শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪ কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক :
রাজধানীতে চলার পথে যেখানে সেখানে মলমূত্র পড়ে থাকা নিয়ে একসময় অতিষ্ঠ ছিলেন নাগরিকরা। ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে পাবলিক টয়লেট স্থাপনের মধ্য দিয়ে এর অনেকটাই সমাধান হয়েছে। ভাসমান মানুষ বা পথচারীদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মিটছে।
কিন্তু গত ৫ আগস্টের পরে কয়েকটি স্থানে ওই টয়লেটগুলো ভেঙে ফেলা হয়। টয়লেট দখলেরও চেষ্টা চলছে। নাগরিকদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য এমন স্থাপনা কেন ভেঙে ফেলা বা দখল করা হলো সেটি নিয়ে প্রশ্ন সাধারণ মানুষের।
স্থানীয় সরকার সিটি করপোরেশন আইনে বলা হয়েছে, করপোরেশন তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পুরুষ এবং নারীদের জন্য পর্যাপ্ত পৃথক পায়খানা ও প্রস্রাবখানা নির্মাণ এবং তা যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করবে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাবে, ঢাকায় মোট ১৩৩টি সচল পাবলিক টয়লেট রয়েছে।
এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬৩ এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭০টি। সিটি করপোরেশন মালিক হলেও এসব পাবলিক টয়লেটের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও।
রাজধানীতে ২৩টি পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইড। রাজধানীরগুলোসহ সারা দেশে মোট ৩৪টি পাবলিক টয়লেট পরিচালনা করছে এই সংস্থাটি। যার মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১২টি, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১১টি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৮টি এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশন, ঈশ্বরদী ও পঞ্চগড় রেলওয়ে স্টেশনে যথাক্রমে ১টি করে টয়লেট রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণে।
দুই শহরে টয়লেটে হামলা
ওয়াটারএইড কর্তৃপক্ষ বলছে, জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাদের বেশ কয়েকটি টয়লেটে হামলা এবং দখল হয়। হামলাকারীরা গেট ভেঙে টয়লেটে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর করে। তারা সব মূল্যবান মালামাল খুলে নিয়ে যায়। হামলার শিকার টয়লেটগুলোর মধ্যে আছে ঢাকার ৩টি––মোহাম্মদপুর পাবলিক টয়লেট, আজমপুর পাবলিক টয়লেট, মিরপুর-১২ পাবলিক টয়লেট। আর চট্টগ্রামে নাশকতার শিকার ৩টি হলো––অক্সিজেন মোড়, লালদিঘির পাড় এবং নতুন রাস্তা ব্রিজ সংলগ্ন পাবলিক টয়লেট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ওয়াটারএইডের দুটি পাবলিক টয়লেট ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। টয়লেট দুটো হলো– জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন মুক্তাঙ্গন পাবলিক টয়লেট এবং পীর ইয়ামেনি মার্কেট সংলগ্ন ওসমানী উদ্যান-১ পাবলিক টয়লেট। সংশ্লিষ্ট থানায় এ বিষয়ে জিডিও করা হয়েছে। এরইমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহায়তায় টয়লেট দুটি উদ্ধারের চেষ্টাও চালানো হচ্ছে।
পাবলিক টয়লেট ২
ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাবলিক টয়লেট দখল করার জন্য একটা গোষ্ঠী খুব তৎপর আছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন ওয়াটারএইড বাংলাদেশের প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর কে এ অমি। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, সারা দেশে আমাদের পাবলিক টয়লেটে হামলা ও ভাঙচুরের কারণে ৩৫ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। দ্রুত যদি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেয় তবে সাধারণ মানুষের জরুরি প্রয়োজনের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়বে। সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই এগুলো দখলমুক্ত করা জরুরি।
কী বলছে দখলদাররা
সোমবার (৭ অক্টোবর) মুক্তাঙ্গনের পাবলিক টয়লেটে গিয়ে দেখা যায় মো. ইব্রাহীম, মো. মহসিন ও মো. সেলিম নামের তিন যুবক মিলে নিজ উদ্যোগে এই টয়লেটটি পরিচালনা করছেন। জানতে চাইলে তারা বলেন, ৫ আগস্ট এটা ভেঙেচুরে রাখা হয়েছিল। আমরা এসে এটা দেখভাল করছি। তা না হলে মানসিক ভারসাম্যহীন লোকজন এসে এটা নোংরা করে রাখতো।
বর্তমানে পাবলিক টয়লেট ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে টাকা তুলে নিজেরাই খরচ চালিয়ে কিছু আয় করছেন জানিয়ে আরেকজন বলেন, টাকা তুলে টিস্যু, হ্যান্ডওয়াশ কিনি; পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেও মেথরকে টাকা দেই। আর প্রত্যেক দিন নিজেরা ৫০০ টাকা রাখি। এছাড়া পানির বিল-বিদ্যুৎ বিলও দেই।
এদিকে ওসমানী উদ্যান-১ পাবলিক টয়লেটের দায়িত্ব থাকা মো. রফিকুল বলেন, আমি এক মাস ধরে এখানে আছি। আমাকে মাসিক বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
কে নিয়োগ দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আমার পরিচিত একজনের মাধ্যমে এসেছি। কে এই টয়লেট চালায় জানি না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় কয়েকটি টয়লেট সরকারি সম্পত্তি মনে করে নিজেরাই ব্যবস্থাপনা নেওয়ার চেষ্টা করছেন কোনও কোনও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।
ভোগান্তিতে নগরবাসী
ভাঙা টয়লেটগুলো বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন পথচারীরা। বিশেষ করে নারীরা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন বেশি। মিরপুর ১২-এর কিছু নারী পথচারীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বর্তমানে নারীদের বাইরের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বেড়েছে। বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা থেকে শুরু করে সংসারের প্রায় সব কাজই এখন ভাগাভাগি করে করতে হয়।
পেশাগত কাজেও নারীকে বাইরে যেতে হয়। অথচ নগরীতে রাস্তায় চলাচলের সময় গণশৌচাগারের সুবিধা তারা পান না। যে দু-একটি জায়গায় ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেগুলোর ওপর কাদের ক্ষোভ––এই প্রশ্নও করেন তারা।
কেন পাবলিক টয়লেট ভাঙা হয়েছে প্রশ্ন রেখে নাসরিন জাহান নামে এক পথচারী বলেন, আমরা এখনও বুঝতে শিখিনি কোনটা জনগণের জন্য কল্যাণকর। রাগ ঝাড়লেই তো আর হবে না। এই টয়লেটগুলো পরিচ্ছন্ন, এগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালো। এটা সরকার করেছে নাকি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলছে সেটা আমার দেখার বিষয় না। নাগরিক হিসেবে আমি সুবিধাটা নিতে পারছি কিনা আমি সেটাই দেখতে চাই।
একটি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা বিলকিস আহমেদ বলেন, কাজের প্রয়োজনে প্রায়ই বাইরে যেতে হয়। অফিসের কাজ থেকে শুরু করে কেনাকাটা করতে গেলে বা সকালে হাঁটতে বের হলে আশপাশের পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। সঙ্গে ছোট শিশু থাকলে আরও দরকার হয়।
এই টয়লেটগুলো যথেষ্ট নারীবান্ধব মনে হয়। সেখানে নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এসব বন্ধ থাকায় সমস্যায় পড়তে হবে আমাদের।
সিটি করপোরেশন যা বলছে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান খান বলেন, পাবলিক টয়লেট ভাঙচুরের খবর আমরা পেয়েছি। এগুলো ব্যবস্থাপনায় ওয়াটারএইড রয়েছে। তারাই এগুলোর সংস্কার কাজ করবে। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে এই বিষয়ে।
দখল হওয়া দুই পাবলিক টয়লেটের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিষয়টি আমরা অবহিত আছি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শুধু পাবলিক টয়লেট না, পার্কিং স্পেস, বাজার নানা কিছু হাতবদলের ঘটনা ঘটেছে। দখল ও ভাঙচুরের ঘটনা জানার পরে আমরা তাদের থানায় অবহিত করতে বলেছিলাম।
সিটি করপোরেশনের দখল হওয়া জায়গা থেকে উচ্ছেদ করতে পারেন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে এনফোর্সমেন্টের জায়গায় আমরা প্রস্তুত না। আমাদের আগের ম্যাজিস্ট্রেটের জায়গায় নতুন কর্মকর্তা এসেছেন। কিন্তু তাকে এখনও অভিযানের পাওয়ার দিয়ে প্রজ্ঞাপন হয়নি বলে এটা করা যাচ্ছে না।
জিডি করার পরে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা জানতে পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন