রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪ ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
জাতির আলোকবর্তিকা হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন
আজ ১০ জানুয়ারি। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৩তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে রক্তস্নাত বাংলার মাটিতে পা রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির প্রত্যাবর্তনে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পূর্ণতা পায়। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
বঙ্গবন্ধু ফিরেছিলেন বলেই বাংলাদেশ বাংলাদেশের জায়গাতে আছে। নতুবা ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় রক্ষা করা সম্ভব হত না। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন, পশ্চাদপসরণ তারই সাক্ষ্য দেয়। পঁচাত্তরের রক্তাক্ত পথ ধরেই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পথ-বিনির্মাণের প্রাণশক্তি উদ্বোধন সম্ভব হত না, যদি বঙ্গবন্ধু দেশে না ফিরতেন। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন অপরিহার্য় ছিল। বঙ্গবন্ধু ছাড়া যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের বিনির্মাণ উদ্যোগের সূচনা করাই সম্ভব হত না। ওই সময়ের বিশৃঙ্খল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি বিবেচনা করলেই এ বক্তব্যের অন্তঃসার উপলব্ধি করা যাবে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পরদিন থেকেই দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের উন্নয়নে করণীয় এবং কর্মসূচি নিয়ে একের পর এক করেন সভা। তবে চলার পথে শুরুর মাস থেকেই সৃষ্টি হয় নানা বিপত্তি। চোরাকারবারি, কালোবাজারি, ডাকাতি থেকে শুরু করে স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চলতে থাকে একের পর এক ষড়যন্ত্র। এই পরিস্থিতির সামনে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারো দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল না।
যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্গঠনে দলমত নির্বিশেষে সবার সহায়তার চেয়েও সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বারবার। এক বছর ধরে ষড়যন্ত্রকারীদের নানা হুঁশিয়ারি দিয়ে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি জনসভায় বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের জাতীয় চরিত্র আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘এই অবস্থার মধ্যেও বাইরে থেকে মাল আনি, মাল দিই। কিন্তু সে মাল পেছন দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। বেশি দাম দিলে, একটা একটা করে সে মাল বের হতে থাকে।’
২৪ মার্চ ১৯৭২, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, বিদেশি এজেন্ট ও অতি প্রগতিবাদীরা যত চেষ্টাই করুক না কেন? বহু ত্যাগ ও রক্তপাতের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বানচাল করা যাবে না।
বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের মধ্যেই ওই সময়ের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির চিত্র ফুটে ওঠে। শুধু বঙ্গবন্ধু বলেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনগণের শক্তির উৎসের কাছে গিয়েছেন এবং দেশের মানুষকে প্রতিরোধে মুখোমুখি করতে পেরেছেন। আজকের বাংলাদেশ-এর জন্যও সুরক্ষা কবচ হল দেশের শাসনতন্ত্র। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর স্বাধীনতার দশ মাস পর গণপরিষদে বাংলাদেশের প্রথম শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন শাসনতন্ত্র বিলের ওপর বক্তৃতায় বলেন, শাসনতন্ত্র সম্পর্কে সমালোচনা করা সহজ, কিন্তু দেশকে একটি শাসনতন্ত্র দেয়া খুবই কঠিন কাজ। তিনি বলেন, আমরা অল্প সময়ের মধ্যে শাসনতন্ত্র দিচ্ছি, কারণ শাসনতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না। শাসনতন্ত্রবিহীন দেশ হলো মাঝিবিহীন ও হালবিহীন নৌকার মতো। শাসনতন্ত্রে জনগণের অধিকার থাকবে, তাদের কর্তব্য নির্ধারিত থাকবে। কারণ ফ্রি স্টাইলে কোনো কিছু চলতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশে না ফিরলে এতো অল্প সময়ের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নও সম্ভব ছিল না। মানুষের হাতে হাতে যে আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি ছিল সেটাও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছাড়া দেশের স্বাধীনতাকে সংহত করাও সম্ভব ছিল না।
বঙ্গবন্ধু আজ নেই কিন্তু তিনি এমনই এক প্রাণ যা এ দেশের মাটি ও মানুষের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে আছেন। এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক পৃথক করে দেখবার বা দেখানোরও কোনো সুযোগ নেই। তিনি সতত আছেনÑ এ জাতির ওপর আলোকবর্তিকা হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন। আজকের যা কিছু অর্জন তাঁরই নির্দেশিত পথ ধরেই এসেছে, তা ভবিষ্যতের জন্যও প্রযোজ্য। জাতির এই মহান নেতাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।