শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১১ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
নিজস্ব প্রতিবেদক ও গোদাগাড়ী প্রতিনিধি
রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পুলিশের ওপর হামলকারী যুবক আমিজুল (২৬) উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেএমবি ক্যাডার। দীর্ঘদিন আগেই তিনি জেএমবি’র সামরিক শাখা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বর্তমানে আমিজুল জেএমবির প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তার কাছে অস্ত্র ও হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে জেএমবি ক্যাডাররা সারাদেশে ছড়িয়ে আছে।
এছাড়া জেএমবি নেটওয়ার্কের সঙ্গে আমিজুলের যোগাযোগ অত্যন্ত শক্তিশালী। এমনকী জেএমবি যেসব এলাকায় অপারেশন চালায়, সেসব জায়গা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আজিমুল। এরপর তিনি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করলে জেএমবির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডাররা সেখানে হামলা চালায়। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের তদন্তে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এছাড়া মঙ্গলবার রাতে দুই গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা চালানোর আধাঘণ্টার মধ্যেই আজিমুলকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা আটক করে বলে গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে। তবে বিষয়টি পুলিশ কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন না।
রাজশাহীর পুলিশ সুপার মোয়াজ্জেম হোসেন ভুইয়া জানান, সারাদেশে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি পুলিশ সদর দফতর থেকে মনিটরিং করা হয়। তাই হামলাকারী আমিজুলকে আটক করা হয়েছে কী না- সে বিষয়ে তিনি কিছু জানাতে পারবেন না। তবে এ ঘটনায় এখনো মামলা দায়ের হয় নি। ঊর্ধ্বতন মহল থেকে নির্দেশনা পেলেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এদিকে দুই গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ঘটনার পর থেকে এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত জেএমবি নেতা আমিজুলের (২৬) পরিবারের সদস্যরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত আটটার দিকে বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল গোদাগাড়ী পৌর এলাকার বুজরুক রাজারামপুর মহল্লার আতাউর রহমানের পালিত ছেলে আমিজুলকে আটক করতে আসলে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে আব্দুস সালাম ও ইসমাইল হোসেন নামের পুলিশের দুই সদস্য গুরুতর আহত হয়। আহতদেরকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বগুড়া জেলায় আটককৃত এক জঙ্গির তথ্যের ভিত্তিতে আমিজুলকে আটক করতে আসেন গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা স্থানীয় থানা পুলিশকে অবহিত না করে আটক অভিযান চালায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাদা পোশাকে ৩/৪ জন পুলিশ বুজরুক রাজারামপুর মোড়ে এসে আমিজুলকে পেয়ে যায়। তাকে একজন পুলিশ সদস্য জাপটে ধরলে আমিজুল তার কাছে থাকা ছুরি দিয়ে ওই পুলিশ সদস্যকে উপুর্যুপরি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ে আরেক পুলিশ সদস্য এগিয়ে আসলে তাকেও ছুরিকাঘাত করে আমিজুল পালিয়ে যায়।
রামেক হাসপাতালের আট নম্বর ওয়ার্ডে সালাম এবং চার নম্বর ওয়ার্ডে ইসমাইল চিকিৎসাধীন আছেন। গতকাল বুধবার সকালে ওই দুটি ওয়ার্ড সরেজিমনে গেলে দেখা যায়, দুই পুলিশ সদস্য ঘুমিয়ে আছেন। তাদের দু’জনের কাছেই চারজন করে পুলিশ সদস্য আছেন। ইসমাঈল হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে দেননি দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা। তবে আবদুস সালামকে গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিয়ে ডাকলে তিনি চোখ মেলেন। এসময় তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, আমিজুল জেএমবির দুর্ধর্ষ জঙ্গি। গত এক মাস ধরেই তারা আমিজুলের গতিবিধি নজরে রেখেছিলেন। ওই রাতে তাদের সঙ্গে বগুড়া জেলা ডিবির একজন সহকারী উপ-পরিদর্শকও (এএসআই) ছিলেন। ওই সময় বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল আমিজুল। তাকে একা পেয়ে এই সুযোগটিই কাজে লাগাতে চান তারা। তাকে প্রথমেই আটকান কন্সটেবল ইসমাঈল। এ সময় তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এরপর তিনি আমিজুলকে জাপটে ধরেন। এ সময় তাকেও পরপর কয়েকটি ছুরিকাঘাত করা হয়।
অপরদিকে আমিজুলের ব্যাপারে তার প্রতিবেশিরা বলছেন, এলাকার অনেক মানুষ তাকে চেনেনই না। একা একা চলাফেরা করত। মসজিদে গিয়ে সে নামাজের পর দোয়া করার বিরোধিতা করত। তার কথাবার্তায় ছিল উগ্রতা। আমিজুল নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করত। তবে সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বলেও অনেকের কাছে বলেছিল। এক বছর আগে থেকে আমিজুল পাঞ্জাবি পরতে শুরু করে। মাথায় টুপিও পরে। দাড়ি রাখে। আমিজুলের বাবা আতাউর রহমান আগে জুয়া-মদে মেতে থাকতেন। তবে সম্প্রতি তিনিও নিজেকে বদলে ফেলেছেন। মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত আযান দিয়ে মুয়াজ্জিনের ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। তাদের বাড়িতে মাঝে মধ্যে অচেনা নারীদের ইসলামী বৈঠকও হতো।
আমিজুলের দুর্ধর্ষতার ব্যাপারে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, তার ব্যাপারে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। আমিজুল একাই যেভাবে দুই পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা চালিয়েছে, তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। তার ছুরি চালানোর ধরনেই বোঝা গেছে সে কতটা দুর্ধর্ষ। আমিজুল জেএমবির উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডার। বর্তমানে প্রশিক্ষক হিসেবে জেএমবি ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দেয় বলেও তারা তথ্য পেয়েছেন। এছাড়া জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা যাচাই-বাছাইয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এলতাস হোসেন বলেন,এ অঞ্চলের মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। তাদের এলাকায় এই ধরনের ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিল এবং এতদিন ধরে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ও জঙ্গি অবস্থান করছিল তা এলাকাবাসি বুঝে উঠতে পারেন নি। আতাউরের বাড়িতে পালিত ছেলে হিসেবে গত আটবছর ধরে আমিজুল অবস্থান করছিল।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, আমিজুল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চর হরিশপুর গ্রামে তার নানার বাড়িতে মাঝে মধ্যে অবস্থান করত। সে কোথায় লেখাপড়া করত তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও স্থানীয় লোকজন জানায়, তাদেরকে আমিজুল বলত রাজশাহীতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আবার কখনও বলতো সে মাদ্রাসার ছাত্র।
সার্বিক বিষয়ে গোদাগাড়ী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিপজুর আলম মুন্সি বলেন, আমিজুলকে আটক করা হয়েছে কী না- তা আমার জানা নেই। আর এ ঘটনায় বগুড়া গোয়েন্দা পুলিশ মামলার ব্যাপারে কোন যোগাযোগ করে নি। তারা মামলা করতে চাইলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।