সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৭ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
মো. সফিকুল ইসলাম:
একশত পাঁচ বছর আগে বাংলার ইতিহাসচর্চার পাদপীঠ ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’ আজকের দিনে (১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর) উদ্বোধন করেন বাংলার গভর্নর লর্ড রোনাল্ডসে। একই দিনে দর্শনার্থীদের জন্য প্রতœনিদর্শন প্রদর্শন উন্মুক্ত করা হয় এবং মিউজিয়াম গ্রন্থাগার চালু হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লর্ড রোনাল্ডসের বন্ধু খ্যাতনামা ফরাসি পন্ডিত মসিয়ে ফুঁসে। মিউজিয়াম ভবনের নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বাংলার গর্ভনর লর্ড কারমাইকেল, ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বরে। বাংলার ইতিহাসচর্চার মহান প্রয়াসে নাটোর দিঘাপতিয়ার রাজপরিবারের সদস্য কুমার শরৎকুমার রায় নিজ অর্থে এই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রথমে ‘বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি’ গঠন করেন ১৯১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে এবং পরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’। এই সমিতি গঠনকে ‘বাঙ্গলা দেশে এক বিস্ময়কর ঘটনা’ বলে আখ্যায়িত করেন সমকালীন ইতিহাসবিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালী (অক্ষয়কুমারের স্মরণে, মানসী ও মর্ম্মবাণী, কলকাতা, মাঘ ১৩৩৬, পৃ.- ৬০৮)।
বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি ও বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কুমার শরৎকুমার রায়, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। রমাপ্রসাদ চন্দ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা কিউরেটর ছিলেন। মূলত, বাংলার সুবিখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়কে ‘সারথ্যে’ বরণ করেই সমিতি ও মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন কুমার শরৎকুমার রায়। তাছাড়া, জড়িত ছিলেন রাজশাহীর উচ্চশিক্ষিত দেশহিতৈষী নাগরিক ও জমিদারগণ। রাজশাহী মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র হেতেম খাঁ মহল্লায় অবস্থিত ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’ সকল শ্রেণির মিউজিয়ামের মধ্যে বাংলাদেশের ‘প্রথম’ এবং বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষের প্রথম মিউজিয়াম।
বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম ভবন ১৯১৯ সালে চালু হলেও মিউজিয়ামটি সরকারি অনুমোদন লাভ করে ১৯১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে। কারণ, প্রতিষ্ঠাতাগণ ১৯১০ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রত্ন-অনুসন্ধান দল গঠন করে রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ১টি অনিন্দ্যসুন্দর গঙ্গামূর্তিসহ ৩২টি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ করে। এই ৩২টি প্রতœনিদর্শন শহরের মিয়াপাড়ায় অবস্থিত ‘রাজশাহী সাধারণ পুস্তকালয়’ (বর্তমান নাম রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার)-এর নিচতলার একটি কক্ষে রাখা হয় এবং প্রদর্শনের মাধ্যমে তখনই মিউজিয়াম চালু করা হয় ‘রাজশাহী মিউজিয়াম’ নামে। এরপর, একই বছর ২৭ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করা হয় বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি। প্রত্নঅনুসন্ধান দল ১৯১০-১৯১১ সালের মধ্যে বরেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারে প্রত্ননিদর্শন সংগৃহীত হওয়ার পর গ্রন্থাগার চত্বরে একটি প্রত্নমেলার আয়োজন করে বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি, ১৯১২ সালের আগস্টে। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই প্রত্নমেলা উদ্বোধন করেন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল। প্রদর্শনী দেখে তিনি মুগ্ধ হন। এই প্রদর্শনী সুধি-সমাজকে মাতৃভূমির ইতিহাস জানার জন্য কৌতূহলী করে তোলে। প্রত্নমেলার আলোড়ন ছড়িয়ে পড়ে উপমহাদেশজুড়ে। লর্ড কারমাইকেল ও সুধি-সমাজের উপস্থিতিতে তখন কুমার শরৎকুমার রায় বাংলা সরকারের কাছে প্রতিশ্রুত হন একটি প্রতœতাত্ত্বিক মিউজিয়াম নির্মাণের জন্য।
প্রত্নপ্রদর্শনী দেখে লর্ড কারমাইকেল মুগ্ধ হন এবং এরই ধারাবাহিকতায় বেঙ্গল গভর্নমেন্ট ১৯১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত ১১নং প্রজ্ঞাপন দ্বারা বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতিকে নিবন্ধন প্রদান করে। এই আদেশ ১৯১৩ সালে জারি হলেও তা কার্যকর করা হয় সমিতি প্রতিষ্ঠার দিন অর্থাৎ ১৯১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকেই। ওই একই দিন (১৯১০, ২৭ সেপ্টেম্বর) থেকে বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের নিবন্ধনও কার্যকর করা হয়। তাই, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা ‘১৯১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর’ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।
কুমার শরৎকুমার রায়ের প্রতিশ্রুতি পূরণে তাঁর বড় ভাই দিঘাপতিয়ার রাজা রায়বাহাদুর প্রমদানাথ রায় ৫ বিঘা ২ কাঠা ২ ছটাক জমি খরিদ করে বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতিকে দান করেন এবং ভবিষ্যৎ সর্বসাধারণের জন্য কিছু জমি দান করেন স্থানীয় নাগরিক বাবু দুর্গাদাস ভট্টাচার্য। এই জমির ওপরই কুমার শরৎকুমার রায়ের অর্থানুকূল্যে (৬২,৫৪৫ টাকায়) দৃষ্টিনন্দন বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম ভবন নির্মাণ করা হয়। ভবন নির্মাণের সময় শরৎকুমার রায়ের অপর দ্বিতীয় বড় ভাই কুমার বসন্তকুমার রায় প্রথমে ৫ হাজার ও পরে মিউজিয়ামের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৩০ হাজার টাকা অনুদান দেন। কনিষ্ঠ সহোদর কুমার হেমেন্দ্রকুমার রায় একই সময়ে ৫ হাজার টাকা অনুদান দেন।
দক্ষিণ ভারতের স্থাপত্যের সাথে প্রাচীন গৌড়ের শিল্পকলার অনুকরণে সুদৃশ্য মিউজিয়াম ভবনের নকশা প্রণয়ন করেন কুমার শরৎকুমার রায় এবং তিনিই নির্মাণ কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন। মিউজিয়াম ভবন নির্মাণে প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করেন রাজশাহীর (বর্তমান নাটোর) কৃতি সন্তান ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকারের ছোট ভাই প্রকৌশলী বিজয়নাথ সরকার।
বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি ও বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠালগ্নেই কাজের প্রধান ভিত্তি নির্ধারিত হয় তিনটিজ্জ‘প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ’, ‘গবেষণা’ ও ‘প্রকাশনা’। প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই বহুমাত্রিক প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ ও আন্তর্জাতিকমানের প্রকাশনার জন্য এই মিউজিয়ামের সুখ্যাতি বিশ্বপন্ডিতমহলে সমাদৃত হয়। বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক খননের পথিকৃৎ। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার দেওপাড়া ইউনিয়নে ‘কদমশহর’ গ্রামের ধ্বংসপ্রাপ্ত ‘পদুমন্ডসহর মন্দির’ অঙ্গনের খননই বেসরকারি উদ্যোগে বাংলার প্রথম প্রত্নস্থল খনন এবং অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক এই খননকার্য হয় ১৯১১ সালের সূচনায়। সমিতি পরিচালিত সকল খননের অর্থায়ন করেন কুমার শরৎকুমার রায়। সমিতি কর্তৃক খননসমূহের মধ্যে নওগাঁ পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহার খনন সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্ববৃহৎ ও বিপুল ব্যয়সমেত। ঐতিহাসিক এই মহাবিহারে সর্বপ্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক পাঁচ বছর মেয়াদের খনন শুরু হয় ১৯২৩ সালের ১ মার্চ। কোদাল দ্বারা কুপ দিয়ে খনন উদ্বোধন করেন শরৎকুমার রায় এবং প্রথম দিন খনন পরিচালনা করেন অক্ষয়কুমার।
বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে বর্তমানে নিবন্ধিত ১৮ হাজারেরও বেশি বহুমাত্রিক প্রত্ননিদর্শন রয়েছে। এই মিউজিয়ামে পাঁচ হাজার বছর পূর্বের সিন্ধুসভ্যতা’র (হরপ্পা-মহেঞ্জাদারো) প্রায় চারশত প্রতœনিদর্শন রয়েছে। এতো প্রাচীন নিদর্শন বাংলাদেশে আর কোনো মিউজিয়ামে নেই। আছে হাজার বছর আগের রঙ্গিন চিত্র-অংকন সম্বলিত বৌদ্ধধর্মীয় বিশ্বনন্দিত পুথি ‘অষ্টাসাহ¯্রকিা প্রজ্ঞাপারমিতা’। প্রদর্শনে আছে সৌদিআরব থেকে নিয়ে আসা মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর নিজ হাতে স্বাক্ষরিত হুবহু পত্রের প্রতিলিপি। মিউজিয়ামের আরও উল্লেখযোগ্য প্রত্ননিদর্শন হলো : ৩৮টি স্বর্ণমুদ্রা, খ্রিস্টপূর্ব মৌর্য আমলেরসহ বিভিন্ন শাসনযুগের সাড়ে ছয় হাজার মুদ্রা, পুথি ও পান্ডুলিপি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার, দুই হাজারের অধিক প্রস্তরে নির্মিত বিভিন্ন শ্রেণির প্রত্ননিদর্শন (এর মধ্যে অতিমূল্যবান কৃষ্ণপ্রস্তরের ভাস্কর্য প্রায় দুই হাজার, ধুসর ও বালুকা প্রস্তর প্রায় তিনশত), সোমপুর মহাবিহারের প্রায় তিনশতসহ দেড় হাজার টেরাকোটা বা পোড়ামাটির ফলকচিত্র। মিউজিয়াম গ্রন্থাগারে রয়েছে পনের হাজারেরও অধিক দুর্লভ ও মূল্যবান গ্রন্থ-জার্নাল-পত্র-পত্রিকা। বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি থেকেই ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় রমাপ্রসাদ চন্দ রচিত ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সম্পাদিত ‘গৌড়রাজমালা’ ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রচিত ‘গৌড়লেখমালা’ বহু বিখ্যাত গ্রন্থ। ‘গৌড়রাজমালা আধুনিক-বিজ্ঞান-সম্মত প্রণালীতে লিখিত বাংলার প্রথম ইতিহাস’ হিসেবে প্রথম স্বীকৃত করেন ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার (বাংলাদেশের ইতিহাস প্রথম খন্ড, প্রাচীন যুগ, দেখুন- ভূমিকা)।
বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের বিপুল প্রত্নসম্পদ অতীত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি—ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, ধর্ম-সমাজ-সভ্যতার জীবন্ত সাক্ষী। বস্তুতঃ এই মিউজিয়াম বাংলাদেশের পরম এক সাংস্কৃতিক সম্পদ ও অতীত ইতিহাসের দিকদর্শন বলা যেতে পারে। বাঙালি জাতি তথা বাংলার লেখ্য ইতিহাস সৃষ্টিতে বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম এবং এর প্রতœনিদর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ^সভ্যতার অংশ বিবেচনায় বিশশতকের দ্বিতীয় দশকে ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ ‘বিশ্বঐতিহ্য’ হিসেবে বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের বাংলা পুথির তালিকা’ গ্রন্থের ‘প্রস্তাবনা’য় সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ এনামুল হক বলেন,—‘রাজশাহীর ‘‘বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি ও যাদুঘর’’ ‘‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’’ কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করিয়া, ইহা একরূপ বিশ^বিখ্যাত। ফলে, প্রতিষ্ঠানটি আজ দেশ-বিদেশের গুণী ও গবেষকদের একটি উল্লেখযোগ্য তীর্থ ক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে।’
বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি ও বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা, সমাজউন্নয়নসহ বহুমুখী কাজ এবং দানশীলতার জন্য কুমার শরৎকুমার রায় ও তাঁর বংশীয় দিঘাপতিয়ার রাজা-জমিদারগণ বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। সাহিত্যিক দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খন্ড) গ্রন্থে বলেন,—‘ইতিহাস বিভাগে বঙ্গের সুসন্তান রাজকুমার শরৎকুমার রায়ের নাম সসম্মানে উল্লেখযোগ্য। শরৎকুমারের মত দেশহিতৈষী ও অনাড়ম্বর দাতা বঙ্গদেশে আর দ্বিতীয় নাই বললে অত্যুক্তি হইবে না।’ স্মরণযোগ্য যে, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকারি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট হস্তান্তর করা হয় ১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর। শতাব্দী প্রাচীন ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’ রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের সবচেয়ে গৌরবময় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
লেখক : উপ-রেজিস্ট্রার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।