শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
মো. আবুল হাসান, খন রঞ্জন রায়
শিশুরা দেশরতœ। আজকের শিশুই আগামী দিনের শাসক, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, কলাম লেখক, সম্পাদক, আইনজীবী, সমাজসেবক। এরাই জাতির সোনালি ভবিষ্যত। বিশ্বে যখন মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয় বিশেষ করে যুদ্ধবিগ্রহ তখন কিন্তু শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শক্রর বোমা বর্ষণ, কামান, মেশিনগানের গোলায় অগণিত শিশু মৃত্যুবরণ করে এবং পঙ্গু হয়ে পড়ে। মা ও শিশুরা মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। মানবশূণ্য বিশ্বের দিকে এই গ্রহ ধাবিত হয়। ঠিক তখনই তামাম বিশ্বের কর্মধারদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলে। মানব জাতির জন্য শিশুকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় আনা হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে মানবাধিকার চরমভাবে লংঘিত হলে ১৯২৪ সালে লিগ অব নেশনস্ প্রথম শিশু অধিকারের ওপর জেনেভা কনভেনশন ঘোষণা গ্রহণ করে। অবশ্য এর আগে শিশু অধিকার সম্পর্কে বহু দেশে অনেক আলোচনা হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে ভেঙে যায় লীগ অব নেশনস।
১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করে। সেই সনদে প্রথমেই বলা হলো শিশুদের কথা। প্রতিটি শিশুরই মানুষের মতো মানুষ হওয়ার অধিকার রয়েছে। শিশুদের আহার-আশ্রয় ও সামাজিক নিরাপত্তার এমনকি যুদ্ধকালীন সর্বাগ্রে শিশুরা নিরাপত্তার অগ্রাধিকার পাবে। যুদ্ধকালীন এতিমখানা, শিশু সদন, শিশু হাসপাতাল, বিদ্যালয়ে কোনো প্রকার আক্রান্ত করা যাবে না মর্মে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও সামাজিক ক্ষেত্রে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের নিশ্চয়তা করা। অগণিত, অসহায় অবহেলিত শিশুর সব রকমের সমস্যা সমাধান হওয়া সহ জাতিসংঘ ঘোষিত সনদে শিশুর বেশ কয়েকটি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়।
শিশুদের এই মৌলিক অধিকারগুলোর সাথে বিশ্বের সমাজ সচেতন মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করেন। বিভিন্ন সমাজ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর ভবিষ্যত নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রয়োজন অনুভব করে। এ লক্ষ্যেই গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক শিশু কল্যাণ ইউনিয়ন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর চাইল্ড ওয়েলফেয়ার বা ইউনিসেফ) ১৯৫২ সালে বিশ্বব্যাপি শিশু দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ইউনিসেফ। ১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ গ্রহণ করে শিশু অধিকার ঘোষণা। এই ঘোষণা তখন জাতিসংঘের ৭৮টি দেশ গ্রহণ করে সনদে অনুস্বাক্ষর করে। সময়ের সাথে সাথে শিশু অধিকারের প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে। শিশু অধিকার সনদে সংযুক্ত ৫৪টি ধারা সম্পর্কে দশ বছর ধরে আলোচনার পরেই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয় এই সনদ। এতে ১৮ বছর পর্যন্ত সব ছেলে মেয়েকে শিশু-কিশোর হিসাবে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ পূর্ণবয়স্ক হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত সবাই শিশুদের এই বিশেষ অধিকারগুলো ভোগ করতে পারবে।
এরপর থেকে তামাম বিশ্বের শিশুদের শান্তিকালীন যেমন নিরাপত্তা লাভ করে তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগে, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, সুনামি, মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, সড়ক, রেল, বিমান, নৌ দুর্ঘটনা, ভূমিধস, ভবন ধস, সামরিক অভ্যূত্থান, গৃহযুদ্ধ, আন্তর্জাতিক যুদ্ধে নিরাপত্তা লাভ করতে থাকে। ১৯২৪ সালে লিগ অব নেশন, ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ, ১৯৫২ সালে শিশু অধিকার সনদ প্রতিষ্ঠার পর থেকে শত কোটি শিশুর জীবন রক্ষার পাশাপাশি গর্ভবতী মা ও প্রসূতি মা-শিশুরা নানানভাবে সহযোগিতা পেয়ে অনেক শিশু আলোকিত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠেছে। মানবকল্যাণের সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ও নৃশংসতম হত্যাকা-টিও ঘটেছিল রাতের বেলা। এই পবিত্র ভূমিতে যে হত্যাকা-ের নির্মম বলি জাতির জনক পরিবারের শেষ বংশধর শেখ রাসেল। ১৮ অক্টোবর ১৯৬৪ ছিল শেখ রাসেলের জন্ম হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ শিরোনামে একটি লেখায় লিখেছেন, “আমার মেজো ফুফু ঘুম ভাঙ্গিয়ে বললেন, জলদি ওঠো তোমার ভাই হয়েছে।
জন্মের পর ওকে আমার মনে হয়েছিল একটি পুতুল। কী সুন্দর হাসে, আবার কাঁদেও। রাসেল একটু একটু করে বড়ো হয়ে ওঠে। মা ও আব্বা নাম রাখলো রাসেল”। ছোটবেলায় রাসেল তার বন্ধুদের নিয়ে সাঁতার কাটা, শান্তির প্রতীক কবুতর পালা, ফুটবল খেলা ইত্যাদিতে মেতে থাকতো। ১৯৭৫ সালে তার হাসু আপুর সাথে রাসেলের জার্মানি যাওয়ার কথা ছিল। জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ায় তার যাওয়া হয়নি। যদি সেটি হত তাহলে আজ বাংলাদেশ তাকে হারাতো না। ঘাতকের নির্মম বুলেট বুক বিদীর্ণ করতো না। বাবা তাঁর প্রিয় মানুষ দার্শনিক বাট্টান্ড রাসেলের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রেখেছিলেন শেখ রাসেল। কিন্তু ঘাতকের পৈশাচিকতায় শিশু রাসেল বড় হয়ে, বড় কিছু হওয়ার সুযোগ পায়নি।
বর্তমানে রাসেলের নাম কালো শোকে মোড়া চাদরে জড়িয়ে আছে। মানব ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাকা-ে নিষ্ঠুর ঘাতকের বুলেটে সেদিন শেখ রাসেলকে নিমর্মভাবে হত্যা করে। ওই সময়ে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ১০ বছর। রাসেল বেঁেচ থাকলে সমাজ একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, সুশিক্ষিত আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল প্রকৃতির একজন মানুষ পেতো। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে সে হয়তো অনেক কিছুই করতে পারত।
ঘাতকরা সেইদিন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলÑ রাসেলের ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত। রাসেল এত দিন বেঁচে থাকলে হয়ে উঠতে ৫৩ বছরের একজন পূর্ণ মানুষ। আজকে যে হাসু আপু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেই স্থান হয়তো রাসেল দখল করে নিতেন। বাংলার সিংহাসনে বসে দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সোনার বাংলা নিজের মত করে গড়ে তুলতেন। অবশ্য বয়সের যাত্রায় তেমনটা পেরে উঠতে পারেনি রাসেল। ঘাতকের বুলেট স্তব্ধ করে দিয়েছে তার দুরন্ত পথচলা, মুখফোঁটা হাসি। তাও প্রায় ৪২ বছর হলো। কত দীর্ঘ সময়, কেমন দ্রুতই চলে যায়, আবার কেমন যেন আটকে থাকে ঠিক সেই একই জায়গায়। এই ৪২ বছর অবশ্য পাল্টে গেলে পৃথিবীর অনেক কিছুই, মুছে গেলে রাসেলের গা থেকে চুইয়ে পড়া তাজা রক্তের দাগ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বাঙালি আত্মভোলা জাতি। এ দেশে কত জানা-অচেনা মানুষের নামে রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে। শেখ রাসেলের নামে অদ্যবধি কোন বিমানবন্দর, মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় নাই।
রাজধানী লাগোয়া জনপদ নরসিংদীতে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল কয়েক হাজার বছর আগে। নরসিংদীতে আবিষ্কৃত ওয়ারী বটেশ্বরের প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশন প্রমাণ করে হাজার হাজার বছর আগেও এই জনপদে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। মধ্যযুগেও নরসিংদী মসলিন উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। এখনো এ জেলার গুরুত্ব দেশের বস্ত্রশিল্পের ‘রাজধানী’ হিসেবে। নরসিংদীতে জন্মগ্রহণ করেছেন দেশসেরা কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও গুণিজনরা। মুক্তিযুদ্ধে দেশের যেসব এলাকা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তার সামনের কাতারে রয়েছে এ জেলার নাম। জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সচিব মোশারফ হোসেন দীর্ঘ একদশক সুনিপুণ হাতে প্রশাসন পরিচালনা করেছেন। যোগাযোগ সচিব এমএন সিদ্দিক ভঙ্গুর রাস্তাঘাটগুলোতে শ্রী দিয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হীরু বীরপ্রতিক এমপি, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে, খাল বিল, নদী নালা, সাগরের পানি, সুস্থ ব্যবস্থাপনায় কৃষি, শিল্পে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন এতে দেশের মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টু-টার্ম ভিসির দায়িত্ব পালন করে বর্তমান সরকারকে স্থিতিশীল রাখতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এমপি শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে নরসিংদী জেলাবাসীকে গৌরবান্বিত করছেন। নরসিংদী জেলায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় নাই। বঞ্চিত জেলা হিসাবে শেখ রাসেল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সর্বময় সুযোগ নরসিংদীবাসী গ্রহণ করতে পারে। আর তা যদি সম্ভব হয় তবে শেখ রাসেলের রক্তের সামান্যতম ঋণ শোধ করার শিক্ষাক্ষেত্রে উন্মোচন হবে। বিস্মিত জাতির কালিমা থেকে কিছুটা হলেও দায় মুক্তি পাব। আমরা এই সুযোগটির অপেক্ষোয় রইলাম।
লেখকদ্বয় : আহবায়ক ও সদস্যসচিব, বিশ্ববিদ্যালয় বঞ্চিত জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন পরিষদ
কযধহধৎধহলধহৎড়ু@মসধরষ.পড়স