বসন্তের আগেই ফুটেছে পলাশ ফুল

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৪, ১২:০৭ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:বসন্তের আগেই শীতের রুক্ষতায় যখন পাতাশূন্য হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রকৃতি, ঠিক তখনি মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে পলাশ ফুল। গ্রামীণ আবহে হরহামেশাই রাস্তার ধারে দেখা মিলবে ফুল গাছ দুটির। কিন্তু কংক্রিটের শহুরে জীবনে যার দেখা মেলা কষ্টসাধ্য। তবে দিনের পরিক্রমায় গ্রামীণ আবহ থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে পলাশ।

সময়ের বসন্তের আগেই দ্বারে বসন্ত জাগ্রত হয়ে ওঠায় শীতপ্রেমীরা আহ্লাদের কিছু দেখছেন না। মৌসুমের প্রথম থেকে শীত যে-ক্ষিপ্ততা দেখিয়েছে, মাঘের শীত বাঘ প্রবচনটি সত্য করে সেটা মেনে নিয়েছে। ভরা মাঘে লাফিয়ে লাফিয়ে কমছে থার্মোমিটারের পারদ! মাঘ মাস শেষ হতে এখনো বাকি ২ সপ্তাহ এরই মধ্যে উত্তরের বাতাস বিদায় ঘণ্টা বাজছে। শুরু হয়েছে দখিণা গুঞ্জন। প্রকৃতিতে ফাগুন লেগেছে। গ্রামাঞ্চলে ক্ষণে ক্ষণে ধ্বনিত হচ্ছে কোকিলের কুহুতান। ঘরছাড়া সুরে মাতোয়ারা পাখিরাও। বনে-বাদাড়ে সংগীত-জলসার আয়োজনে ব্যস্ত তারাও।

তাই তো কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী শাহ আব্দুল-করিম গেঁয়ে গেছেন বসন্তের গান।
‘বসন্ত বাতাসে ও সই গো, বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আশে সই গো বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে।
বন্ধুর বাড়ি ফুল বাগানে নানা বর্ণের ফুল
ফুলের গন্ধে মনানন্দে ভ্রমরা আকুল
সই গো বসন্ত বাতাসে’।
ঋতুরাজ বসন্ত শুধু গান-কবিতায় নয়, মানুষও সেজে উঠে প্রকৃতির রঙে।

বসন্তের আগেই সম্মুখে চওড়া পাপড়ি, পেছনে দুটি ডানার মত ছড়ানো এবং দুটি একত্রে বাঁকানো, পাখির ঠোঁটের মতো অরণ্যের অগ্নিশিখা পলাশ। যেন পহেলা ফাল্গুনের আগাম বার্তা দিচ্ছে। পলাশের সমারোহে ইঙ্গিত দেয় পলাশ যেন বসন্তেরই পূর্ণতা। এটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইঁঃবধ গড়হড়ংঢ়বৎসধ’। তবে পলাশ নামেই পরিচিতি বেশি। রয়েছে আরও কত বাহারি রকমের নাম যেমন, কিংশুক, পলাশক, বিপর্ণক। বাংলা সাহিত্যে পলাশের প্রভাব অতিশয়। গানে, কবিতায় কোথায় নেই পলাশ? তবে শুধু এ কালের সাহিত্য নয়, পলাশ সুপ্রাচীনকালেও ছিল সমান আদরণীয়। মহাভারতের সভাপর্বে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেখানে উদ্যান আর কৃত্রিম জলাধারের পাশেও ছিল পলাশ বৃক্ষের মাতামাতি। পলাশ ও শিমুলের নয়ানাভিরাম সৌন্দর্য মন কাড়ে সবারই।

বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুর মধ্যে গ্রীষ্ম, শীত ও বর্ষা এই তিন ঋতুর পার্থক্য সহজে বোঝা যায়। বাকি শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত, কেমন মিলে মিশে যায়। এই যে শীত পেরোয়নি কিন্তু বসন্তের আগেই আভাস দিচ্ছে, বাগানে ফুল ফোটা শুরু হয়ে গেছে কিছুদিন আগে থেকেই। নিস্বর্গবিদরা বলছেন, আবহাওয়ার হেরফেরে এ বছর ফাগুন আসার আগেই বসন্তের ফুল।

মাঘের এই সময়ে সেজেছে রক্ত রাঙা পলাশে। শুষ্ক রুক্ষ শীতের আড়মোড়া ভেঙ্গে এবার আগেভাগেই বসন্তের আগমনী বার্তা। গ্রামবাংলার অতি পরিচিত ফুল শিমুলও ফুটেছে। রক্ত রঙা শিমুলের কচি পাপড়ি খেতে কাঠ শালিকের ছোটাছুটি ।

শীতের অলস সকালে নগরবাসী যখন কম্বল মোড়া, ঠিক তখন শান্ত রোদ গায়ে মেখে প্রকৃতি রাঙ্গাচ্ছে রুদ্র পলাশ। যদিও মাঝে মধ্যে ফেব্রুয়ারিতেও ফোঁটে এই ফুল। কিন্তু এবার জানুয়ারির শেষ থেকেই নিজেকে মেলে ধরেছে পলাশ।

মোঘল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম এবং উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম বসন্ত উৎসব উদযাপন করার রীতি চালু হয়। তাই পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব কেবল উৎসবে মেতে ওঠার সময় নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য, বাঙালিসত্তা। এ ঐতিহ্যের ইতিহাসকে ধরে রাখতে পারলেই বসন্ত উৎসবের সাথে নতুন প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে পারবে বাঙালি চেতনাকে।

লেখক ও কবিরা জানান, মূলত প্রকৃতির মিলন হয় বসন্ত ঋতুতেই। আর পলাশ, শিমুল গাছে লাগে আগুন রঙের খেলা। দিন দিন শিমুল-পলাশ গাছ উজাড় হওয়ায় প্রকৃতির রূপ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রকৃতি রাঙানো গাছ লাগানোর ওপর গুরুত্বরোপ করা উচিত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ ইমন বলেন, ছোটবেলার খেলার সঙ্গী ছিলো পলাশ ফুল। সময়ের সঙ্গে গ্রামেও গাছগুলোর দেখা মিলে না। কিন্তু ক্যাম্পাসে গাছগুলোর উপস্থিতি আমাকে আন্দোলিত ও মুগ্ধ করে। ফুলগুলো দেখলেই ছোটবেলার স্মৃতিতে ডুব মারতে বাধ্য হই। এ যেন প্রাণের স্পন্দন।

রাজশাহী কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাসিমা খাতুন বলেন, প্রতি বছরেই আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বসন্তের আগেই এ বছরে শীত এসে অনেক দেরিতে। এ কারণে আগেভাগেই পলাশ ফুল ফুটতে দেখা গেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুর চারিত্রিক পরিবর্তন হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও প্রকৃতিতে। বসন্ত ঋতু আসার আগে শিমুল ফুল ফোটার পেছনেও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে।