শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
এমদাদুল হক দুলু, বদলগাছী
নওগাঁর বদলগাছীতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অরক্ষিত গণকবর নিয়ে উদ্বিগ্ন গ্রামবাসী। সংস্কার, সংরক্ষণ, ভূমিক্ষয় ও ধ্বসের কারণে অরক্ষিত গণকবর নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। গণকবরের শায়িত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা বদলগাছী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে থাকলেও শহীদদের গণকবর হেফাজতে নেই কোনো উদ্যোগ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রত্যক্ষদর্শী ডাঙ্গিসারা গ্রামের মো. আসতুর আলী (৭৫), লুৎফর রহমান (৭০), আবদুস সামাদ ও ওসমান আলী জানান, বেঁচে যাওয়া এক মুক্তিযোদ্ধা জানান তারা ছিলেন মোট ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা। সকলের বাড়ি নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায়। তারা তিনজন মুক্তিযোদ্ধা ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে আরো ৬ জনকে সঙ্গে নিয়ে বদলগাছীর ওপর দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে ওইদিন সকালে বদলগাছীর বালুভরা ইউপির মির্জাপুর মোড়ে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা সন্ধেহে আটক করে কতিপয় রাজাকারেরা। আটকের পর পাক-হানাদার বাহিনীর নিকট তাঁদেরকে হস্তান্তর করলে নির্মম নির্যাতনের এক পর্যায়ে আধাইপুর ইউপির সেনপাড়া গ্রামের জঙ্গলে শারিবদ্ধভাবে তাদের চোখ বেঁধে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তিন মুক্তিযোদ্ধা গুলির শব্দ পেয়ে তাঁরা চিৎ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার কৌশল করে প্রাণে বেঁচে যান। আর বাকী ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। বেঁচে যাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা হাতের বাঁধন খুলে ওইদিন দুপুরের পর ছোট যমুনা নদী পার হয়ে ডাঙ্গিসারা গ্রামে গিয়ে উঠেন। এসময় সে দেখতে পায় তাঁর আরও একজন সঙ্গি ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয়ে নদীতে এসে পানি খাচ্ছেন। বেগতিক অবস্থার মধ্যে স্থানীয় লোকজন ওই দুইজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়ে সুস্থ্য করে নিজ গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। বেঁচে যাওয়া ৩ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা নিজ গতিতে প্রাণে বেঁচে ফিরে যায় তাঁর নিজ বাড়িতে। বাঁকী ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে আসে তাঁদের স্বজনরা ডাঙ্গিসারা গ্রামে। স্বজনরা স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় নিহত ৬ মুক্তিযোদ্ধার ক্ষত-বিক্ষত লাশ ও হাড় গোড় উদ্ধার করে এনে ডাঙ্গিসারা গ্রামে ছোট যমুনা নদীর ধারে গণকবর দেয়।
বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার দিনেশ সিংহ বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবরসহ মুসলমানদের কবরস্থান হিসাবে আমার পিতা রাম জনম সিংহ সাড়ে ১৬ শতক জমি কবরস্থানের নামে রের্কড করে দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর সংরক্ষণ ও বাঊন্ডারী ওয়াল নির্মাণের জন্য বহুবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় সাংসদ মহোদয়ের নিকট ধর্ণা দেয়া হয়েছে কিন্তু কোনো ফল হয় নি। মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগী ৬ যোদ্ধার প্রাণ কেড়ে নিল পাক হানাদার বাহিনী। সেই ৬ আত্মত্যাগী শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর অরিক্ষত অবস্থায় ভূমিক্ষয় ও ধ্বসের কারণে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে।
ডাঙ্গিসারা গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীসহ গ্রামবাসী জানান, তাঁরা নিজ হাতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়েছে এবং যে ৬ জন মারা গিয়েছে তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে কবরস্থ করেছে। স্বজনরা মান্দা উপজেলা থেকে এসে এখানে মিলাদ মাহাফিলও করেছেন।
গণকবরে ৬ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন, নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার ময়নম ইউনিয়নের দূর্গাপুর গ্রামের মৃত করিম সোনারের ছেলে কাদের বক্স, মৃত কাওছার আলী মন্ডলের ছেলে শাকায়েত মন্ডল, মৃত মকা আকন্দের ছেলে ইয়াজ উদ্দীন আকন্দ, মৃত লইম উদ্দীন মন্ডলের ছেলে লুৎফর রহমান মন্ডল, প্রসাদপুর ইউনিয়নের মৃত শশি মন্ডলের ছেলে মোহাম্মদ আলী খোকা, গনেশপুর ইউনিয়নের মৃত মাদার উদ্দীন এর ছেলে বিরাজ উদ্দীন।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া ৩ জন হলেন, নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার ময়নম ইউনিয়নের দূর্গাপুর গ্রামের মৃত মীর মোল্লার ছেলে মো. নজরুল মোল্লা, মৃত কলিমুদ্দীন মন্ডলের ছেলে নিকবর মন্ডল, মৃত খয়রুল মন্ডলের ছেলে গছির উদ্দীন মন্ডল। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
বর্তমান মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে জরুরি ভিত্তিতে গণকবর স্থানটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ওই গ্রামের যুবক এমদাদুল হক ভুটু জানান, গণকবর সংরক্ষণের জন্য বারবার ইউএনও ও সাংসদ বরাবরে আবেদন জানালেও কোনো ফল হয় নি।
এ বিষয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মো. জবীর উদ্দীন জনান, উপজেলার ১১টি গণকবরের তালিকায় ডাঙ্গিসারা গ্রামে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গণকবরস্থান রয়েছে। এ তালিকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দেয়া আছে। এই গণকবর ন্থান সংরক্ষণ করা জরুরি।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. হুসাইন শওকত বলেন, বিষয়টি আমার জানা আছে। আমি দুই-এক দিনের মধ্যে উক্ত কবরস্থানটি দেখতে যাব।