রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
ওসমান গনি তালুকদার
…গত সংখ্যার পর
অস্ট্রেলিয়া এমন একটি দেশ যেটি প্রকৃত-অর্থে একটি দ্বীপ ও একই সঙ্গে একটি মহাদেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই দ্বীপ দেশটি মহাদেশ হিসেবে আবার সবচে ছোট। আমাদের দেশের তুলনায় অস্ট্রেলিয়ার মোট ভূমির ক্ষেত্রফল বা আয়তন প্রায় ৫৫ গুণ কিন্তু মোট জনসংখ্যা মাত্র আট ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ দুই কোটির সামান্য কিছু বেশি। এর মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ এবং আদিবাসীদের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ আছেন। আদিবাসীদের প্রায় সহ¯্রাধিক মুসলমানের মধ্যে অ্যান্থনি মানডিন (অহঃযড়হু গঁহফরহব) নামের একজন মিড্লওয়েট বক্সিং-এ পর পর দুইবার বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তাবলিগ জামাতের ইসলাম ধর্ম প্রচারের ফলে মাঝে-মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ার কিছু কিছু সাদা মানুষ ও আদিবাসীরা ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যাও এখানে একেবারে কম নয়। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি বলছেÑ অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করছেন। অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশুনা করতে আসা দুই-তিন হাজার শিক্ষার্থীসহ এ সংখ্যা বর্তমানে দ্বিগুণ হবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
অস্ট্রেলিয়া সাধারণত ক্যাঙ্গারুর দেশ হিসেবে পরিচিত। ক্যাঙ্গারুর ছবি জাতীয় প্রতীক হিসেবে চিত্রায়িত আছে তাদের কারেন্সি ডলারের নোটে এবং বেসামরিক বিমান ‘কোয়ান্টাস’-এ। ক্যাঙ্গারু নামকরণের কাহিনীটি বেশ মজার। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে একজন ব্রিটিশ নাবিক, ক্যাপটেন জেমস্ কুক, তাঁর জাহাজ নোঙর করেন অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান সিডনি শহরের পাশে অবস্থিত বোটানি-বে নামক স্থানে। সেখানে অবস্থানকালে ক্যাপ্টেন কুক একদিন জাহাজ থেকে নেমে আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিলেন। হঠাৎ মাঠে তিনি কিছু অদ্ভুত প্রাণী দেখতে পেলেন। ঐ রকম প্রাণী তিনি আগে কখনও দেখেননি। তাই এগিয়ে গিয়ে নিকটস্থ একজন আদিবাসীকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেনÑ তোমরা ঐ প্রাণীটিকে কি নামে ডাক? আদিবাসী লোকটি তো আর ইংরেজি বোঝেন না! বললেনÑ ক্যাঙ্গারু। মানে, ‘তোমার কথা বুঝতে পারিনি’। কিন্তু কুক মনে করলেন প্রাণীটির নাম ক্যাঙ্গারু। এরপর তাদের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ জানল অস্ট্রেলিয়ায় অদ্ভুত একটি প্রাণী আছে যার নাম ক্যাঙ্গারু। আর এভাবে অস্ট্রেলিয়া হয়ে উঠল ক্যাঙ্গারুর দেশ। তারপর একদিন ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি ১৩৫০ জনের একদল বৃটিশ স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে এল ‘বোটিানি-বে’Ñতে। সেই থেকে ২৬ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়া দিবস হিসেবে পালিত হয়।
অস্ট্রেলিয়ার জীববৈচিত্র্য সম্পূর্ণ আলাদা। তার কারণ, মহাদেশটি পৃথিবী অন্য দেশগুলো থেকে সমুদ্র দিয়ে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সে দেশের অনন্যসাধারণ অসংখ্য বিচিত্র প্রাণীর কয়েকটির কথা ইতোমধ্যে আমরা বলেছি। অন্য যে বিচিত্র প্রাণী আছে তার মধ্যে প্ল্যাটিপুসকে বিচিত্রতম বলতে হবে। পাখি জাতীয় প্রাণী ডিম পাড়ে আর স্তন্যপায়ী বাচ্চা প্রসব করে ও দুধ পান করায় এসব আমরা জানি। কিন্তু প্ল্যাটিপুস কিছুটা পাতিহাঁসের মত দেখতে প্ল্যাটিপুসের গায়ে পালকের পরিবর্তে লোম, আর সবচেয়ে যেটি মজার তা হল এটি ডিম পাড়ে কিন্তু স্তন্যপায়ী। পাখি এবং স্তন্যপায়ীর সংমিশ্রণ-বৈশিষ্ট্যের এটিই একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়, এ রকম আরও একটি আছে যার নাম একিড্না। তবে একিড্নার একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা মারসুপিয়ালও বটে। এদের গায়ে মোটা লোম এবং সজারুর মত কাঁটা আছে। শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে অথবা কোন কারণবশত ভয় পেলে আত্মরক্ষার্থে এরা কু-লি পাকিয়ে পড়ে থাকে। তখন চতুর্দিকে গায়ের কাঁটাগুলি খাড়া হয়ে যায় এবং শত্রুরা কোন ক্ষতি করতে পারে না। এরা সাধারণত পিঁপড়া এবং উঁইপোকা খেয়ে বেঁচে থাকে।
শুধু প্রাণী নয়, এখানকার উদ্ভিদকূলও বড় বৈচিত্র্যময়। ধরা যাক পাইন গাছের কথাÑ পৃথিবীতে এর যতগুলি প্রজাতি আছে তার প্রায় আশি ভাগ দেখা যায় এখানে। বসন্তে যে দিকেই তাকাবেন দেখতে পাবেন রঙ বেরঙের বিচিত্র বাহারি ফুল। গাছে ফুল, ঘাসে ফুল, বনে জঙ্গলে ফুল, এমনকি আগাছায়ও ফুল। চারদিকে শুধু ফুল আর ফুল। পুরো দেশটাই যেন হয়ে যায় ফুলের এক গালিচা। শুধু বন্য ফুল রপ্তানি করেই এ দেশ আয় করে কয়েকশ মিলিয়ন ডলার বা কয়েক হাজার কোটি টাকা।
একজন বাঙালি গবেষকের ধারণাÑ এখানকার আদিবাসীরা কোনভাবে কয়েক হাজার বছর আগে বর্তমান বাংলাদেশ থেকেই এসেছে। এর পিছনে তাঁর যুক্তিÑ এদের ভাষায় এমন কিছু শব্দ আছে যা বাংলা ভাষায় প্রায় একই অর্থে (সমার্থক) ব্যবহৃত হয়। যেমনÑএরা ‘আব’ শব্দটি ব্যবহার করে পানি বুঝাতে আর বাংলায় ‘আবহাওয়া’ শব্দটির ‘আব’ অংশ একই অর্থ বহন করে। বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় পারিবারিক উপাধি হচ্ছে ‘মিয়া’, এদেরও তাই। উভয় ক্ষেত্রেই শব্দটির ইংরেজি বানান একই অর্থাৎ গরধ। আবার কিছু কিছু প্রায় সমোচ্চারিত শব্দ আছে। যেমন- আদিবাসীদো অনুকরণে সিডনি শহরে দুটি স্থানের নাম ইংরেজিতে চধৎৎধসসধঃঃধ এবং চঁহপয ইড়ষি যা বাংলায় উচ্চারিত হতে পারে যথাক্রমে পরমাত্মা এবং পাঁচ বাউল। আর আমার চুল বড় হলেই জেসমিন (স্ত্রী) বলে আমাকে দেখতে নাকি এখানকার আদিবাসীদের মত লাগে। জানি না এটাও একটা প্রমাণ কি-না!
বুমেরাং (ইড়ড়সবৎধহম) শব্দটির সঙ্গে আমাদের কমবেশি পরিচয় আছে। এই শব্দটি বাংলা অভিধানেও স্থান করে নিয়েছে। আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রায়ই এই শব্দটি ব্যবহার করতে শোনা যায়। তাঁরা অবশ্য প্রতিপক্ষকে সতর্ক অথবা হুমকি দেওয়ার জন্য শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। বুমেরাং আসলে অস্ট্র্রেলিয়ার আদিবাসিদের ব্যবহৃত একধরনের অস্ত্র। অস্ত্রটির জ্যামিতিক আকার এমন যে, ছুঁড়ে মারলে এটি লক্ষ্যে আঘাত করে নিক্ষেপকের নিকট ফিরে আসে। আদিবাসীরা শিকারের উদ্দেশ্যে অস্ত্রটি ব্যবহার করত, এখনও করে কী না আমার জানা নেই।
প্রাচীন অস্ট্রেলিও আদিবাসীদের আরও একটি আবিষ্কার হচ্ছে ডিজেরিডু (উরফমবৎরফড়ড়) বা সংক্ষেপে সম্ভবত ডুডু। এটি একটি বায়ুযন্ত্র যা পৃথিবীর ঐ জাতীয় যন্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন (কয়েক হাজার বছর আগে আবিষ্কৃত)। সাধারণত এক থেকে তিন মিটার পর্যন্ত লম্বা বাঁশ বা ফাঁপা কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয় যন্ত্রটি। একপ্রান্তে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিলে একধরনের শিহরণ জাগানো অদ্ভুত শব্দ বের হয়ে আসে। আদিবাসীদের ধারণা ডুডুর মাধ্যমে পৃথিবী ও প্রকৃতি তার ভাব প্রকাশ করে, কাজেই এটির শব্দ পবিত্র। আদিবাসীদের শিল্পকলা সৃজনের ক্ষমতা, বিশেষত বিভিন্ন গুহা এবং পাহাড়ের পাথরের গায়ে খোদাইচিত্র ও রঙিন চিত্রাঙ্কন দেখার মত। প্রতœতত্ত্ববিদদের ধারণা এগুলি তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার বছরের পূরাতন।
অস্ট্রেলিয়ার চারদিকে ঘিরে আছে তিনটি মহাসাগর। উত্তর পূর্বে প্রশান্ত, পশ্চিমে ভারত এবং দক্ষিণে দক্ষিণ মহাসাগর। ভারত মহাসাগরের কূল ঘেঁষে জল ও স্থলের সুদীর্ঘ মিলন রেখাকে বলা হয় গ্রেট অস্ট্রেলিয়ান বাইট (এৎবধঃ অঁংঃৎধষরধহ ইরমযঃ) বা অস্ট্রেলীয় মহাবাঁক। সপ্তাশ্চর্যের কথা কার না জানা আছে। সে সব কিছুই মানুষের তৈরি। প্রকৃতিতেও কিছু আশ্চর্যজনক সৃষ্টির নির্দশন আছে। এরকম নৈসর্গিক দশ-আশ্চর্যের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তার মধ্যে একটি হবে এই বাইট। এই বিশ্বখ্যাত অদ্বিতীয় বাঁকসংলগ্ন উপকূলবর্তী বিশাল এলাকা বৈচিত্র্যময় নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরপুর। এ যেন এক স্বপ্নের বা রূপকথার দেশ। সম্প্রতি সুযোগ হয়েছিল স্ব-পরিবারে (আমি, জেসমিন এবং একমাত্র মেয়ে অভি) সেই রূপকথার দেশভ্রমণের। এটি নিঃসন্দেহে আমার জীবনের সব থেকে বিস্ময়কর এবং আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা।
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া স্টেটের রাজধানী পার্থ শহরে দীর্ঘদিন অবস্থানের পর পারিবারিকভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া স্টেটের রাজধানী মেলবোর্নে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব। ততদিনে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকটা সময় অস্ট্রেলিয়া কাটানো হয়ে গেছে আমাদের। কিন্তু দেশটা তখনও সেভাবে দেখা হয়নি। মূলত ঘুরে ঘুরে অনিন্দ্যসুন্দর দেশটি দেখার সুপ্ত বাসনা থেকে সেদিন পার্থ থেকে মেলবোর্ন যাত্রা করেছিলাম। ভ্রমণটি বিমানে নয়, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে যাব। প্রয়োজনমত সুবিধাজনক কয়েকটি স্থানে রাত্রিযাপন করে পার্থ থেকে মেলবোর্ন যেতে যেতে আমরা একটি বিস্ময়কর ও আনন্দময় ভ্রমণ করেছিলাম।