প্রতিটি ধাপে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্তই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়েছে তামিমকে

আপডেট: মার্চ ২৫, ২০২৫, ১২:০৪ অপরাহ্ণ

ছবি: বিসিবি।

সোনার দেশ ডেস্ক :


তখন প্রায় মাঝরাত। কেপিজে স্পেশালাইজড হাসপাতালের সিসিইউ থেকে বেরিয়ে এলেন তামিম ইকবালের “ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু, যিনি পরিবারের সদস্যের মতোই। বাইরে এসে তিনি বললেন, “তামিম ডিনার করেছে, কথা বলছে, হাসছে, আমাদের সঙ্গে মজা-টজাও করেছে কিছুটা। বড় একটা বিপদ গেছে, এটা বুঝতে পারছেৃ।” পাশ থেকে একজন চিকিৎসক যোগ করলেন, “বিপদ কিন্তু এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নিৃ।”

এখনও তামিমকে পর্যবক্ষণে রাখা হয়েছে। পুরোপুরি বিপদমুক্ত বলার উপায় নেই এখনও। তবে সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে ঝড় বয়ে গেছে, সেই তুলনায় রাতে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারছিলেন হাসপাতালে থাকা তামিমের পরিবারের সদস্যরা ও বন্ধুরা। গোটা দিনে পেছন ফিরে তাকিয়ে যেমন তারা শিউরে উঠছিলেন, তেমনি সবাই বারবার বলছিলেন, অনেকগুলো মানুষ মিলে সবকিছু একদম সময়মতো ঠিকঠাক করতে পেরেছেন বলেই মৃত্যুর দুয়ার থেকে তামিমকে ফেরানো সম্ভব হয়েছে।

সেই মানুষগুলোর মধ্যে কেপিজে হাসপাতালের চিকিৎসক দল যেমন আছে, তেমনি মোহামেডানের ট্রেনার, বিকেএসপির চিকিৎসক থেকে শুরু করে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার, ম্যাচ রেফারি, সবাই দারুণ আন্তরিকতা, অসাধারণ দক্ষতা ও বিপদের মধ্যে মাথা ঠাণ্ডা করে নিজেদের কাজ করতে পারাতেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরেছেন তামিম। তার পরিবারের সবার মুখে মুখে এই মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা।

সকালে বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসার পর তামিম নিজেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। হেলিকপ্টার ব্যবস্থা করা, নানা জায়গায় যোগাযোগ করেছেন নিজেই। পরে মাঠে ফিরে গিয়ে পরিস্থিতি খারাপ হলে তিনি যখন অচেতন হয়ে পড়েন, তার পরিবারের আতঙ্কের সময় শুরু তখন থেকেই।

মাঠ থেকে ও পরে হাসপাতাল থেকে নানা জনে ফোনে পরিবারের সদস্যদের যেরকম খবর দিয়েছেন, তাতে তারা প্রচণ্ডরকম ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ওই সময় পরিস্থিতিই ছিল এমন। তামিমকে নিয়ে তখন আক্ষরিক অর্থেই চলছে যমে-মানুষে টানাটানি। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন, তারা ভয়ানক কোনো পরিণতির শঙ্কায় ডুবে গিয়েছিলেন।

তারা যখন ঢাকার নানা প্রান্ত থেকে হাসপাতালে ছুটে আসছেন, তখন তামিমের পাশে থাকা লোকগুলোর লড়াই চলছে। যে ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন তামিম, বিকেএসপির সেই ম্যাচের ম্যাচ রেফারি দেবব্রত পাল একদম অভিভাবকের মতোই সব ধরনের যোগাযোগ করা থেকে শুরু করে তাৎক্ষনিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন। বিকেএসপির চিকিৎসকরা তাদের সাধ্যমতো করেছেন।

হেলিকপ্টারে ঢাকায় উড়িয়ে আনার বদলে যখন তামিমকে কেপিজে হাসপাতালে আনার সিদ্ধান্ত হলো, চালক তখন ঝড়ের বেগে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। বিশেষ করে, রাস্তায় দারুণ দক্ষতায় তিনি এমন একটি বাঁক নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে এনেছেন, যা কয়েক মিনিট সময় বাঁচিয়ছে। প্রতিটি মিনিট তখন মহামূল্য। চিকিৎসকরা ও সেখানে উপস্থিত সবাই দারুণ প্রশংসা করেছেন চালকের ভূমিকার।

পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন মোহামেডানে ট্রেনার ইয়াকুব চৌধুরি ডালিম। তিনি টানা সিপিআর দিয়ে গেছেন তামিমকে, বুকে পাঞ্চ করেছেন বারবার। সামাজিক মাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ২৫০-৩০০ সিপিআর চেস্ট কমপ্রেশন করার পর তামিমের নিথর দেহে একটু সাড়া মিলেছে। এক পর্যায়ে তামিমের মুখ দিয়ে যখন ফেনা পড়তে শুরু করেছে, তখন তিনি ‘মাউথ টু মাউথ রিসাসিটেশন’ দিয়ে গেছেন ক্রমাগত।
কেপিজে হাসপাতালের চিকিৎসক পরে তামিমের পরিবারের সদস্যদেরকে বলেছেন, ডালিম ওই কাজগুলি নিখুঁতভাবে করতে না পারলে তামিমকে বাঁচানো যেত না।

হাসপাতালে আগেই যোগাযোগের কারণে চিকিৎসক দল নিচেই অপেক্ষায় ছিলেন। দ্রুতই তামিমকে নিয়ে যাওয়া হয় ভেতরে। তার পরের ঘটনাক্রম অনেকেই জানেন এখন। তামিমের হার্টে রিং পরানোর সিদ্ধান্তটি ফোনেই দিয়েছেন তার বড় ভাই নাফিস ইকবাল। আর কোনো বিকল্প ভাবার সময়-সুযোগ ছিল না। পরিবারের নানাজনের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য সময়ক্ষেপণ করেননি তিনি। এটাও মূল্যবান সময় বাঁচিয়েছে।

হৃৎরোগবিশেষজ্ঞ ডা. মনিরুজ্জামান মারুফ ও সেখানকার প্রশিক্ষিত দল দ্রুততম সময়ে দারুণ দক্ষতায় এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি ও স্টেন্টিং সম্পন্ন করতে পেরেছেন। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের অভিজ্ঞ ও সিনিয়র একজন অধ্যাপক পরে গিয়েছিলেন কেপিজে হাসপাতালে। সবকিছু জেনে, শুনে ও খতিয়ে দেখে পরে তিনি ডা. মনিরুজ্জামানকে বলেছেন, “তুমি ও তোমার দল যা করেছো, সেটাকে মিরাকল বললেও কম বলা হয়ৃ।”

তামিম অচেতন হওয়ার পর থেকে হাসপাতালে তার রিং পরানো পর্যন্ত, প্রতিটি পদক্ষেপে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কোনো একটি পর্যায়ে কয়েক মিনিট দেরি হলেও ভয়াবহ কোনো বিপদ হতে পারত। প্রতিটি প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত মানুষগুলো এতটা নিখুঁতভাবে সবকিছু করেছেন, সামান্য এদিক-সেদিক হলেও ভয়ানক কোনো পরিণতি হতে পারত।

মাঝরাত পর্যন্তও হাসপাতালে থাকা তামিমের স্বজনদের মুখে মুখে একটিই কথা, প্রতিটি ধাপে ধাপে পুরো প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত সবাই দিনজুড়ে সবকিছু শতভাগ নিখুঁতভাবে করতে পারাতেই রাতে তামিম কথা বলছিলেন, হাসছিলেন।

তামিমের মা, স্ত্রী, বড় ভাই নাফিস ইকবাল ও তার স্ত্রী, তারা সবাই ঢাকাতেই ছিলেন। দুদিন পর তাদের চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা ঈদ করতে। তামিমের অসুস্থতা তাদের সাজানো জীবনকেই প্রায় লন্ডভণ্ড করে দিয়েছিল যেন। তামিমের বাবা ইকবাল খান হার্ট অ্যাটাকেই মারা যান ২০০০ সালে।

তাকে সুস্থ করে তোলার খুব বেশি সময় পাওয়া যায়নি, চট্টগ্রামে তখন চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটা উন্নত ছিল না, সামগ্রিক সচেতনতার অভাবও ছিল। বাবার সেই স্মৃতির কারণে তামিমকে নিয়ে শঙ্কা আরও বেশি পেয়ে বসেছিল সবার।

পরিবারের ছোট ছেলে হলেও দায়িত্ব নেওয়া, সবাইকে এক সুতোয় গেঁথে রাখার কাজটি তিনিই করেন। বলা যায়, পরিবারের অলিখিত কর্তা। গোটা দিনটি তাদের কেটেছে দুঃস্বপ্নের মতো। দেশের ক্রিকেটাঙ্গন তথা গোটা দেশেরও নয় কী!
এখন স্বস্তির ছোঁয়া এসেছে। অপেক্ষা আরও সুস্থ হওয়ার।
তথ্যস্রূ: বিডিনিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ