মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৭ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
নাহিদ হাসান রবিন:
ইস্কাটনের এই পুরোনো বাড়িটাতে সোহাগীর কৈশোর ও যৌবন কেটেছে। কৈশোর অনেক সুখে কাটলেও যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে অবহেলা আর অনাদরে। একসময় এই বাড়িটা সোহাগীর নিজের নামে ছিল। ভাগ্য ছিনিয়ে নিয়েছে সোহাগীর কাছ থেকে এই বাড়িটি। সোহাগীর বড় চাচা তোজাম আলীর কোনো সন্তান না থাকায় সোহাগীকে পাঁচ দিনের শিশু অবস্থায় লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। গ্রামের বাড়ি পাবনা থেকে সোহাগীকে নিয়ে যান তার কর্মস্থল ঢাকাতে। তোজাম আলী ঢাকায় একটা কোম্পানীতে চাকরি করতেন। তোজাম আলীর বউ ঝরনা খাতুনের কোনো সন্তান না থাকায় তিনি সবসময় মন মরা হয়ে থাকতেন। সোহাগীকে পেয়ে তার মুখে হাসি
ফোটে। পনেরো বছরের সন্তানহীন ঘর পূর্ণ করেছে সোহাগী। ঝরনা খাতুন আর তার স্বামী কতো আদরই না করেন সোহাগীকে। তোজাম আলী অফিস শেষে আর বাইরে থাকেন না, সোজা বাড়ি চলে আসেন। সোহাগীর সাথে কত রকম খেলাই না খেলেন। ড্রইংরুমটা নানারকম খেলনা দিয়ে ভরে রেখেছেন। ঢাকা শহরে থাকলেও দু’চারজন
প্রতিবেশির সাথে ঝরনা খাতুনের সখ্য আছে, সোহাগীকে নিয়ে তাদের সাথে কত কথাই না বলেন। নতুন বাবা-মায়ের আদরে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে সোহাগী।
সোহাগী এখন স্কুলে যায়। তোজাম আলী একদিন অফিস থেকে ফিরে ঝরনা খাতুনকে বললেন ইস্কাটনে একটা বাড়ি বিক্রি হবে। বাড়িওয়ালা আমার পরিচিত। আমাদের তো কিছু জমানো টাকা আছে, বাড়িটা কিনলে কেমন হয়। দেখো তুমি যা ভালো মনে করো।
পরদিন অফিস থেকে ফিরে ঝরনা খাতুনকে সাথে নিয়ে বাসা দেখতে যান। ইস্কাটনের মেইন রোড থেকে একটু ভিতরে গেলেই দোতলা একটা পুরোনো বাড়ি। বাসাটা সবারই পছন্দ হয়। তোজাম আলী দশ লক্ষ টাকা দিয়ে সোহাগীর নামে বাসাটা কিনে দেন। ওরা ভাড়া বাসা ছেড়ে নিজেদের বাসাতে ওঠেন। সংসার সন্তান নিয়ে সুখ
স্বাচ্ছন্দে কাটতে থাকে তোজাম আলীর জীবন। কয়েক বছর পরের কথা। তোজাম আলী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার জানান ব্লাড ক্যান্সার। তোজাম আলী জানেন এ রোগ সারবে না। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। একদিন ঝরনা খাতুনকে বলেন আমার আয়ু মনে হয় শেষ হয়ে আসছে। দেশের বাড়িতে যা জমি জমা আছে আর ব্যাংকে কিছু টাকা আছে ভাবছি তোমার আর সোহাগীর নামে লিখে দেবো। স্বামীর এমন অবস্থা দেখে ঝরনা খাতুন অপলক চেয়ে থাকেন তার দিকে। কয়েকদিন পর ব্যাংকের টাকা আর গ্রামের বাড়ির কয়েক বিঘা জমি লিখে দেন ঝরনা খাতুন ও সোহাগীর নামে। এর কয়েকদিন পরেই তোজাম আলী মারা যান।
স্বামী মারা যাবার দু’বছর পর ঝরনা খাতুন আবার বিয়ে করেন। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় ঝরনা খাতুনের কোল জুড়ে আসে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান। ঝরনা খাতুনের স্বামী জলিল মিঞা পুত্র জন্ম নেওয়ার আগে যেটুকুও বা দেখতে পারতেন সোহাগীকে, পুত্র জন্ম নেবার পরে একেবারেই দেখতে পারেন না। জলিল মিঞা ব্যাবসা করেন। সন্ধ্যার পর বসেন জুয়ার আসরে। আসর শেষে নেশা করে গভীর রাতে বাড়ি ফেরেন। তারপর অকারণেই সোহাগীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। ঝরনা খাতুন সোহাগীকে পেটে না ধরলেও ওকে মায়া মমতা দিয়ে লালন করেছেন, তাই স্বামীর এমন আচরণে অনেক কষ্ট পান।
সোহাগীর প্রতি এমন অনাদর দেখে ঝরনা খাতুন সোহগীকে তার মায়ের কাছে রেখে আসেন। নিজের মেয়ের পেটের সন্তান না হলেও সোহাগীর নানী খুব আদর করেন। মামারাও অনেক আদর করেন। ওর বড় মামা পড়াশোনার খরচ বহন করেন। মাঝে মাঝে ঝরনা খাতুন মায়ের বাড়ি আসলে সোহাগীর সাথে দেখা হয়। স্বামীকে লুকিয়ে সোহাগীর জন্য নানান জিনিসপত্র নিয়ে আসেন। বছরে দু’একবার মায়ের সাথে দেখা হওয়ায় সোহাগীর মনে যেন আনন্দের শেষ থাকে না।
সোহাগী এবার আইএ ফাইনাল দিয়েছে। দীর্ঘ ছুটি পেয়ে মায়ের কাছে যায়। জলিল মিঞা সোহাগীর সাথে তেমন একটা কথাবার্তা বলেন না। একরাতে সোহাগী খেয়াল করে এই বাড়িটা জলিল মিঞা তার নামে লিখে দিতে বলে। ঝরনা খাতুন না করলে তার উপর জলিল মিঞা অত্যাচার চালায়। যে মা তাকে লালন পালন করেছেন তার উপর এমন অত্যাচার দেখে সহ্য করতে পারে না সোহাগী। পরদিন সকালে জলিল মিঞাকে ডেকে বাড়ি, ব্যাংক ব্যালান্স, গ্রামের বাড়ির জমি সব লিখে দিতে চায় তাকে। জলিল মিঞা বলে তাহলে চল আজই সব কাগজ ঠিক করে ফেলি। বাড়ি, টাকা জমি সব লিখে দিয়ে সোহাগী চলে আসে তার আসল বাবা-মায়ের কাছে। দুনিয়ার কোনো জায়গাতে ঠাঁই না হলেও নিজের বাবা-মায়ের কাছে ঠিকই জায়গা হয়। এবার যেন সোহাগী হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
দীর্ঘদিন হয় ঝরনা খাতুনের সাথে সোহাগীর দেখা হয় না। ওখান থেকে চলে আসার পর একবার মাত্র দেখা হয়েছিলো। প্রথম দিকে ঝরনা খাতুন মাঝে মাঝেই ফোন করতেন। বেশদিন হয় ফোনও করেন না। নিজের মা-বাবার কাছে অনেক আদরে থাকলেও ঝরনা খাতুনের কথা সোহাগী ভুলতে পারে না। ভুলতে পারে না তার পালক পিতা তোজাম আলীর কথা। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে কি এমন অবস্থা হতো! কিছুদিন পর ধুমধাম করে সোহাগীর বিয়ে হয়। বিয়ের সময় ঝরনা খাতুন ও তার স্বামীকে দাওয়াত করা হয়েছিল, আসেন নাই। পরে জানা গেছে ঝরনা খাতুন আসতে চাইলেও জলিল মিঞা আসতে দেয়নি।
সোহাগী এখন স্বামীকে নিয়ে ঢাকায় থাকে। জামাই একটা কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার। ভালো বেতন পায়। ছুটির দিনে মাঝে মধ্যেই সোহাগীকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। একদিন ওরা রামপুরা থেকে ধানমন্ডি লেকে বেড়াতে যাওয়ার সময় ইস্কাটন হয়ে যাচ্ছিল। ইস্কাটনের মোড়ে এসেই সোহাগীর মনে পড়ে সেই ফেলে আসা দিনগুলির
কথা। ড্রাইভারকে ডানের গলিতে ঢুকতে বলে। সেই পরিচিত জায়গা যেখানে সোহাগীর অনেকগুলো বসন্ত কেটেছে। দোতলা বাড়িটার সামনে গিয়ে ড্রাইভারকে থামতে বলে। গাড়ির জানালা দিয়ে দোতলার দিকে তাকায়। বাড়িটা অনেকদিন রঙ করা হয়নি কেমন শ্যাওলা ধরেছে। বারান্দায় বসে কি যেন সেলাই করছেন ঝরনা খাতুন, পাশে ইজিচেয়ারে বসে সিগারেট টানছেন জলিল মিঞা। সোহাগীর খুব ইচ্ছে করছিল মায়ের সাথে দেখা করতে। কি ভেবে আর দেখা করে না। গেটের দিকে তাকায়। যেখানে শ্বেতপাথরে লেখা ছিল সোহাগী ভবন, সেই জায়গাটাতে লেখা মিঞা বাড়ি। জানালার গ্লাস উঠিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ড্রাইভারকে সামনে চলতে বলে। দোতলা পুরোনো বাড়িটা পেছনে রেখে গাড়ি চলতে থাকে সামনের দিকে। মসোহাগীর খু-উ-ব বেশি মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলির কথা।