বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
সোনার দেশ ডেস্ক
ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনে সাম্যবাদী বিশ্বের স্বপ্নবাজরা অনুপ্রেরণা খুঁজলেও তার সমালোচকও কম ছিল না; যারা তাকে দেখত একনায়ক, স্বৈরশাসক হিসেবে।
প্রশংসা আর নিন্দা নিয়েই পাঁচ দশক কাল যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানি ও সর্ব উপায়ের বিরোধিতা মোকাবেলা করে কিউবায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখেন তিনি।
শনিবার তার জীবনের অবসান হলেও এই বিপ্লবীর জীবন-কর্ম নিয়ে আলোচনার অনন্ত এক যাত্রার শুরু হল। বিশ্বনেতাদের মধ্যে তার শত্রু ও মিত্রদের কাছে কেমন ছিলেন ফিদেল- মৃত্যুর পর তা তুলে এনেছে রয়টার্স।
বন্ধুর চোখে ফিদেল
ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট উগো চাবেস ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে এক ভাষণে বলেন, “আমার কাছে ফিদেল একজন গ্রান্ড মাস্টার। এমন বিজ্ঞ এক মানুষ যার কখনও মৃত্যু নেই; ফিদেলের মতো মানুষ কখনও মরে না। কারণ তিনি সব সময় মানুষের অংশ হয়েই থাকবেন।”
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯১ সালের জুলাইতে এক ভাষণে বলেন, “শুরুর দিন থেকেই কিউবা বিপ্লব সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছে। কিউবা বিপ্লবের অসাধারণ শক্তিকে নস্যাৎ করতে ক্রুর সাম্রাজ্যবাদী নীল নকশার মুখে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে কিউবার জনগণের আত্মত্যাগকে আমরা ভালোবাসি। কিউবা বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! কমরেড ফিদেল কাস্ত্রো দীর্ঘজীবী হন!”
কাস্ত্রোর ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে নোবেলজয়ী গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ গ্রানমায় লেখেন, “ফিদেল কাস্ত্রো আছেনই জয়ের জন্য। এমনকি দৈনন্দিন জীবনে সবচেয়ে ছোট কাজেও পরাজয়ের মুখে তার মনোভাব দেখে বোঝা যায়, তিনি তা মানতে পারেননি। ওই পরিস্থিতিতে জয়ী হওয়া পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত দিতেন না।”
“১৯৫৬ সালে ১৮ ডিসেম্বর ফিদেল ও আমি সিয়েরা মায়েস্ত্রার পাদদেশে চিংকো পালমাস নামে এক জায়গায় ছিলাম। আমাদের প্রথম আলিঙ্গনের পর তার প্রশ্ন ছিল: ‘তোমার কাছে কয়টা রাইফেল আছে?’ আমি উত্তর দিলাম, পাঁচটি। তখন তিনি বললেন, ‘আমার কাছে আছে দুটি। সব মিলে সাতটি হল। এখন আমরা যুদ্ধে জয়ী হতে পারি,” ২০০৯ সালে লুই বায়েজের লেখা ‘দিস ইজ ফিদেল’ বইতে ভাই রাউল কাস্ত্রোর উক্তি।
আর্নেস্তো চে গেভারা ১৯৫৫ সালে বাবা-মাকে লেখা এক চিঠিতে বন্ধু ফিদেলকে পরিচয় করিয়ে দেন এভাবে- “এক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যে কোনো বিপ্লবে যোগ দিতে আমার পেছনে ততটা কারও খাটতে হয় না। কিন্তু ফিদেল আমাকে ‘অসাধারণ মানুষে’ পরিণত করেছে। তার এক ব্যতিক্রমী বিশ্বাস ছিল, আমরা একবার (মেক্সিকো থেকে) কিউবার উদ্দেশে বের হলে সেখানে পোঁছাবই। আর একবার পৌঁছে গেলে লড়াই শুরু হবে। লড়াই শুরু হলে আমরা জিতবই। আমি তার এই আশাবাদ ধারণ করেছিলাম। লড়াই করতে, জিততে আমাকে তা ধারণ করতে হয়েছিল। কেঁদো না, লড়াই কর।”
হাভানায় অ্যাঙ্গোলা যুদ্ধে ফিদেলের নির্দেশনার বিষয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওপলদো সিন্ত্রা ফ্রায়াস বলেন, “কোথায় কামান বসাতে হবে, ট্যাংক সরিয়ে কোথায় রাখতে হবে তিনি বলে দিতেন। কোথায় হামলা চালাতে হবে, কীভাবে, কয় জনকে নিয়ে- ইত্যাদি বিস্তারিত বলে দিতেন তিনি। এগুলো সব ছিল তার আঙ্গুলের ডগায়। এবং বেশিরভাগ সময়েই তিনি সঠিক ছিলেন।”
শত্রুর চোখে
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির চোখে ফিদেল ‘দক্ষিণ আমেরিকার একজন একনায়কের চেয়েও বেশি কিছু’।
“কাস্ত্রো একজন পাতি স্বৈরশাসক, যিনি শুধু নিজের ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও অর্জনের কাছে নত। তার উচ্চাভিলাষ তার নিজের ভূমি ছাড়িয়ে দূরবিস্তারী।”
১৯৬২ সালে প্রকাশিত জেরাল্ড সি গার্ডনার সম্পাদিত ‘দ্য কোটেবল মি. কেনেডি’তে এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডির মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে।
“ফিদেল কাস্ত্রো আমেরিকানদের অবৈধভাবে হত্যা করেছেন, যেটা ভুলও ছিল। নিষ্পাপ আমেরিকানদের হত্যাকারী মানুষের বিরুদ্ধে যে অবরোধ রয়েছে তাতে আমি খুশি,” ১৯৯৬ সালে কিউবা গুলি করে যুক্তরাষ্ট্রের চার নাগরিককে হত্যার করার পর একথা বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন।
কাস্ত্রোর সরকারবিরোধী বিক্ষোভে উসকানিদাতা কিউবান-আমেরিকান গ্রুপের দুটি বেসামরিক বিমান নিজের আকাশসীমায় পেয়ে কিউবার গুলি করে ফেলে দিলে ওই চারজনের মৃত্যু হয়।
“কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসার আগে তাকে নিয়ে হার্বার্ট ম্যাথিউয়ের প্রতিবেদনের কথা আমার মনে পড়ে, সেখানে তাকে ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘কিউবার আশা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তোমারা যারা ওই বিষয়টি মনে রাখার মতো যথেষ্ট বড় হওনি, এমনকি আমাদের দেশেও অনেকে তাকে কিউবার জর্জ ওয়াশিংটন বলে এবং জর্জ তার কবরের ভেতরে নড়ে চড়ে উঠেন,” বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান (১৯৮৬ সালের ৫ মার্চ)।
“ফিদেল কাস্ত্রো আমাদের জন্য যে শিক্ষা রেখে গেছেন, তা হলো আমরা আর কোনো ফিদেল কাস্ত্রো চাই না। তার মতো একজন মানুষ পুরো জাতিকে শুষে নেন, নিজেকে মাতুভূমির প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখেন এবং স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জাতীয়তা কেড়ে নেন তিনি। ফিদেল কাস্ত্রোর শিক্ষা হলো- আর কোনো ফিদেল নয়। কিছু লোক তাকে পছন্দ করে, কারণ তারা তাকে নিজেদের মতো করে ভাবে। বাস্তবে তিনি কেমন তা তারা বিবেচনা করে না। এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা কৃতিত্বের কিছু নয়,” বিদ্রোহী ব্লগার ইউয়ানি সানচেজ ২০১৪ সালে রয়টার্সকে বলেন।
১৯৫৯ সালের ১৯ এপ্রিল কাস্ত্রোর সঙ্গে তিন ঘণ্টার এক বৈঠক শেষে স্মারক ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বলেন, “আমরা তার সম্পর্কে যা-ই ভাবি না কেন কিউবার উন্নয়নের জন্য তিনি বড় প্রভাবক হতে যাচ্ছেন এবং খুব সম্ভবত সাধারণভাবে পুরো দক্ষিণ আমেরিকার জন্য। তাকে খুব হুঁশিয়ার মনে হয়েছে। সাম্যবাদ সম্পর্কে হয় তিনি অবিশ্বাস্যরকমভাবে অনভিজ্ঞ, না হয় তিনি সাম্যবাদী শৃঙ্খলার অধীনেই রয়েছেন- আমার ধারণা প্রথমটি। আমি অন্তত অর্ধশতক দেশের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে সরকার বা অর্থনীতি পরিচালনার বিষয়ে তাদের কারও চেয়েই ফিদেলের ধারণা বেশি নয়।”
“একজন জাদুকরি ক্ষমতার বিশাল মানুষ, ফিদেল কাস্ত্রো একজন সাহসী বীর। লৌহমুষ্টির অধিকারী এক রাজনীতিবিদ। তিনি বরাবর শক্তিমান। তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ঠেলে দিয়েছেন ফায়ারিং স্কোয়াডে। আমি হয়ত তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিতাম বা নির্বাসনে পাঠাতাম। কিন্তু তিনি তাকে গুলি করে মেরেছিলেন,” রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে ১৯৮৯ সালের জুলাইতে জেনারেল আর্নালদো ওচাওকে ফিদেলের মৃত্যুদ- দেওয়া নিয়ে চিলির সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল অগুস্তো পিনোশের উক্তি।
“সারা বিশ্বের সাম্যবাদীরা যখন গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে, তখন ফিদেল কাস্ত্রো জনমতের বিরুদ্ধে চলে গেছেন এবং পেরেস্ত্রোইকা বা গণতন্ত্রের পক্ষে যে কোনো ধরনের পরিবর্তন তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। … একজন সুক্ষ্ম দার্শনিক, বস্তুগত জিনিস ক্ষণস্থায়ী- এটা তিনি এই মাত্রায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে কিউবায় কার্যত কোনো বস্তুগত জিনিস আর নেই,” ১৯৯০ সালে মৃত্যুর আগে এক লেখায় বলেছিলেন কিউবার বিদ্রোহী লেখক রেইনালদো আরেনাস।- বিডিনিউজ