বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন : স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদিন

আপডেট: মার্চ ১৭, ২০২৩, ১২:২৩ পূর্বাহ্ণ

প্রফেসর আবদুল খালেক*:


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদিন আজ যেন এক সূতোয় গাঁথা পড়ে গেছে। কোন কিছুকেই এখন আর বিচ্ছিন্ন করে দেখবার পথ নেই। ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ মুজিব জন্মগ্রহণ করেন। শেখ মুজিবের জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না, এটি শুধু আবেগের কথা নয়, ঐতিহাসিকভাবে সত্য। অতীত ইতিহাসের কিছু পাতা উলটালেই তার সত্যতা মিলবে। প্রাচীন ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বাঙালি জাতি মূলত ভাষা ভিত্তিক জাতি। এখন থেকে, আনুমানিক হাজার বছর আগে বঙ্গভাষাভাষী একটি জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে বাঙালি জাতি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল আর সে হিসাবে বাঙালি জাতি হাজার বছরের পুরাতন এক ঐতিহ্যবাহী জাতি। অতি প্রাচীনকালে ‘বং’ ভাষাভাষী এক জনগোষ্ঠী যে এলাকায় বসতি স্থাপন করে, সেই এলাকা ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করে ‘বং’ জনপদ নামে। ‘বং’ জনপদের পাশাপাশি আরও কিছু জনপদ গড়ে উঠেছিল, যেমন গৌড়, রাঢ়, পুন্ড্র, সূহ্ম, তাম্রলিপ্ত, সমতট ইত্যাদি। জনপদগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত শক্তির লড়াই হয়েছে, সে লড়াইয়ে ধীরে ধীরে ‘বং’ জনপদ অন্যান্য জনপদের উপরে আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে সমর্থ হয়। কালের গতিধারায় ‘বং’ জনপদ অন্যান্য জনপদকে এক পর্যায়ে গ্রাস করে ফেলে। সেই ‘বং’ জনপদেরই বিবর্তিত রূপ ‘বংআল>বাংআল, বাংআলদেশ এবং সবশেষে বাংলাদেশ। একই ধারায় বংআলদের বংআল ভাষার বিবর্তিত রূপ বংআল ভাষা তথা বাংলা ভাষা এবং বংআল জাতির বিবর্তিত রূপ বংআলী জাতি তথা বাঙালি জাতি। অঞ্চলটি একসময় বঙ্গদেশ বলেও পরিচিতি লাভ করেছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালের আগে এই বঙ্গদেশটি কখনও স্বাধীনতার মুখ দেখেনি।
অতীত ইতিহাস পাঠে আরও জানা যায় বাংলাদেশের ঊর্বর মাটি বিদেশীদের কাছে ছিল অতি লোভনীয়। যে কারণে যুগ যুগ ধরে দেশটি বিদেশীদের হামলার শিকার হয়েছে। কতিপয় উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যায়। আনুমানিক নবম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশ সেন শাসকদের দখলে ছিল। সেনেরা ছিলেন বহিরাগত এবং তাঁদের মাতৃভাষা ছিল সংস্কৃত। দেশটি দখল করবার পরপরই সেনেরা নিজেদের মাতৃভাষা সংস্কৃত ভাষাকে এ দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়। তৎকালীন বঙ্গদেশের বঙ্গভাষাভাষী মানুষ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সংস্কৃত ভাষা চর্চা করতে বাধ্য হয়। আনুমানিক ১২০১/১২০২ সালের দিকে সেন শাসনের অবসান ঘটে। শুরু হয় তুর্কী, আরব, পারস্য দেশ থেকে আগত মুসলিমদের শাসন। মোটামুটিভাবে বলা যায় এয়োদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশ মুসলিম শাসকদের দখলে ছিল। মুসলিম শাসকেরা সংস্কৃত ভাষার জায়গায় নিজেদের ফারসি ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা হিসেবে চালু করেন। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ পুনরায় জীবন-জীবিকার স্বার্থে ফারসি ভাষার চর্চা শুরু করে। মুসলিম বাদশাহ্দের শাসন চলে মোটামুটি ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত। এরপর বাংলাদেশের শাসনভার চলে যায় ইংরেজদের হাতে। ইংরেজদের শাসনকালে রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা করা হয় ইংরেজি। বাংলা ভাষাভাষী মানুষদেরকে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে আবার ইংরেজি ভাষা চর্চা করতে হয়। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইংরেজদের দখলে ছিল। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের বিভক্তি ঘটে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় বাঙালি জনগোষ্ঠী গভীর উৎসাহের সাথে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল এ কথা ভেবে যে, তারা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পাবে এবং যে রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ দীর্ঘ হাজার বছর ধরে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি ভাষা চর্চা করেছে বটে, তবে নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে বাঙালি জাতি কখনও বিসর্জন দেয় নি। প্রাচীন এবং মধ্যযুগে রচিত বাংলা রচনাসমূহ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ভারত বিভক্তির মাধ্যমে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তখন শেখ মুজিব কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন। কোলকাতার সিরাজদ্দৌলা হলে আয়োজিত এক সভায় তরুন ছাত্রনেতা শেখ মুজিব তাঁর বক্তব্যে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে আমাদের আশায় উজ্জীবিত হওয়ার কারণ ঘটেছে। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, সেই রাষ্ট্রের বাঙালিদের অবস্থান কি হবে, সে সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট সংশয় আছে।’ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অতি দ্রুত শেখ মুজিবের সেই সংশয় সত্য হতে দেখা যায়।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমস্যা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে যখন ঘোষণা দেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন এই ঘোষণার বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে শেখ মুজিবকে জেলে যেতে হয়। ১৯৪৯ সালের ৩রা জুন তারিখে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামের একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। দলের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। শেখ মুজিব কারারুদ্ধ থাকলেও তাঁকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক বাঙালি জাতি তার ভাষার প্রতি সবসময় আবেগপ্রবণ। নিজের ভাষার অবমাননা এ জাতি কখনও সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। নিজের মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৫২ সালে এ দেশের মানুষকে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে হয়েছে। ভাষা শহিদদের রক্তের দিকে তাকিয়ে বাঙালি জাতি নতুন করে আত্মআবিষ্কারে ব্রতী হয়। নিজেদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে ১৯৫৪ সালে গঠন করা হয় যুক্তফ্রন্ট। নেতৃত্ব দেন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা জনাব এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জনাব শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানীদের নানারকম ষড়যন্ত্রের কারণে যুক্তফ্রন্ট রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে নি। ১৯৫৮ সালে দেশে শুরু হয় আইউব খানের সামরিক শাসন। রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নেমে আসে নানারকম অত্যাচার নির্যাতন।
আইউব খান অস্ত্রের বলে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর থেকে তাঁর সামরিক শাসনের সমস্ত আক্রোশ শেখ মুজিবের উপর একে একে গিয়ে পড়তে থাকে। আইউবের এক দশকের ঊর্ধ্বকাল শাসন আমলে শেখ মুজিব প্রায় আট বছর কারাগারে আবদ্ধ থাকেন। কোনো কোনো সময় তাঁর কারাবাসের মেয়াদ এক বছরের অধিক দীর্ঘায়িত হয়। এছাড়া অসংখ্য মামলা চাপিয়ে তাঁকে হয়রানি করা হতে থাকে। কিন্তু এতে মুজিবকে দমানো যায়নি। যখনই তিনি মুক্তি পেয়েছেন তখনই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে এবং আইউবীয় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, ভাষণ দিয়েছেন। ফলে পুনরায় তাঁর ওপর মামলা নেমে এসেছে, তিনি কারারুদ্ধ হয়েছেন। ষাটের দশকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যুর ফলে আওয়ামী লীগের সার্বিক নেতৃত্ব চলে আসে শেখ মুজিবের হাতে। দলের সামনে তখন এক কঠিন পরীক্ষা। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা, প্রবীন অভিজ্ঞ নেতা মওলানা ভাসানীর সাথে প্রতিযোগিতায় শেখ মুজিবকে টিকে থাকতে হবে, আওয়ামী লীগকে ন্যাপের প্রভাব বলয় থেকে রক্ষা করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি বয়সে তরুন হলেও শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার দ্বারা এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। শেখ মুজিব ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মাধ্যমে লব্ধ করুণ অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৬৬ সালে তাঁর বিখ্যাত ছয় দফা দাবি ঘোষণা করেন।
ছয় দফাকে একটু নিবিষ্টচিত্তে বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুভব করা যায় যে, এর মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বীজ শুধু লুকিয়ে নেই, তা অঙ্কুরিতও হয়েছে। সুচতুর আইউব খান ও তাঁর অনুসারীগণ উপলব্ধি করলেন যে, শেখ মুজিবকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা ছাড়া কোনো গত্যান্তর নেই; অর্থাৎ তাঁকে ফাঁসিতে লটকাতে হবে। এই উদ্দেশে ১৯৬৮ সালের ২১শে এপ্রিল একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি এস এ রহমানের নেতৃত্বে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে পঁয়ত্রিশজনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। সে মামলার নামকরণ হয় মুজিব বনাম রাষ্ট্র।
মামলা চলাকালেই অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৯৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বন্দি অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রতিবাদে ১৭ই ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা যখন ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে একটি সাহসী ভূমিকা পালন করছিলেন ঠিক সেই সময়ে বর্বর পাকিস্তানের সৈনিকদের হাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। ড. জোহা বাংলাদেশের প্রথম শহিদ বুদ্ধিজীবী। তাঁকে হত্যার খবর প্রচারিত হবার সাথে সাথে সমগ্র দেশ জুড়ে বিদ্রোহের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। শুরু হয় গণঅভ্যূত্থান। পরিস্থিতি আইউব খানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আইউব খান বাধ্য হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি একটি ঘোষণায় শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেবার জন্যে বিশেষ দূত মারফত আমন্ত্রণ জানান।
পরদিন ২৩শে ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবকে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে এক সংবর্ধনা জানানো হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জনাব তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। অতঃপর সমগ্র বাঙালি জাতি শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর দলের নয়জন প্রতিনিধি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্যে ১৯৬৯ সালের ২৪শে র্ফেরুয়ারি লাহোরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দিন আহমদ। ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি আইউব খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিলের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিব যে সমস্ত দাবি-দাওয়া পেশ করেন, আইউব খানের পক্ষে সে সমস্ত দাবি-দাওয়া পূরণ অসম্ভব হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে আইউব খান শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রীর আসন গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু মুিজব তা প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে ২৫শে মার্চ আইউবের পতন ঘটে। দেশে পুনরায় সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। নতুন রাষ্ট্রপতি সেনানায়ক ইয়াহিয়ার নিকটেও তৎকালীন পূর্ব বাংলার আর কেউ নয়, এই একটি মানুষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন তাঁর সকল মাথাব্যথার কারণ। তাঁকে উপেক্ষা করার সাধ্য এই সেনানায়কের ছিল না। মুজিব আপসের ঊর্ধ্বে। তাই শেষপর্যন্ত ইয়াহিয়া খানকে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন দিতে হয়। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৬৭টি আসন, ১৯৭০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ লাভ করে ২৯৮টি আসন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অসাধারণ বিজয় শেখ মুজিবকে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যায়। তখন ইয়াহিয়া ও তাঁর দোসরগণ পা দেন এক গভীর ষড়যন্ত্রের পথে। ততদিন বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার মুকুটবিহীন সম্রাট। তাঁর নিকট ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো তুচ্ছ। অতঃপর উভয়েই ছুটে এলেন ঢাকায়, মুজিবের সাথে বসলেন আলোচনায়। কিন্তু মুজিব মনে মনে ঠিকই জেনেছিলেন যে, এই আলোচনা ছিল ভাওতামাত্র। শেখ মুজিবের আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। পূর্ব বাংলার সমগ্র প্রশাসন তখন বঙ্গবন্ধুর হাতে। ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিব দেশবাসীকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৩শে মার্চ বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং দেশবাসীকে জানিয়ে দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর দূরে নয়। ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটি ঘোষণার মাধ্যমে জারি করেন চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয. দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের কঠিন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হয়। হাজার বছরের পরাধীন বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস থেকে স্পষ্টই প্রতিয়মান হয় যে , হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশকে মুক্ত করেছেন। তাঁর জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না, এটি আজ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। কাজেই আজ আমাদের বলতে দ্বিধা নেই ১৭ই মার্চ শুধু বঙ্গবন্ধুরই জন্মদিন নয়, প্রকৃত অর্থে স্বাধীন বাংলাদেশেরও জন্মদিন।
লেখক: উপাচার্য, নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী