পুলিশ জনগনের বন্ধু হবে কবে

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৪, ১:০১ অপরাহ্ণ

সামসুল ইসলাম টুকু :


বলিউডের সবচেয়ে ভালো দেশাত্মবোধক হিন্দি সিনেমা ‘ইন্ডিয়া’। এন নটরাজন পরিচালিত ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন সানি দেওল্, শিল্পা শেঠি, ওমপুরি, ড্যানি রাজ বাব্বার। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন সানি দেওল একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে। সিনেমার কাহিনীতে দেখা যায়, ভারতের একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি ও গডফাদার এর কন্যা এক গরিব ঘরের ছেলেকে ভালবেসে বাড়ি ত্যাগ করে।

এরপর পুলিশ তাদের আটক করে ছেলেটিকে বেধড়ক পেটাতে থাকলে পুলিশ অফিসার সানি দেওল বাধা দেন। এতে অন্যান্য পুলিশ অফিসারেরা ভীষণ নাখোশ হন এবং সানি দেওলকে ওই গড ফাদারের প্রচণ্ড প্রভাব ও শক্তির বর্ণনা দিয়ে শান্ত থাকতে বলেন। কিন্তু সানি দেওল ইতোমধ্যে গডফাদারের সকল অপকর্মের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হন।

এরপরেও তার ব্যাপারে পুলিশ বিভাগের নতজানু আচরণ তারই গুনগান এবং তাকে কিছু বলা হলে পুলিশের ইমেজ নষ্ট হবার ভীতি প্রদর্শন সানি দেওলকে পীড়িত করে । প্রেক্ষিতে সানি দেওল পুলিশ কর্মকর্তাদের এক সভায় গঠনমূলক বক্তব্য দেন। হুবহু সেটাই তুলে ধরছি ।

পুলিশ ডিপার্টমেনন্টের ইজ্জত কোন উচ্চতায় আছে? আর ইজ্জত তারই যায় যার ইজ্জত আছে। দেশের জনগণের কাছে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ইমেজ কী আছে তা আমরা সবাই জানি। দুর্নীতিবাজ ঘুষখোরের চেয়ে ভাল ইমেজ পুলিশের নেই। একজন গরিবের যখন পকেটমারা হয় তখন সে থানায় অভিযোগ করতে আসে। তখন তাকে এমনভাবে জেরা করা হয় যেন সেই আসামী।

কোথায় পকেট মারা হলো, তোমার পকেটে কত টাকা ছিল, এত টাকা পেলে কোথায়? এমন উলটো পালটা প্রশ্ন করতে করতে বেচারার জবান বন্ধ করে দেয়। তারপরেও বলে ঠান্ডা নিয়ে এসো, সেইসাথে সিগারেটও নিয়ে আসবে। বাধ্য হয়ে যেতে হয়। সে যাবার সাথে সাথে সবাই আলোচনায় বসে।

এই এলাকায় পকেটমার কে আছে। ঠান্ডু। না না সেতো গ্রামে গেছে। তাহলে সাজু বোধ হয় পকেট মেরেছে। সাজুকে ডাকা হয়। তাকে এরেস্ট করার জন্য নয়। টাকার ভাগ নেওয়ার জন্য। আর এ কারণে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ইজ্জত অনেক বেড়ে যায়? সকালে তাড়াহুড়ো করে অফিসে যাবার সময় স্কুটারওয়ালা যদি ভুলে একটু সিগন্যাল ক্রশ করে তবে মুসিব্বত এসে যায়।

স্কুটার সাইডে রাখো, লাইসেন্স দেখাও, তোমার স্কুটারে লাইট জ্বলে, হাওয়া আছে টায়ারে, পেট্রল আছে? এমনভাবে জিজ্ঞাসা করে যেন সে সিগন্যাল ক্রশ করেনি, বর্ডার ক্রশ করেছে। আর এসব আইনের জন্য করা হয় না। নিজের পকেটের জন্য করা হয়। ৫০/১০০ যা পাওয়া যায়। এসব কারণে আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ইজ্জত অনেক বেড়ে যায়।

পুলিশ স্টেশনে ধান্দাবাজ, দালাল, ক্রিমিনালদের অভ্যর্থনা করা হয়। তাদের চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়। তাতে ইজ্জত বেড়ে যায় আমাদের ডিপার্টমেন্টের? ক্রাইম যদি দিনে দিনে বেড়ে থাকে এজন্য আমরাই দায়ী। কাল যারা মানুষের পকেট কাটতো আজ তারা গলা কাটছে। এজন্য দায়ী আমরা। দুদিন আগে যারা চরস গাঁজার ব্যবসা করতো তারা আজ অস্ত্রের ব্যবসা কওে, এজন্য দায়ী আমরা। সন্ত্রাসীরা যদি সন্ত্রাস করতে করতে যদি সরকার চালানেওয়ালা হয়ে যায় এজন্য দায়ী আমরাই।

প্রত্যেক মাসের ১ তারিখে বেতন নিতে চলে আসি। কিন্তু সে টাকা কোথা থেকে আসে? সরকার থেকে? মন্ত্রী এমপি থেকে? না, এই টাকা জনগণের। যে জনগণের সাথে আমরা সুন্দরভাবে কথাও বলি না। জনগণ দেশের হেফাজতের জন্য বর্ডারে জোয়ান রেখেছে আর জানমালের জন্য আমরা। জোয়ানরা তো দেশের হেফাজত করছে। কিন্তু আমরা?

দেশের জন্য জোয়ানরা যখন শহীদ হয়, জাতি কাঁদে। কিন্তু একজন পুলিশ মারা গেলে জনগণ খুশি হয়। বলে, ভালো হয়েছে! একজন ঘুষখোর কমে গেল। নাহ! আমাদের এই সিচুয়েশন বদলাতে হবে। যেন জনগণ বলে পুলিশ ভালো। সুন্দর সুন্দর কথা দেয়ালে লিখে প্রচার করলে হবে না। আমাদের কিছু করতে হবে। পুলিশের পোশাকের শক্তি বোঝাতে হবে। সে পকেটমার হোক, ভূমিদস্যু হোক, কালো টাকার পাহাড় হোক, যে কেউ হোক।

ভারতের পুলিশের সাথে বাংলাদেশের পুলিশের বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। বরং দু ডিগ্রি বাড়িয়ে। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন গুম, ক্রশফায়ার, বিনাদোষে নিরপরাধ মানুষকে আটক করে হাজত বাস এগুলো নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। এগুলোতে পুলিশের ইমেজ নিশ্চয় নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশের সুনাম কোনোদিনই ছিল না।

তাদের কাছে অস্ত্র আছে, আইনও আছে। এই দুই শক্তি তাদের বেপরোয়া করেছে। তাই পুলিশ যে সব অপকর্ম করে তার সবই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হুকুমে করে তা সর্বাংশে সত্য নয়। বরং তারা তাদের গাড়ি-বাড়ি আর সম্পদের নেশায় করে আর সূযোগম ক্ষমতাসীনদের ব্যবহার করে। তাই বলে পুলিশের অর্জন কম তা নয়। বহু জটিল মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে তারা।

তাছাড়া শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তি পাওয়ার সংখ্যা অন্য যে কোনো বিভাগের চেয়ে বেশি। তারপরেও পুলিশ জনগণের বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। মাঝে মাঝে পুলিশ প্রধানদের বলতে শোনা যায়, পুলিশকে গণমুখী করে সাজানো হচ্ছে, উচ্চ শিক্ষিতদের পুলিশে নেওয়া হচ্ছে, উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, থানায় কাউকে ঘুষ দেবেন না, অপরাধ দমনে পুলিশকে বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে কোনো অপরাধীকে ছাড় দেওয়া হবে না ইত্যাদি।

কিন্তু সবই অরণ্যরোদন। পরিবর্তন হয় না বরং পুলিশি অপরাধ বাড়তেই থাকে। তাই পুলিশ প্রধানকে আমার বিনীত অনুরোধ সানি দেওলের মত একবার গর্জে উঠুন। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছু করুন। অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে পুলিশের পোশাকের শক্ত বোঝানোর জন্য দৃষ্টান্তমুলক ভূমিকা রাখুন।

ইতোপুর্বে পুলিশের ভুলের কারণে বিনাদোষে জেলখানার সাজা ভোগ করার ঘটনা অনেক। তার বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। বিনা অপরাধে যে কয়টি দিনই তারা জেলখানায় আটক থাকুক না কেন তা তাদের জীবনে কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে এবং এ সময়ে তার যে মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি হবে তার ক্ষতিপূরণ করার ক্ষমতা পুলিশের কেন কারোরই নেই।

সাম্প্রতিককালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের সাথে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তা পুলিশ কল্পনা করতে পারেনি। বাংলাদেশ রেকর্ড হয়ে গেছে যে, পুলিশ নিজের ও থানার নিরাপত্তা নিজেরাই দিতে পারেনি। নিরাপত্তা দিতে হয়েছে সেনাবাহিনীকে।

এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে বা কারা সেটা কোনো পুলিশের অজানা নয়। আগামীতে এমন পরিস্থিতির যেন উদ্ভব না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। জনগণের শক্তিকে মূল্যায়ন করতে হবে। জনগণের বন্ধু হবার বিকল্প নেই। এটা প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে। আগামীতে সেটাই দেখার পালা।
লেখক : সাংবাদিক

Exit mobile version