পুলিশ কর্মকর্তা মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিযোগ || বিভাগীয় মামলা রুজু

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৭, ১২:১৩ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক



ধরো, মারো, আদায় করো- এই ছিল তার রাতদিনের কাজ। নগরীজুড়ে তার ডজনখানেক দালাল সদা তৎপর থেকে মক্কেল ধরে আনত। কার টাকা আদায় করে দিতে হবে, কার কোন প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে হবে, মাদকব্যবসায়ীসহ অবৈধ কারবারে জড়িতদের কাছ থেকে কীভাবে টাকা আদায় করতে হবে- এসব তথ্য দালালদের মাধ্যমে পৌঁছে যেত আরএমপির বহুল আলোচিত সাবেক এসআই মহিউদ্দিন শেখের কাছে।
ভুক্তভোগীদের মতে, এসআই মহিউদ্দিন আরএমপিতে ছিলেন ‘অঘোষিত কমিশনার’। তার সীমাহীন দাপটে ডিসি, এসি, ওসিরা কার্যতঃ ছিলেন অসহায়। সম্প্রতি আরএমপি থেকে বদলির পর এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে নিপীড়নের একাধিক অভিযোগ আসে পুলিশ কমিশনারের কাছে। একজন সরকারি কর্মকর্তাকে তুলে এনে দীর্ঘসময় আটকে রেখে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১২ আনা সোনার গয়না আদায়ের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু হয়েছে। মামলাটির চূড়ান্ত তদন্ত চলছে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ কমিশনারের কাছে ইতোমধ্যে জমা পড়েছে ভুক্তভোগীদের একাধিক অভিযোগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের অভিযোগে জানা গেছে, রাজশাহীর পবা উপজেলা উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর মোল্লাপাড়ার জামায়াত নেতা রফিকুল ইসলামের মেয়ে রাফিয়াতুস সাইমা সানজিকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের পর সানজি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়লে শরিফুল ইসলাম ২০১৬ সালের ১৫ জুন আইনসম্মত ও পারিবারিকভাবে তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করেন। কিন্তু তালাকনামা হাতে পাওয়ার পর সানজির বাবা জামায়াতের রোকন রফিকুল ইসলাম ও তার ভাই বনি শরিফুলের কাছে ৭ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়া ছাড়াও পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে নির্যাতনের মামলা করারও হুমকি দেয়া হয় শরিফুলকে। শরিফুল ২১ জুন বোয়ালিয়া থানায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
শরিফুল লিখিত অভিযোগে আরো বলেন, ২০১৬ সালের ২৬ জুন গভীর রাতে এসআই মহিউদ্দিন একদল পুলিশসহ আমার বাসায় যান। আমাকে ও পরিবারের লোকজনকে ঘুম থেকে টেনে তোলেন। এসআই মহিউদ্দিন আমাকে বলেন, তোকে থানায় যেতে হবে। আমি কারণ জানতে চাইলে মহিউদ্দিন বলেন, বেশি কথা বলবি না। যেতে বলছি চল, না’হলে গুলি করে এখানেই তোকে ফেলে দেবো। এরপর মহিউদ্দিন আমাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তোলেন। বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে সেখানে একটি ঘরে ১৬ ঘণ্টা আটকে রাখেন। এসময় আমাকে পরিবারের লোকজনের সঙ্গেও দেখা করতে দেয়া হয়নি। আমার সহকমী, প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনরা থানার ওসির কাছে গেলে তিনি জানিয়ে দেন ‘ এ ব্যাপারে তারা কিছুই করতে পারবেন না। মহিউদ্দিন এনেছে, সেই এ ব্যাপারে সমাধান করবেন।’
অভিযোগকারী কৃষি কর্মকর্তা আরো বলেন, মহিউদ্দিন আমাকে বলেন, স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিস, এখন তোকে টাকা দিতে হবে। তুই ৭ লাখ টাকা দিবি তোর শ্বশুরকে। না’হলে তোকে এমন মামলায় চালান করবো যাতে তোর চাকরিটা আর না থাকে। এসময় আমি ও আমার আত্মীয়স্বজন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলি যে মোহরের টাকা তালাকের সঙ্গে পরিশোধ করে দেয়া হয়েছে। কাবিননামা অনুযায়ী যদি তারা আর কিছু পায়, সেটাও পরিশোধ করে দিব। কিন্তু আমরা ৭ লাখ টাকা কেন দেবো। এসময় মহিউদ্দিন মারমুখী হয়ে আমার সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেন। আমাকে মানসিক আর শারিরীক নির্যাতন করেন।  আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া আমার প্রতেবেশি সিটি কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মজিবুর রহমান, আমার সহকর্মী জসিম উদ্দিন ও মওদুদ ইসলাম, আমার মামা সোহেলের সঙ্গে অসম্ভব খারাপ আচরণ করেন ও তাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি দেন মহিউদ্দিন। থানার যে ঘরে আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল সেখানে মহিউদ্দিনের এক দালালও আমাকে ও আমার স্বজনদের তেড়ে তেড়ে মারতে উদ্যত হয়, অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেন। শেষে আমার পরিবার দুই লাখ টাকা সংগ্রহ করে মহিউদ্দিনকে দেন। কিন্তু তাতেও তাকে সন্তষ্ট করা যায়নি। শেষে আমার বড় বোন দুই লাখ টাকা এবং তার গলা থেকে ১২ আনা ওজনের সোনার মালা খুলে দিয়ে মহিউদ্দিনের হাতে তুলে দেন। শেষ পর্যন্ত ১৬ ঘণ্টা হাজতবাসের পর আমি বোয়ালিয়া মডেল থানা থেকে ছাড়া পাই। ছেড়ে দেয়ার সময় এসআই মহিউদ্দিন হুমকি দিয়ে বলেন, কাউকে এসব বিষয়ে জানালে তোকে জন্মের মতো পার দেবো।
শরিফুল ইসলাম বলেন, আরএমপির পূর্বের কমিশনার মো. শামসুদ্দিনের মদদে এসআই মহিউদ্দিন রাজশাহী নগরীতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এমন কোনো বেআইনি আর খারাপ কাজ নেই যা সে ক্ষমতার দাপটে করে নি। তবে আরএমপির বর্তমান কমিশনার শফিকুল ইসলাম ১৮ জুন দায়িত্বগ্রহণ করে মহিউদ্দিনকে বোয়ালিয়া থানা থেকে সরিয়ে দিলে ৭ জুলাই  আমি এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে ও নির্যাতন করে টাকা আদায়ের অভিযোগ দাখিল করি।
তিনি আরো বলেন, আমার শ্বশুর জামায়াত নেতা রফিকুল ইসলামের সঙ্গে টাকা আদায়ের চুক্তিতেই আমার ও আমার পরিবার ও স্বজনদের ওপর মহিউদ্দিন এই অমানবিক নির্যাতন করেন। তিনি বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাজ মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া, ন্যায়বিচার পেতে সাহায্য করা। কিন্তু মহিউদ্দিন সেটা না করে টাকার চুক্তিতে আমার ওপর জুলুম নির্যাতন করেছেন। তার শাস্তি হওয়া দরকার।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম আরএমপির দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এসআই মহিউদ্দিনকে বোয়ালিয়া থানার সেকেন্ড অফিসারের পদ থেকে সরিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁড়িতে বদলি করেন। কিন্তু এসআই মহিউদ্দিন সেখানে বেশিদিন থাকেন নি। তদবির করে আরএমপি থেকে বদলি হয়ে যান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার এসআই মহিউদ্দিনকে সদর মডেল থানার সেকেন্ড অফিসারের পদে পদায়ন করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তাকে নির্যাতনের অভিযোগটি তদন্ত করেন রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) উপকমিশনার তোফায়েল আহমেদ। তিনি তদন্ত শেষে গত ডিসেম্বরে কমিশনার বরাবরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে আরএমপির সদর বিভাগে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। মামলা নং-১৫/২০১৬। পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে বর্তমানে বিভাগীয় এই মামলাটি তদন্ত করছেন বোয়ালিয়া জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. ইবনে মিজান।
এডিসি ইবনে মিজান বলেন, এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে রুজু করা বিভাগীয় মামলাটির তদন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত অভিযোগকারীসহ ৫ জনের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। এসআই মহিউদ্দিনকেও তিনবার ডাকা হয়েছে তার বক্তব্য দেয়ার জন্য। বাকি সাক্ষিদের জবানবন্দি গ্রহণ শেষ করে দ্রুত এ ব্যাপারে প্রতিবেদন দেয়া হবে।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে এসআই মহিউদ্দিন বলেন, তার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা অভিযোগে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়েছে। তবে তিনি আশা করেন, সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তার কোনো সমস্যা হবে না। অন্য অভিযোগগুলির ব্যাপারে তিনি বলেন, সব মিথ্যা কথা। তার শক্ররা এসব অভিযোগের কথা প্রচার করেন।
অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, এসআই মহিউদ্দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জে গেলেও তার চালচলনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেখানে যোগদান করেই মাদক সিন্ডিকেট ও অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন গভীরভাবে। অপরাধে জড়িত উঠতি যুবকরা এসআই মহিউদ্দিনের সর্বক্ষণের সঙ্গী এখন। বরাবরের মতো থানার ওসিকে এড়িয়ে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এজন্য সে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সাথে সার্বক্ষণিক থাকছেন। উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। মহিউদ্দিন এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন।       এদিকে  আরএমপির পুলিশ কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মহিউদ্দিন আরএমপিতে ছিলেন অত্যন্ত বেপরোয়া। সাবেক কমিশনারকে ডাকতেন ‘আব্বা’ বলে। সন্ধ্যা হলেই ছুটে যেতেন কমিশনারের বাংলোয়। আর এ কারণে পদোন্নতির র‌্যাঙ্কে মহিউদ্দিন কনিষ্ঠ হলেও তাকে দেয়া হয়েছিল বোয়ালিয়া মডেল থানার সেকেন্ড অফিসারের দায়িত্ব। বোয়ালিয়া থানার সেকেন্ড অফিসার হলেও তার অবাধ বিচরণ ছিল আরএমপির চার থানা এলাকায়। সিভিল টিম নিয়ে চষে বেড়াতেন রাজশাহী মহানগরীর চার থানা। ধরে এনে টাকা নিয়ে ছেড়ে দিতেন। এটা ছিল তার মূল কাজ।
রাজশাহীতে সামাজিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে বলেন, মহিউদ্দিনের  আচরণ ছিল উদ্যত ও দুর্বিনীত। মানুষকে ধরে এনে মর্জি মাফিক আটকে রেখে নির্যাতন করতেন, চাহিদামতো আদায় করতেন টাকা। সম্মানি লোকেরা কোনো কারণে তার বাধ্য হয়ে তার সামনে পড়লে হতে হতো  অপমান অপদস্থ। তবে অপরাধী চক্রের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল গভীর।  তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় বদলি হলেও সেখানেও থানার সেকেন্ড অফিসারের দায়িত্বে আছেন।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বরিশাল মহানগর পুলিশে থাকতে মহিউদ্দিন ২০০৯ সালের ৩ নভেম্বর মাহমুদা নামের এক গৃহবধূকে আটক করে তিনদিন থানায় আটকে রেখে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। মাহমুদার সাবেক স্বামীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে ওই গৃহবধূকে তিনদিন থানায় আটকে রেখেছিলেন। এই ঘটনাটি ওইসময় বরিশালে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। পরে মহিউদ্দিনকে বরিশাল থেকে বদলি করে দেয়া হয়।