বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবÑশ্রদ্ধাঞ্জলি

আপডেট: আগস্ট ৯, ২০১৭, ১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ

অধ্যাপক রাশেদা খালেক


কোনকালে একা হয় নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয়লক্ষ্মী নারী
এই বিজয়লক্ষ্মী নারী হচ্ছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী হিসাবে তিনি যে ধৈর্য-সহ্য-উদারতা-সাহসিকতা ও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে অনেক জটিল পরিস্থিতিতে স্বামীর পাশে থেকে সৎ পরামর্শ দিতে ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেছেন তা আজ ইতিহাস সত্য। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা শেখ মুজিবকে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হতে, বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের এই অসামান্য অবদানের জন্য জাতি আজ কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে স্মরণ করছে।
বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ১৯৩০ সালে ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ জহুরুল হক। মাতা হোসনে আরা বেগম। ফজিলাতুন্নেসার ডাক নাম রেনু। রেনুরা দুই বোন। কোন ভাই নেই। দু’বছরের বড় বোনের নাম জিনাতুন্নেসা, ডাক নাম জিন্নি। পিতা জহুরুল হক লেখাপড়া শেখে যশোরে চাকুরি করতেন। হঠাৎ করেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রেনুর  তিন বছর বয়সেবাবাকে এবং পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারান। পিতৃ-মাতৃ হারা দুই শিশু-নাতনীকে নিয়ে দাদা শেখ কাশেম দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারি দাদা অনেক চিন্তা ভাবনা করে বড় নাতনি জিনাতুন্নেসাকে সম্পর্কীয় এক নাতির সাথে বিবাহ দেন। আর চাচাতো ভাই শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবের সাথে রেনুর বিয়ে দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি দুই নাতনির নামে লিখে দিয়ে অভিভাবক হিসাবে লুৎফর রহমানকে দায়িত্ব দেন। শাশুড়ি সাহেরা খাতুন পিতৃ-মাতৃহারা শিশু রেনুকে মাতৃ¯েœহে কোলে টেনে নেন। এবং নিজ সন্তানদের সাথে অত্যন্ত আদরে লালন পালন করেন।
ছোটবেলা থেকে রেনুর লেখাপড়ার প্রতি প্রচ- আগ্রহ ছিল। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। পরবর্তীতে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে গৃহ শিক্ষকের কাছে বাংলা ইংরেজি ইতিহাস অংক এসব বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ফজিলাতুন্নেসা রেনুর আচার-ব্যবহার, চাল-চলন ছিল অত্যন্ত মার্জিত, ভদ্র, অমায়িক। রেনু ছিলেন শান্ত প্রকৃতির। ধীর-স্থির, প্রখর মেধা ও স্মরণশক্তির অধিকারি। স্বল্পবাক রেনু ছিলেন নীরব কর্মী। বাড়ির ছোট-বড় সকলের ফাই ফরমাস খাটতেন নীরবে। ছোটবেলা থেকেই তিনি অনেক ধৈর্য ও সহ্যশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। জীবনে কোন চাহিদা বা কোন মোহ ছিল না। সাদা সিধে জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন, পছন্দও করতেন। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করে এসেছেন। ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়ে যখনই অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হয়েছে সেই অর্থের যোগান দিয়েছেন স্ত্রী রেনু তাঁর পিতৃপ্রদত্ত সম্পত্তি থেকে।বঙ্গবন্ধু জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় জেলে কাটিয়েছেন।তাঁর অবর্তমানে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা,দলকে সংগঠিত করতে সহায়তা করা,আন্দোলন পরিচালনায় পরামর্শ দেয়াসহ   সংসারের হাল ধরা, সন্তানদের লালন-পালন, লেখাপড়া করা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সহ পরিবারের অন্যান্যদের দেখাশোনা, সেবাযতœ করাএসবই তিনি দক্ষ হাতে সামলিয়েছেন এবং খরচপত্র করেছেন। অত্যন্ত বিনয়ী, আদর্শময়ী নারী হিসাবে তিনি সকলের প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্রী হয়ে উঠেছিলেন।
পাঁচ সন্তানের জননী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব স্বামীর আদর্শে সন্তানদের গড়ে তুলেছেন। তিনি শুধু আত্মীয়-স্বজন নয় দলীয় কর্মীদের সুখ-দুঃখের ভাগিদার ছিলেন।নেতাকর্মীদের রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের  খোঁজখবর নেয়া ও তাদের পরিবারে নানা সংকটে  পাশে দাঁড়িয়েছেন ,প্রয়োজনেআর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। অতিথি আপ্যায়নে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। নিজ হাতে রান্না করে স্বামী-সন্তান এবং অভ্যাগতদের কাছে বসিয়ে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। প্রতিদিন নিজে রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার পাঠাতেন। অফিসে সরকারি বাবুর্চির হাতের রান্না স্বামীকে খেতে দিতেন না। পরিপাটি করে ঘরবাড়ি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন। এলো মেলো অপরিচ্ছন্ন ঘরবাড়ি পছন্দ করতেন না। অবসরে বই পড়তেন। পান খেতে পছন্দ করতেন। যেখানেই যেতেন সঙ্গে থাকতো পেতলের পানডালা। প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাজের পর কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এরপর  গরু বাছুর হাঁস মুরগি কবুতর ইত্যাদি পোষ্য পশু-পাখির তদারকি করতেন। কবুতরকে নিজ হাতে দানা খাওয়াতেন। এরপর ঘরে এসে চা এবং সংবাদপত্র নিয়ে বিছানায় বসতেন। এরমধ্যে ছেলে-মেয়েরা ঘুম থেকে উঠে মায়ের বিছানায় বসে আব্বা-মায়ের সাথে গল্প করতে করতে চা খেত।  কি চমৎকার একটি ঘরোয়া সুখের ছবি।
রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হিসাবে শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ছিলেন রাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি। কিন্তু তিনি  নিজেকে কখনও ফার্স্ট লেডি হিসাবে দেখেন নি, মানেন নি এবং সে পর্যায়ে নিজেকে তুলে ধরার কথা ভাবেনও নি। কখনও স্বামীর  দেশে-বিদেশের সফরসঙ্গী হয় নি। নির্লোভ-নির্মোহ এই নারীÑ সারাটি জীবন স্বামীর পাশে থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বান্তকরণে শুধু সহযোগিতা করে গেছেন।
১৯৬৬ সাল। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি পেশ করেন। পাকিস্তান শাসকেরা ৬ দফা দাবি পেশ করার অপরাধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১নং বিচ্ছিন্নতাবাদী আসামি হিসাবে ১৯৬৬ সালের ৮ মে তারিখে গ্রেফতার করে এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে । আওয়ামি লীগের উচ্চ পর্যায়ের অনেক নেতাসহ প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর বাঙালি কয়েকজন সদস্যকে জড়িয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে সবাইকে গ্রেফতার করে ঢাকা কারাগারে বন্দী করে রাখে এবং অমানবিক নির্যাতন চালায়। দেড় বছরের অধিক সময় বিনা বিচারে জেলখানায় রাখার পর ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দি করে এবং অত্যাচার করে। কেস কোর্টে ওঠার আগ পর্যন্ত  বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেনÑ জীবিত না মৃত তার খবর কেউ জানতে পারে নি। ফজিলাতুন্নেসা মুজিব স্বামীর খবরের জন্য পাগলের মত ছুটাছুটি করেছেন, কিন্তু কোন খবর সংগ্রহ করতে পারেন নি।
৬ মাসের অধিক সময় পর প্রথম যে দিন বিশেষ ট্রাইবুনাল শুরু হলো এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কোর্ট বসল সে দিনইÑ বঙ্গবন্ধুকে প্রথম তাঁর পরিবার দেখতে পেল।বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেনÑ এই ছিল সে দিন পরিবারের সান্ত¦না। আসলে এই মিথ্যা মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল পশ্চিমা শাসকদের। কিন্তু তা সম্ভব হয় নি দেব্যাপী ছাত্র জনতার আন্দোলনের ফলে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে। ৬ দফার সাথে ছাত্রদের ১১ দফা দাবি পেশ করে আন্দোলনকে আরো বেগমান করে তোলা হয়। এই মামলা পরিচালনা ও আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ফজিলাতুন্নেসা মুজিব দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। গহনা বিক্রি করে ছাত্রনেতাদের হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন।
( চলবে)