পুলিশ আতঙ্কে ১৫টি গ্রাম পুরুষ শূন্য

আপডেট: ডিসেম্বর ৮, ২০১৬, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

এমআর রকি, নওগাঁ :



সূর্য ঠিক মাথার ওপর। মাঝ দুপুরে শতাধিক নারী জটলা করে বসে আছে। সবার মাঝেই দুঃচিন্তার ছাপ। অথচ অগ্রাহায়ণের এই সময়ে গ্রামের মানুষ নানা কাজে ব্যস্ত থাকার কথা। ধানের পালায় ধান পড়ে আছে। দূরে আলু খেত কিছুটা আলগা হয়ে আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে দুইদিন আগে এখানে আলু তোলার চেষ্টা হয়েছে। এখন বন্ধ সেই আলু তোলা।
গত ৩ ডিসেম্বর স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা আবু বকরের মৃত্যু নিয়ে থানায় মামলা করা হয়। সেই মামলা এখন এসব গ্রামে আতঙ্কের নাম হয়ে দেখা দিয়েছে।  গেল রাতে পুলিশ এসে আসামি ধরার তৎপরতা দেখিয়েছে তাই সন্ত্রস্ত পুরো এলাকা। ঐ গ্রামের আন্তাজুল সহ কয়েকটি বাড়িতে গভীর রাতে আসে পুলিশ। তারা ঘুম থেকে নারীদের তুলে গৃহকর্তার কোথায় তা জানতে নানা জিজ্ঞাসা চালায়। এছাড়া বিভিন্ন বাড়িতে চলে তল্লাসীর নামে হয়রানি। মথুরাপুর শান্তি প্রিয় গ্রামটি এখন মামলা আতঙ্ক বিরাজ করছে সর্বত্র। গ্রামের নারীরা একজোট হয়ে সড়কের দু ধারে প্রতিবাদ স্বরুপ মানববন্ধনে নামে। এখানে প্রায় দুশো নারী শিশু ও বৃদ্ধ অংশ নেয়। তারা দাবী করে গ্রামের হীন রাজনীতির কারণে স্বাভাবিক ভাবে মারা যাওয়া আবু বকরকে হত্যা দেখিয়ে নিরহ লোকদের মামলায় জড়ানো হয়েছে। আর এ মামলায় পুলিশ এখন ধরপাকড় করতে প্রতিরাতে হানা দিচ্ছে সফাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। হয়রানি এড়াতে এসব গ্রামের পুরুষরা আত্মগোপনে যাওয়ায় হয়ে পড়েছে পুরুষশুন্য।
কেন এ প্রতিবাদ : গত ৩ ডিসেম্বর মহাদেবপুর থানায় মামলা করে ইশ্বর লক্ষীপুর গ্রামের নিহত আবু বকরের ছেলে তারিকুল ইসলাম। মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে  আসামি করা হয়, এছাড়া আরো অজ্ঞাত রয়েছে ৩০/৩৫ জন। মামলাটি রাজনৈতিকভাবে করার হয়েছে এমন দাবী করে হয়রানির শিকার এসব গ্রামের নারী ও পুরুষ প্রতিবাদে নেমেছে। সফাপুর ইউনিয়নের মোট ৩০টি গ্রাম। এসব গ্রামের মধ্যে অন্তত ১৫টি গ্রামের মানুষ এখন শঙ্কায় দিন পার করছে। তাদের দাবী মিথ্যা মামলায় এসব গ্রামের মানুষকে জড়ানো হয়েছে । যার মধ্যে রয়েছে  হাতি মন্ডলা, বাখড়াবাজ, ইশ্বর লক্ষীপুর,বিনোদ পুর, পাঠাকাটা, দক্ষিন লক্ষীপুর। এসব গ্রামে সরজমিনে দেখা যায় ভীত সন্ত্রস্ত পুরো গ্রামবাসী। গ্রামের বেশ ক’জনের সাথে কথা হয়। এদের মধ্যে মোকবুল মাষ্টার, আনোয়ারা, আনজুমান আরা, সোহেল, রফিক বিশ্বাস, তারা বলেন সম্পুর্ণ উদেশ্যমূলকভাবে এ মামলাটি করা হয়েছে । নিহত আবু বকর হার্ট এটাকে মারা গেছে এটা পুরো গ্রামবাসী জানে কিন্ত গ্রামের দলীয় রাজনীতির লাটাই হিসাবে নিহত আবু বকর কে ব্যবহার করছে একটি মহল। তবে আসল ঘটনা বের হবে আবু বকরের পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট এলে । এ মামলার হুকুমের আসামি করা হয়েছে স্থানীয় কারিগড়ী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ময়নুল ইসলামকে। তিনি বলেন, বিগত দিনে নৌকা প্রতিক নিয়ে সফাপুর ইউনিয়নে ভোট করি। সে সময় আবু বকর আওয়ামীলীগের বিপক্ষ প্রার্থীর পক্ষে ভোট করে। এটা কে পুজি হিসাবে এখন আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। তিনি বলেন, আবু বকর একজন ভাল মানুষ। তার মৃত্যুতে আমি নিজেও মর্মাহত কিন্ত আবু বকরের লাশ নিয়ে একটি মহল রাজনীতির চেষ্টা করছে এটা খুব দু:খজনক । মিথ্যা মামলা দিয়ে সাধারন মানুষদের হয়রানি করা হচ্ছে ।
মামলার ইস্যু : গত ২৭ নভেম্বর স্থানীয় পবতোর বিদ্যালয়ে ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের কমিটি গঠন করার জন্য সভা আহবান করা হয়। বিকাল ৪ টায় স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ সভায় উপস্থিত থেকে একটি কমিটি তৈরি পর্যালোচনা সভা চলে। এ কমিটিতে আবু বকর সহ সে সময় নৌকার বিপক্ষ প্রার্থীর হয়ে কাজ করার অভিযোগ এনে তাদের নাম রাখা নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন ছিলেন এমন কয়েকজন হলেন সেকেন্দার মাষ্টার, বাসেদ আলী জাহাঙ্গীর আলম জানান, সে দিন আবু বকরসহ আরো ক’জন এসে কমিটিতে তাদের নাম রাখার জন্য দাবী জানায়, উপস্থিত নেতৃবৃন্দ দলীয় নীতিমালার বরাত দিয়ে তাদের জানায় যারা বিগত দিনে নৌকা প্রতিকের বিপক্ষে ভোট করেছে তাদের নাম কমিটিতে আসবে না। এরপর সেখানে কথা কাটাকাটি ও হালকা ধাক্কা ধাক্কি হয়। ঘটনার পর আবু বকর চলে যায়। এ ঘটনার ৬ দিন পর আবু বকর মারা যায়। মামলার ইস্যু হিসাবে ২৭ নভেম্বরের ঘটনাকে টেনে ১৭ জনকে আসামি করে মহাদেবপুর থানায় মামলা করে আবু বকরের ছেলে তারিকুল ইসলাম।
স্বাভাবিক মৃত্যুকে অ স্বাভাবিক করার অভিযোগ ও বাদির বক্তব্য : নিহত আবু বকরের বাড়ী ইশ্বর লক্ষী পুর গ্রামে  গিয়ে জানা যায় ২ ডিসেম্বর রাতে ঐ গ্রামের একটি মাদ্রাসায় ওয়াজ মাহফিলে আবু বকর শরিক হয়। ওয়াজ মাহফিল উপলক্ষে বাড়ীতে আসে অন্য স্বজনরা। ওয়াজ মাহফলে উপলক্ষে আয়োজন করা হয় পোলাওয়ের। সে পোলা খায় আবু বকর। আবু বকরের প্রতিবেশীরা জানায় পরদিন সকাল থেকে পাতলা পায়খানা সহ কয়েকবার বমি করে । এক পর্যায়ে গুরত্বর অসুস্থ হয়ে পড়ে । সে সময় তাকে নিয়ে মহাদেবপুর হাসপাতালের দিকে নেওয়া হয় । মহাদেবপুর হাসপাতালের আরএমও ডা. আলাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আবু বকরকে হাসপাতালে নেওয়ার আগে সে মারা যায়। স্থানীয়দের অভিযোগ এটা স্বাভাবিক মৃত্যু । এছাড়া নিহত আবু বকর দীর্ঘ দিন থেকে হার্টসহ বেশ কিছু রোগে ভুগছিলেন বলে জানায় প্রতিবেশী আত্মীয়রা। তবে তার পরিবার বিষয়টিকে মানতে নারাজ । এ মৃত্যুর মূল কারণ ঐ দিনের ঘটনা বলে জানায়।
আবু বকরের ছেলে তারিকুল ইসলাম এ ঘটনার পর দিন মহাদেবপুর থানায় মামলা করে। মামলায় উল্লেখ করা হয় ২৭ নভেম্বর তার পিতা সহ তাকে বেধরক মারপিট করার কারনে পিতার মৃত্যু হয়েছে ।
এ প্রতিবেদক কে তারিকুল জানায় তার আব্বা ঘটনার দিন থেকে কিছুটা মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছিল। সে কথা আত্ম মর্যাদায় প্রকাশ করে নি। সে দাবী করে এ মৃত্যুর মূলকারণ ঐ দিনের ঘটনা ।
থানা পুলিশের ভাষ্য : মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাবের রেজা জানান, বাদির আবেদনে হত্যা মামলা হিসাবে মামলা নেওয়া হয়েছে। এ মামলায় এতো আসামি কেন প্রশ্ন ছিল।
তিনি বলেন, যেহেতু এটা রাজনৈতিক মামলা তাই উপরের নির্দেশ মেনে মামলা নেয়া হয়েছে । তবে সাধারণ লোকজন যেন কোন ভাবে হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে তিনি সজাগ আছেন বলে জানান। এদিকে পুলিশি আতঙ্ক বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন যেহেতু মামলা হয়েছে সে ক্ষেত্রে আতঙ্ক থাকবেই ।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ