বছরে রক্তের চাহিদা লক্ষাধিক ব্যাগ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন রক্তদানকারীরা

আপডেট: জানুয়ারি ২৪, ২০২৪, ১২:১৩ অপরাহ্ণ


মাহাবুল ইসলাম:


রক্ত। জটিল রোগ কিংবা দুর্ঘটনায় প্রাণরক্ষাকারী অপরিহার্য উপাদান এটি। রাজশাহীতে রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে বছরে রক্তের চাহিদা লক্ষাধিক ব্যাগ। সময়ের পরিক্রমায় এই চাহিদা ক্রমশই বাড়ছে। যদিও দেশীয় আইনে রক্তের বেচাবিক্রি একেবারে নিষিদ্ধ। বেচাবিক্রি নিষিদ্ধ হলেও যোগান কিন্তু থেমে নেই। কারণ চাহিদা ও যোগানের ব্যবসায় হিসাব মানবিক মূল্যবোধের কাছে প্রতিনিয়তই হার মানছে রক্তের ভালোবাসায়।

লক্ষাধিক চাহিদার বিপরীতে যোগান নিশ্চিতের পাশাপাশি মানুষের প্রতি মানুষের অমূল্য মানবিক বন্ধন তৈরি হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। আর এক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন মানবিক রক্তদানকারীরা। যারা অর্থের বিনিময়ে নয়, মানবিক দায়বন্ধতার বিনিময়ে পূর্ব পরিচিত নয়- এমন হাজারো মুমূর্ষ রোগীর প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে আসছেন প্রতিনিয়তই।

উত্তরাঞ্চলের সিংহভাগ মানুষের চিকিৎসা সেবায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল অন্যতম প্রধান নির্ভরতার জায়গা। তেমনিভাবে রক্তের প্রয়োজনে এই হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ রোগীর অন্যতম প্রধান ভরসাস্থল।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, রাজশাহীতে রক্তের যে চাহিদা তার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ পূরণ করে থাকে রামেক হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ। প্রতিদিন গড়ে ১৮০ থেকে ২০০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহসহ প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াকরণ করে সরবরাহ করছে এই বিভাগ। সে হিসেবে প্রতিমাসে সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার ব্যাগ এবং বছরে ৭০ হাজারের কাছাকাছি রক্ত সংগ্রহসহ প্রক্রিয়াকরণ করে রোগীদের সরবরাহ করছে এ বিভাগ। এ বিভাগে রক্তের ১৫ ধরনের পরিক্ষা-নিরীক্ষা করা হচেছ। যার সেবামূল্যে ১০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

এদিকে, সরকারি এ হাসপাতালের বাইরেও রাজশাহীতে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় ডজনখানেক ব্ল্যাড ব্যাংক আছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, তারা বছরে ২৫ থেকে ৩০ হাজার ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ করে সরবরাহ করছে। তবে রক্তের বেশকিছু পরিক্ষা এমন আছে যেগুলো এ অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালেই করা হয়।

রক্ত সেবা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন এমন ব্যক্তিসহ রক্তদানকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো বলছে, রক্ত অনেক সময় রোগীর প্রাণরক্ষার একমাত্র উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া ও ব্ল্যাড ক্যান্সারের রোগীদের নির্দিষ্ট সময় পরপর রক্ত সংগ্রহ করা নিয়ে রীতমতো সংগ্রাম করতে হয়। এক্ষেত্রে অনেক মানবিক ডোনার এগিয়ে আসেন। যারা শুধু মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে আসেন।

প্রায় বছরধরে ব্ল্যাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ডিসেম্বরে শেষ নিশ^াস ত্যাগ করেছেন জেলার পবা উপজেলার মুরারীপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার। ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার পর থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে তার পরিবারকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে।

তার ছেলে মো. ইব্রাহিম আলী বলেন, বাবার প্রতিমাসে রক্ত লাগতো। আমাদের পরিবারসহ আশেপাশের মানুষও এগিয়ে এসেছিলেন। কিছু মানবিক ডোনারও এগিয়ে এসেছেন। যারা কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়, মানবিক জায়গা থেকে এগিয়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে সেচ্ছাসেবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

রাজশাহী কলেজ শিক্ষার্থী মো. তামিম জামাল বলেন, আমি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতি তিনমাস পরপর নিয়মিতই রক্ত দান করি। একটি রক্তদানকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দায়িত্বেও ছিলাম। আসলে আমরা রক্তদানকারীরা মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে রক্ত দিয়ে যাচ্ছি। নিজে রক্তদানের পাশাপাশি অন্য শিক্ষার্থীদেরও উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে যাচ্ছি। তবে সরকারি হাসপাতালে কিছু দুর্ভোগের চিত্র আছে। নজরদারি বাড়ানো হলে এ সেবা শতভাগ রোগীবান্ধব হবে।

রাজশাহীতে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি বেশকিছু রক্তদানকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও কাজ করে যাচ্ছে। রেডক্রিসেন্ট, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, বাঁধন, সন্ধানীসহ অনলাইনভিত্তিক বেশকিছু গ্রুপ গড়ে উঠেছে। যেখানে হাজারো মানবিক গল্প গড়ে উঠছে প্রতিনিয়তই।

রাজশাহী সার্বজনীন স্বেচ্ছায় রক্তদান সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা মোহন আলী জানান, রক্তদান একটি মানবিক কাজ। কিন্তু রক্তদান যারা করেন, তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়ার মতো তেমন কোনো ব্যবস্থা গড়ে উঠে নি। তবে দিনশেষে প্রতিটি মুহূর্তে হাজারো মানবিক মানুষ রক্তদান করে মানবিক মূল্যবোধের জয়ধ্বন্নি তুলছেন।

এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. ফাতেউল ইসলাম সিজার জানান, রাজশাহীতে মোট চাহিদার সিংহভাগ সরকারি এ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় হচ্ছে। এখানে রক্তদানকারীদের ভূমিকা খুবই উজ্জ্বল।

অপরদিকে, নগরীতে বেসরকারি উদ্যোগে যে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে তারমধ্যে অন্যতম রেড ক্রিসেন্ট ব্ল্যাড ব্যাংক, রাজশাহী ব্ল্যাডব্যাংক অ্যান্ড ট্রান্সফিউশন সেন্টার, নিউ সেইফ ব্ল্যাড ব্যাংক, বারিন্দ্র
মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ব্ল্যাড ব্যাংক, ইসলামি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ব্ল্যাড ব্যাংক।

রাজশাহী রেড ক্রিসেন্ট এর ভাইস-চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম জানান, রেড ক্রিসেন্ট রক্তদাতা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। রক্তদান সর্ম্পকে মানুষ সচেতন হলে রক্ত নিয়ে কোন দূর্ভোগ থাকবে না। আর রক্তদাতারা প্রতিটি মুর্হূতেই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন এতে কোন সন্দেহ নাই।

রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক জানান, মানুষ এখন অনেক সচেতন। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি প্রচেষ্টায় অনেক রক্তদানকারী তৈরি হয়েছে। যারা প্রতিমুহূর্তে এগিয়ে আসছে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ