নিজস্ব প্রতিবেদক
গাজীপুরে পিকনিকের বাসে বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত ইসলামিক আইইউটির অব টেকনোলজি- আইইউটির শিক্ষার্থী জুবায়ের আলম সাকিবকে তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর মুরারীপুরে কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। রোববার (২৪ নভেম্বর) সকাল ১০টায় তার নামাজে জানাজায় অংশ নেন সহপাঠী, বন্ধু, স্বজনসহ গ্রামের হাজারখানেক মানুষ।
তারা বলছেন, পিকনিক গিয়ে এভাবে মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এই ঘটনায় যার যার অবহেলা ও গাফিলতি আছে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তারা। এভাবে যেন আর কোনো বাবা-মা’র বুক খালি না হয়, তাই এমন আয়োজনে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেয়া উচিত।
জানা গেছে, মেধাবী ও নম্র ভদ্র হিসেবে এলাকায় তার বেশ সুনাম ছিল। ছোটবেলা থেকেই প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। সেই স্বপ্ন পূরণে ভর্তি হয়েছিলেন আইইউটিতে।
সাকিবের মা ফজলেতুন্নেসা সেফা মুরারিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার বাবা জাহাঙ্গীর আলম অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। আগে তাদের বাড়ি ছিল মুরারিপুর গ্রামেই। পরে তারা রাজশাহী নগরের বাকির মোড় এলাকায় একটি চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেন।
সাকিব রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ২০১৯ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। ২০২১ সালে রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (আইইউটি) ভর্তি হন। তিনি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
এদিকে দোতলা বাসে শিক্ষার্থীদের পিকনিকে নিয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যাওয়া শিক্ষার্থী জোবায়ের আলম সাকিবের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা এ নিয়ে কোনো আইনগত পদক্ষেপ নিতে চান না।
বোন নাইমাতুল জান্নাত শিফা বলেন, এখন কোনো বিষয় নিয়েই কথা বলতে তারা আগ্রহী নন। কোনোরকম ঝামেলা হোক তা তারা চান না। এখন তিনি শুধু ভাইয়ের জন্য দোয়া চান।
নিহত সাকিবের মামা তাসনিম ফেরদৌস বলেন, গ্রামের সরু রাস্তায় দোতলা বাস নিয়ে পিকনিকে যাওয়া মোটেও উচিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী বিবেচনায় এটা করেছিল, তারাই ভালো জানে। দোতলা বাস না হলে এভাবে বিদ্যুতায়িত হয়ে দুর্ঘটনাটা ঘটত না।
সাকিবের জানাজায় এসেছিলেন তার স্কুলবন্ধু সোহেল পারভেজ। তিনি বলেন, আমরা আলাদা স্কুলে পড়তাম। এইচএসসিতে ভর্তির আগে প্রস্তুতির সময় কোচিং করতে গিয়ে সাকিবের সঙ্গে পরিচয়। ওর মতো ভালো ছেলে হয় না। সে খুব আন্তরিক ছিল। যে কারণে অন্য স্কুলে পড়লেও তার সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়। তার মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছি না।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবারের সদস্যরা সাকিবের লাশের ময়নাতদন্ত করতে দেননি। অনেক ঝামেলা হলেও তারা সাকিবের মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করতে দেননি। এজন্য আইনগত কোনো ব্যবস্থাও নেবেন না তারা। আইনের আশ্রয় নিলে আবার কবর থেকে লাশ তোলা হবে, ময়নাতদন্ত হবে, এসব ঝামেলা চান না পরিবারের সদস্যরা।
সাকিবের চাচি বিউটি বেগম বললেন, সাকিবের মতো এত ভালো ছেলে আর হয় না। তিনি সাকিবের ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখালেন, বিছানার ওপর এখনো জায়নামাজ পড়ে আছে। শেলফে থরে থরে সাজানো বই। একটা কম্পিউটার।
বিউটি বললেন, সব পড়ে থাকল, ছেলেটাই আর থাকল না। তার মায়ের নানা রকম অসুখ। অসুস্থ মানুষটা এই শোক সইবে কী করে।
সাকিবের বোনের শ্বশুর নজরুল ইসলাম নওগাঁর মান্দার একটি কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি বললেন, গ্রামের মধ্যে সফর করবে তো দোতলা বাস কেন? গ্রামের রাস্তায় গাছের ডাল থাকবে, বিদ্যুতের লাইন থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চরম গাফিলতির পরিচয় দিয়েছে দোতলা বাস ভাড়া করে। এই দুর্ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) একমাত্র ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে গাজীপুরে ছুটে যান সাকিবের বাবা জাহাঙ্গীর আলম ও মা ফজলেতুন্নেসা সেফা। সঙ্গে যান সাকিবের বড় বোন নাইমাতুল জান্নাত শিফা। গভীর রাতে লাশ নিয়ে তারা রাজশাহী শহরের বাসায় আসেন। রোববার (২৪ নভেম্বর) সকাল ৭টায় এখানে সাকিবের প্রথম জানাজা হয়। এরপর লাশ নেওয়া হয় মুরারিপুর গ্রামে। রোববার সকাল ১০টায় গ্রামের কবরস্থানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।
অন্যদিকে জুবায়ের আলম সাকিব মৃত্যু বরণ করায় গোল্ডেন সান শিক্ষা পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে। নিহত সাকিব গোল্ডেন সান স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল। তার মৃত্যুতে গোল্ডেন সান শিক্ষা পরিবারের চেয়ারম্যান ও গোল্ডেন সান বৃত্তি প্রদান কমিটির প্রতিষ্ঠাতা মহা-সচিব রফিক আলম, গোল্ডেন সান স্কুলের পরিচালক শামজিদা আলম, অধ্যক্ষ রাজিয়া সুলতানা, বৃত্তি প্রদান কমিটির পরিচালক (অর্থ) সুমাইয়া পারভীন রাত্রী সহ সকল শিক্ষক শিক্ষিকা শোক প্রকাশ করে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন এবং শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।