র পাবনার নিমন্ত্রণে আপনারা এখানে আসিয়াছেন- ইহা আপনাদের অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহের জন্য পাবনা-অভ্যর্থনা সমিতির পক্ষ হতে আপনাদিগকে ধন্যবাদ করিতেছি। পাবনায় যাতায়াত কষ্টসাধ্য এবং আমরা আপনাদিগের সমুচিত অভ্যর্থনা করিতে অশক্ত। নিজ গুণে আমাদিগের বহু ত্রুটি মাপ করিবেন আশা করি।’
এই স্বাগত ভাষণের পূর্বে পাবনার উকিল শ্রীদীননাথ বিশ্বাসের বিদুষী কথা শ্রীমতি প্রভাবতী দেবী বিরচিত ‘এস জননী’ গান গীত হয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। বাºেবীর আবাহন পর্ব শেষে সংস্কৃত মঙ্গলাচরণ পালায় সারস্বত বন্দনা করেন দিনাজপুরের উকিল শ্রীযুক্ত বরদাকান্ত রায়। স্ত্রোস্ত নিবেদনের পর প্রভাবতী দেবীর লেখা ‘ফুলের গান’ কবিতাটি তিনটি বালিকা আবৃত্তি করে।
রাজশাহীর খ্যাত ঐতিহাসিক শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় নাটোরের তহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের সাহিত্য চর্চা, সাহিত্য প্রীতি ও গুণাবলির উল্লেখ করে সম্মেলনের সভাপতিত্ব করবার জন্য প্রস্তাব করেন ও যথারীতি তা’ সমর্থিত হলে মহারাজ সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। গৌহাটির দেবেন্দ্রনাথ মহিন্ত সভাপতির অভ্যর্থনাসূচক একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। সভাপতি মহোদয় তাঁর ভাষণ দানকালে সম্মেলন স্থানে বিস্ময়াবিষ্ট মোহের সৃষ্টি করে। পরে স্থায়ী সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী কামরূপ অনুসন্ধান সমিতির সুদীর্ঘ কার্য বিবরণী উপস্থাপন করেন। পরে পাবনার সাপ্তাহিক সুরাজ পত্রিকার সম্পাদক কিশোরী মোহন রায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তি উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশ করিবার প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন এবং অধ্যাপক শ্রীযুক্ত পঞ্চানন নিয়োগী মহাশয় তাহা সমর্থন করিলেন।”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর পরই আনন্দ প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে দেয়া ভাষণটি মানসী’র ৬ষ্ঠ বর্ষ ৩য় সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৩২৫-৩২৬-এ মুদ্রিত হয়। তিনি বলেন : ‘এই অভিনন্দনের ভয়েই আমি এই সভায় আসিতে চাই নাই। এখানকার সভাপতিকে আমার বন্ধু হিসাবেই জানি, সেই জন্যেই আশা ছিল তাঁহার আড়ালে আশ্রয় পাইব, কিন্তু অভাগা যদ্যপি চায় সাগর শুকায়ে যায়। সভা সমিতিতে সকলের সঙ্গে মিলিয়া সকলের মাঝখানে আসনটি লইয়া বসিব, এই আরামটি হইতে বিধাতা আমাকে বঞ্চিত করিয়াছেন; আমাকে সর্ব সাধারণের বেষ্টন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া স্বতন্ত্র বসাইয়া রাখিবার যে বিধান হইয়াছে ইহাতে আমি দুঃখ ও লজ্জা পাইয়া থাকি। কোথাও যে নিঃশব্দে এবং নিরালায় একটু স্থান পাইব, এই অধিকারটুকু খোয়াইয়া বসিয়াছি।
বিলাতে রাস্তার দুষ্টু বালকেরা কৌতুক কবিরার জন্য কুকুরের ল্যাজে ঝুমঝুমি বাঁধিয়া ছাড়িয়া দেয়। সে যেখানেই চলে, শব্দ হয় এবং তাহার পিছনে ভিড় জমিতে থাকে। আমার নামের পেছনে সেই রকমের একটা ঝুমঝুমি বাঁধা হইয়াছে, চলিতে গেলেই শব্দ হয় এবং লোকের দৃষ্টি পড়ে। প্রকাশ্যে চলা এক রকম বন্ধ করিয়াছি।
আমার ভাগ্যদেবতা আমার একগালে চুন ও অন্যগালে ভুষার কালী মাখাইয়া স্তুতি নিন্দার সং সাজাইয়াছেন। তাঁহার এই কৌতুকে যোগ দিতে আমার কোন উৎসাহ নাই। ইহাতে আমাকে ক্লিষ্ট করিয়াছে। আমি বরাবর যে কোনটাতে পড়িয়া আপনার কাজ করিয়া আসিয়াছি কোনো খ্যাতি মূল্যেই সেটা বিকাইতে আমার প্রলোভন হয় না। গান করাই আমার ব্যবসা। যে বাঁশিতে সুর বাজে সেটা সরু হইয়াই থাকে, তাহাকে পিপার মত প্রকা- করিয়া তুলিলে অন্য যে কাজেই লাগুক, গানের সুবিধা হয় না। অত্যন্ত প্রশস্ত স্থান আমার নহে।
যাহোক বিলাপ করিবার এ আসর নয়, অতএব দুঃখের কথা আর বেশি বলিব না। আপনাদের সকলের কাছে আমার যে কৃতজ্ঞতা জানাইবার আছে তাহা নিবেদন করিবার এই যে সুযোগ পাইয়াছি তাহা নষ্ট করিব না। আমার ভাগ্যক্রমে সমুদ্রপার হইতে সম্মান লাভ করিয়াছি। সেই সম্মান প্রচুর এবং তাহার ভার সামান্য নয়। আমার সৌভাগ্য এই, আমার দেশের লোক এই সম্মানকে আপন বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন- ইহা স্বদেশের সকলের সঙ্গে ভাগ করিয়া ভোগ করিতেছি তাহাতেই এই গুরু সম্মানকে আমার আপন স্বদেশ আপন সম্মান বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন, আমার পক্ষে এমন পুরস্কার আর কিছুই হইতে পারে না। বিদেশের সম্মানকে আমার স্বদেশ নিজের হাতে লইয়া তাহাকে আপন প্রসাদে অভিষিক্ত করিয়া আমার হাতে অর্পণ করিলেন, ইহাই আমি তাঁহার আশীর্বাদ বলিয়া শিরোধার্য্য করিয়া লইলাম।”
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের উদ্বোধনী অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। সম্মেলন সভাপতি সমাপ্তির ঘোষণায় জানিয়ে দেন যে, সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে সম্মেলন স্থলে বিষয় নির্বাচন সমিতির গঠন এবং অধিবেশন বসবে। এর সাথে সাথে মালদহ থেকে আসা গম্ভীরা শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনাও চলবে।
পাবনায় অনুষ্ঠিত উত্তরবঙ্গ  সাহিত্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন শুরু হয় সকাল ৮ টা ৫০ মিনিটে। পাবনার কবি রজনীকান্ত সেনের : ‘তব  চরণ নিম্নে উৎসবময়ী শ্যামবরণী সরসা’ গানটি গাওয়ার মধ্য দিয়ে অধিবেশন শুরু হয়। শুরুতেই সাপ্তাহিক সুরাজ সম্পাদক কিশোরী মোহন রায় ‘আমাদের সাহিত্য সম্মেলন’ নামে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় পাবনার বিখ্যাত জমিদার আজিম চৌধুরী সম্পর্কে কিছু বলেন এবং প্রাচীন ঐতিহাসিক চিত্র থেকে কিছু পাঠ করে শোনান।
ইতিপূর্বে উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে যা ঘটেনি, পাবনা সম্মেলনে ঠিক সেটাই ঘটে। শ্রীযুক্তা সুখদা দেবী বিরচিত ‘পল্লী গঠন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রথম নারীর লেখা হিসাবে সম্মেলনে উপস্থাপন করেন পূর্ণচন্দ্র রায়। সম্মেলনের সাত বছরের ইতিহাসে সেটাই ছিল ব্যতিক্রম। পাবনা কলেজের অধ্যাপক হেমচন্দ্র রায় “বঙ্গ সাহিত্যের অনুশীলনের পক্ষে সংস্কৃত শিক্ষার অপরিহার্যতা” শীর্ষক সন্দর্ভ পাঠ করেন। সতীশচন্দ্র রায় এমএ শিবানন্দ দাসকৃত ‘পদরসসার’ নামক নতুন পদাবলী সংগ্রহ গ্রন্থের পরিচয় দেন ও তা থেকে কিছু কিছু অংশ পাঠ করেন। এ সময়ে পরিষদের সহকারি সম্পাদক ব্যোমকেশ মুস্তফী সতীশ বাবুর নব আবিস্কৃত গ্রন্থ পরিষদ থেকে প্রকাশের ঘোষণা দেন।
এ পর্যায়ে ঐতিহাসিক প্রবন্ধাদির উপস্থাপন শুরু হয়। ‘ছাতক’ নামীয় প্রবন্ধটির পরে পাবনার উকিল রাধারমণ সাহা ‘পাবনার ইতিহাসের এক পৃষ্ঠা’ পাঠ করে শোনান। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির অন্যতম কর্ণধার রাজশাহী কলেজের অধ্যাপক রাধাগোবিন্দ বসাক, এমএ ‘মগধ রাজ দর্শক’ শীর্ষক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ উপস্থাপন করবার পর উমেশচন্দ্র চৌধুরীর ‘আর্য্যজাতির আদি নিবাস’ প্রবন্ধটি পাঠ করা হয়। পরবর্তীতে ‘ভারতে মূর্ত্তি পূজার আদি যুগ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন নলিনীকান্ত ভট্টশালী। এই প্রবন্ধ উপস্থাপনের পরপরই বেলা দু’টা পর্যন্ত বিরতি দেয়া হয়।
দিনাজপুরের উকিল বরদাকান্ত রায়ের সুদীর্ঘ স্ত্রোত্র পাঠের মধ্য দিয়ে মধ্যাহ্নের শেষ অধিবেশন শুরু হয়। এর আগে প্রতিনিধিদের সকলকে দুপুরের খাবারের সঙ্গে পাবনার দধি ও প্যারা সন্দেশ পরিবেশন করা হয়। দুপুরের আহারের পর নিদ্রার উদ্রেক হয় থকন চলে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধাবলী পাঠ। রংপুরের ডাক্তার নলিনীকান্ত বসু ‘বায়ু ও জীবাণু’ শীর্ষক ও তারিণী মোহন রায় ‘রসায়ন ও জাতীয় উন্নতি’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এর পর প-িত নলিনী রঞ্জন পাবনার কবি রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০) এর ‘রোজনামচা’ থেকে পাঠ করলে সভাস্থলে বিয়োগ বিধুর পরিবেশের সৃষ্টি হওয়ায় কবির স্মৃতি রক্ষার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে ইতিবাচক সাড়া মেলে। পাঁচকড়ি বাবু’র বক্তৃতা দানের পর কালিকান্ত বিশ্বাসের প্রেরিত প্রবন্ধ সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করে বক্তব্য দেন রমা প্রসাদ চন্দ।
অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়’র আহ্বানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য সম্মেলনে বলেন :
‘নদীর প্রবাহ যেমন কাহারও উপদেশের অপেক্ষা না রাখিয়াই নূতন নূতন প্রদেশে আপনার পথ কাটিয়া আপনার বেগে প্রবাহিত হইয়া যায়, সাহিত্যের গতিও ঠিক সেইরূপ। ভগীরথ শঙ্খ বাজাইতে বাজাইতে সঙ্গে যাইবে, ভাগীরথী আপনার গতিতে আপনিই প্রবাহিত হইবে। এই বিষয়ে কর্তব্য কার্য্য একমাত্র এই যে, ভগীরথের শঙ্খ যেন কখনও না থামে। মৃত্তিকার অভ্যন্তর বাহিনী সলিল ধারা যেমন আপনা হইতেই বিশাল মরুভূমির স্থানে স্থানে উৎসরূপে ফুটিয়া উঠিয়া বিচিত্র মরুদ্যান সৃষ্টি করে, আমাদের সাহিত্য সম্মিলন গুলিও ঠিক তেমনি। দেশের অন্তস্থলে চিরপ্রবহমানা সাহিত্য রসধারা এ গুলির বহিঃ প্রকাশ মাত্র। সাহিত্য সম্মিলন গুলি যেন মেঘ, দেশে দেশে ঘুরিয়া বারিধারা বর্ষণ করিয়া বেড়ায়, দেশ ফুলে ফলে হাসিয়া ওঠে। এবার তাহা পাবনায় বর্ষিল, যদি ফুল ফল না হয় তবে পাবনার মরুভূমিই প্রমাণিত হইবে। বর্ষা যেমন বৎসর বৎসর আসিয়া দেশের মাটিকে সজীব, উর্বর করিয়া দিয়া যায়, সাহিত্য সম্মিলনের কার্য্যও তেমনি। আমরা অপথে বিপথে অনেক ঘুরিয়াছি, অনেক অলিগলি ভ্রমণ করিয়াছি যে, কতদূর যাইয়া আর যাওয়া যায় না, সম্মুখে এক বিভীষিকাময় অন্ধকার দেখা যায়। কিন্তু এই সাহিত্যের সদর রাস্তার পথ উন্মুক্ত-সম্মুখে আশার ক্ষেত্র দেখা যাইতেছে। আমাদের অবহেলায় আমাদের ক্ষুদ্র হিংসা দ্বেষে তাহা যদি রুদ্ধ হইয়া যায়, তবে আমাদের আর কোন আশা নেই।”
সভাপতি নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় পরবর্তী সম্মেলন নাটোরে আহ্বান করেন এবং বিষয় ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে আসন গ্রহণ করেন। ধন্যবাদ প্রতি ধন্যবাদের পালায় ভারতী সম্পাদক জলধর সেন, পাঁচকড়ি বাবু ও পাবনার উকিল সীতানাথ অধিকারী সম্মিলনের শেষার্ধে উপস্থিত হন।  কালিদাস রায় অপূর্ব একটি গানের মধ্য দিয়ে সম্মিলনের সমাপ্তি হয়।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পাবনায় উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে দেশের বিদগ্ধ সাহিত্যিক, সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্বের সমাবেশ ঘটেছিল নিঃসন্দেহে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নাটোর মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়, বিচারপতি আশুতোষ চৌধুরী, ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সু সাহিত্যিক জলধর সেন, পাবনার উকিল রাধারমণ সাহা, উকিল দীননাথ বিশ্বাস, কান্ত কবির জীবনীকার প-িত নলিনী রঞ্জন, সাহিত্যিক গুরুসদয় দত্ত, আই সি এস, পাবনা ইনস্টিটিউশনের প্রতিষ্ঠাতা গোপালচন্দ্র লাহিড়ী, ভারেঙ্গার জমিদার ও পাবনার সরকারি উকিল প্রসন্ন নারায়ণ চৌধুরী, কলকাতা হাইকোর্টের উকিল, সাঁথিযার তলটের জমিদার ও আরতি পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক শশধর রায়, এমএ, শিতলাইয়ের জমিদার যোগেন্দ্রনাথ মৈত্রেয়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহকারি সম্পাদক ব্যোমকেশ মুস্তফী, পাবনার সাপ্তাহিক সুরাজ পত্রিকার সম্পাদক কিশোরী মোহন রায়, সতীশ চন্দ্র রায় এমএ, অধ্যাপক হেমচন্দ্র রায়, অধ্যাপক পঞ্চানন নিয়োগী, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, দিনাজপুরের উকিল বরদাকান্ত রায়, দেবেন্দ্রনাথ মহন্ত, স্থায়ী সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, অধ্যাপক রাধাগোবিন্দ বসাক, উমেশচন্দ্র চৌধুরী, ডাক্তার নলিনীকান্ত বসু, তারিণী মোহন রায় প্রমুখ সম্মানিত অতিথিবৃন্দসহ আট আনা থেকে দু’টাকা মূল্যের প্রবেশপত্র কিনে প্রায় তিন হাজার নারী-পুরুষ অভ্যাগত দর্শক।
কবিগুরুসহ মান্যবর অতিথিবৃন্দ পাবনা কলেজের (এডওয়ার্ড কলেজ) নব প্রতিষ্ঠিত ভবন সমূহ পরিদর্শন করেন। আর সম্মেলনের প্রথম দিন ১০ ফাল্গুন শিতলাইয়ের জমিদার যোগেন্দ্রনাথ মৈত্রেয়র বাস ভবন শিতলাই হাউসে (বর্তমানে এডরুক লিমিটেড) আতিথ্য গ্রহণ করে কলকাতার হপসিং কোম্পানীর ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ফটো উঠিয়েছিলেন।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
যৎধযসধহ.ংধিঢ়ড়হ@মসধরষ.পড়স