বাংলাদেশের দাসতন্ত্রের ইতিহাস ইসহাক সিদ্দিকীর অনবদ্য গ্রন্থ

আপডেট: মে ৩০, ২০২৫, ৮:৩৬ অপরাহ্ণ

 

মো. সফিকুল ইসলাম


বাংলাদেশের দাসতন্ত্রের ইতিহাস, লেখক-ইসহাক সিদ্দিকী, প্রথম প্রকাশ-আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, প্রকাশক-ওসমান গনি, প্রকাশকাল-কার্তিক ১৪৩১/নভেম্বর ২০১৪, প্রচ্ছদ-দ্রুব এষ, অধ্যায় সংখ্যা- ৫, পৃষ্ঠা- ১২৮, মূল্য-৪০০ টাকা। বাংলাদেশের দাসতন্ত্র নিয়ে বাংলা ভাষায় লিখিত এটিই প্রথম গ্রন্থ। সুবিখ্যাত প্রকাশক ওসমান গনি পরম যতেœ প্রকাশ করেছেন গ্রন্থটি, তাই ছাপা ও বাঁধাইয়ের মান অতি উন্নত।

ধর্ম ও বিজ্ঞানের ভাষ্য,-‘মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব’। মানবসমাজ বেড়ে ওঠার ইতিহাসে দেখা যায় উৎকৃষ্ট কাজগুলো মানুষই সম্পাদন করেছে, আবার নিকৃষ্ট কাজও মানুষের দ্বারাই সম্পাদিত হয়েছে এবং এই ধারা বহমান। মানুষ মানুষের যেমনি সহায় হয়েছে, তেমনি মানুষ মানুষকে বিপন্ন করেছে। মানবসৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানব-ইতিহাস এমনই। ‘দাস’ শব্দটি সাথে জড়িত রয়েছে মানুষ দ্বারা মানুষকে নিষ্ঠুরতম অত্যাচারের ইতিহাস। মানুষের শ্রেণিবিন্যাস ও জীবনধারার ইতিহাসে একেবারেই নিকৃষ্টতম ধারা হচ্ছে ‘দাস প্রথা’ বা ‘দাসতন্ত্র’।

ইসহাক সিদ্দিকী কুমিল্লার একজন সুবিখ্যাত আইনজীবী, পাশাপাশি তিনি একজন গ্রন্থপ্রণেতা ও সৃজনশীল লেখক। তাঁর রচিত বাংলাদেশের দাসতন্ত্রের ইতিহাস একটি অনবদ্য সামাজিক-ইতিহাস গ্রন্থ। যা উচুঁমানের শ্রমলব্ধ গবেষণা গ্রন্থ, কারণ এটি আধুনিক গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করে রচিত। টিকা-টিপ্পনি, রেফারেন্স, নোট, ব্যাখ্যা, প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ সহ বহুবিধ তথ্য-উপাত্তে গ্রন্থটি ঠাসা। ঋগে¦দ, রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মনু সংহিতা, মুসলিম আমলের নানা গ্রন্থসহ ভারতে ব্রিটিশযুগের নানা বিধি-বিধান থেকে বহু অভিমত, উদ্ধৃতি ও দলিল গ্রন্থের পরতে পরতে উপস্থাপিত হয়েছে। তাই বলা যায়, গ্রন্থটি বাংলাদেশের সমাজসভ্যতার এক নির্মোহ দলিল।

‘বাংলাদেশের দাসতন্ত্রের’ কথা বলতে গিয়ে অল্পবিস্তর বাংলাদেশের প্রাচীন সমাজজীবনের ইতিহাসও লিপিবদ্ধ করেছেন গ্রন্থকার। আলোচনায় এসেছে আমেরিকা, ইউরোপ, প্রাচীন আরবদেশসহ বিভিন্ন দেশের ‘দাস’ ও ‘দাসতন্ত্রের’ প্রাচীন ও বর্তমানের পরিস্থিতি। দাসরা অতি নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে নিগ্রহের শিকার হতো, বিশেষত নারীরা ব্যবহৃত হতো যৌনদাসী হিসেবে। দাসতন্ত্র মানবজাতির ইতিহাসে এক কলংকিত ও ঘৃণিত ধারা হিসেবে বিবেচনা করেছেন ইতিহাসকার ইসহাক সিদ্দিকী।

গ্রন্থটি পাঁচ মূল অধ্যায় ও নয় উপ-অধ্যায়ে লিখিত হয়েছে। অধ্যায়গুলো হচ্ছে,-১. আর্য অনুপ্রবেশ ও দাসতন্ত্র (উপ-অধ্যায়: ক. পটভূমি রূপরেখা; খ. বাংলাদেশে আর্যায়ন ও রামায়ণ-মহাভারতের যুগ; গ. দাসী, ভূজিষ্যা, মা মালাকাত আইমানুকুম); ২. বাংলাদেশে আর্য প্রভাব ও দাসতন্ত্র; ৩. মুসলমান আগমন, দাসতন্ত্র ও বাংলাদেশ (উপ-অধ্যায়: ক. দাসতান্ত্রিক রাজতন্ত্র, দাসতান্ত্রিক সেনাতন্ত্র ও দাসতান্ত্রিক আমলাতন্ত্র; খ. সাধারণ জনমানুষের চর্চিত দাসব্যবস্থা); ৪. বাংলাদেশে দাসতন্দ্রের ইউরোপীয় অধ্যায় (উপ-অধ্যায়: ক. পর্তুগাল; খ. হল্যান্ড; গ. ইংল্যান্ড; ঘ. দেশীয় ধারাবাহিকতা); ৫. আধুনিক দাসত্ব।

বাংলাদেশের দাসতন্ত্রের ইতিহাস গ্রন্থে ইসহাক সিদ্দিকী বাংলাদেশে দাসতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে বলেছেন,-যাযাবর আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০ সালের মধ্যেবর্তী সময়ের মধ্যে। আর্যরা প্রবেশ করেই ভারতবর্ষের প্রাগার্য জনগোষ্ঠীকে ঢালাওভাবে ‘দাস’ ঘোষণা করে অতর্কিত আগ্রাসী যুদ্ধে মেতে ওঠে। স্থানীয় মানুষদের নিষ্ঠুরভাবে কচুকাটা করে। আর্যরা ভারতের সুবিস্তৃত ভূগোলের সুবিপুল জনগোষ্ঠীর ওপর দুর্বিনীত দাসতন্ত্রের প্রবর্তন করে সর্বস্ব লুটে নেয়।

আর্য ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ-এর বিভিন্ন শ্লোকে যুদ্ধের সুবিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। যুদ্ধে প্রাগার্য লৌহ দুর্গসমূহ এবং নগরীর পর নগর তুমুল আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত করে। আর্যদের প্রধান বীরের নাম ‘ইন্দ্র’, যার খেতাব ছিল ‘পুরন্দর’। ‘পুরন্দর’ অর্থ নগর ধ্বংসকারী ও দুর্গ ধ্বংসকারী। বেদের একটি শ্লোক অনুসারে এক ইন্দ্রের হাতেই ৫০ হাজার ভারতীয় নিহত হয়। যুদ্ধ-বিজিত ভূমির পুরনো নাম মুছে যায় মানচিত্র থেকে। আর্য জাতির নামানুসারে দখলকৃত দেশের নতুন নামকরণ করা হয় ‘আর্যাবর্ত’। রামায়ণ-মাহাভারতে দাস-দাসী সাত শ্রেণিতে শ্রেণিকরণ হয়েছে,-জন্মদাস, ক্রীতদাস, যুদ্ধদাস, জুয়াদাস, উপহার দাস, বন্ধকি দাস ও দাস-ভার্যা (স্বাধীন নারী কোনো দাস পুরুষের স্ত্রী হলে তাঁকে দাস-ভার্যা বলা হতো)। দাসদের খাবার ও পোশাক ছিল অত্যন্ত নি¤œমানের। মনিবের উচ্ছিষ্ট আর তুষের রুটিই ছিল তাদের প্রধান খাদ্য।

‘বাংলাদেশে আর্য প্রভাব ও দাসতন্ত্র’ অধ্যায়ে বলা হয়,-‘ভারতে প্রচলিত আর্য দাসতন্ত্র ও বাংলাদেশে প্রচলিত দাসতন্ত্র একই জিনিস।’ আরও উল্লেখ হয় যে, মহাভারতের যুগেই বাংলাদেশের সঙ্গে আর্য যোগসূত্র স্থাপিত হয় এবং আর্যাবর্তের ম্যাপে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয়। আর্যকাল থেকে বাংলাদেশে দাসতন্ত্রের উত্থান ঘটে। মোটামুটিভাবে বলা যেতে যে পারে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বেই আর্য সভ্যতা প্রায় সমগ্র বঙ্গেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে বহু শাসন পরিচালিত হয়েছে,-নন্দ, মৌর্য, শুঙ্গ, কুশান, পাল, সেন, মুসলিম, ফরাসি, নবাবী, জমিদারি, বৃটিশ প্রভৃতি। এসব শাসনযুগের দাসতান্ত্রিক রাজত্ব, দাসতান্ত্রিক সেনাতন্ত্র, দাসতান্ত্রিক আমলাতন্ত্র জনমানুষের ভেতরে কালানুক্রমিক বিস্তার দালিলিকভাবে গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশি শক্তি আর্য ও মুসলমানের মতোই পর্তুগিজ-ওলন্দাজ-ফরাসি-ইংরেজরা ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশে আগমন করে অনুপ্রবেশকারীর বেশে। বলা যায়, আমাদের এই বঙ্গদেশে দাসরা বংশানুক্রমিভাবে দাস ছিল চার হাজার পাঁচ হাজার বছর ধরে। তবে, মধ্যে পর্তুগিজ-ওলন্দাজ-ফরাসি-ইংরেজদের অত্যাচার ছিল অতিমাত্রায় নিষ্ঠুর ও চরম অমানবিক। ‘একটা সময়ে পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত সমগ্র উপকূলে ত্রাসের সৃষ্টি করে হিন্দু-মুসলমান নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ সবাইকে বন্দি করে নিয়ে যেত এবং বন্দিদের দাস হিসেবে বিক্রি

সমকালীন জনপ্রিয় পরিব্রাজক ও ইতিহাসবিদের উদ্ধৃত করে দাসপ্রথা নিয়ে মুসলিমযুগের নানা চমৎকৃত ও হৃদয়বিদারক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে গ্রন্থে। ‘মুসলমান শাসক ও অভিজাতদের মধ্যে দাস ও তস্যদাসের কোনো কমতি ছিল না। তাদের হারেমগুলোও দাস-দাসী ও খোজাদের দিয়ে ভরপুর ছিল (পৃ.- ৬১)।’ দাস বেচাকেনা নিয়ে পরিব্রাজক ইবনে বতুতার ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে উদ্ধৃত করা হয়। তিনি ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের শাসনের সময়ে (১৩৩৮-১৩৫২ খ্রি.) বাংলাদেশে আসেন। ইবনে বতুতা বলেন,-‘বাংলাদেশের পথেঘাটে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে দাস-দাসী বেচাকেনা হয়।

উপপত্ন বানানো যায় এমন সুশ্রী সুবেশী কন্যার মূল্যে এখানে এক দিনার যা মরোক্কর আড়াই দিনারের সমান (পৃ.- ৫৯)।’ আলাউদ্দীন খলজি দাসের মূল্য নিধারণ করে দিয়েছিলেন,-‘কর্ম দাসী ৫-১০ টংকা, সুশ্রী-সুদেহী দাসী ২০-৪০ টংকা, পুরুষ দাস ২০-৩০ টংকা, দেখতে সুশ্রী নয় এমন দাস ৭-৮ টংকা (পৃ.- ৬০)।’ মুসলিম যুগে সবচেয়ে অমানবিক ছিল ‘খোজা’ করে দাস বানানো। খোজাকরণকে বাংলাদেশে সাধারণত মানুষের মুখের ভাষায় ‘ছাঁট’ করানো বলা হয়। খোজাকরণের ফলে বহু শিশু মারা যেত। বাংলাদেশে সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চলে খোজাদের রমরমা বাজার ছিল। খোজাদের চাহিদা ছিল মোগল হারেমেও। মোগল স¤্রাট নূর-উদ্দিন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর আইন করে খোজাকরণ ও খোজা বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং ‘এই অপরাধের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদ-’ বলে ঘোষণা করেন। দাসায়নের নৃশংস বাণিজ্য বন্ধ করারও তিনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। স¤্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী গ্রন্থে ‘খোজা’ বিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন, যা বাংলাদেশের দাসতন্ত্রের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে।

বাংলাদেশে দাসপ্রথার সাথে বহু রাজকীয় নামও উল্লেখ হয়েছে গ্রন্থে, যাঁরা সাধারণ দাস-দাসী থেকে উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন তাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা দিয়ে। নবাব মীরজাফরের স্ত্রী মুন্নি বেগম একজন ক্রীতদাসী ছিলেন। অভাবের তাড়নায় সামেন আলী খানের ক্রীতদাসী বিশু’র কাছে মুন্নিকে বিক্রয় করে দেন তাঁর পরিবার। বিশু পাঁচ বছর দিল্লিতে অবস্থানকালে মুন্নিকে নৃত্যকলা শিক্ষা দেন এবং তাঁর খ্যাতি চারদিক ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার নোয়াজেশ মোহাম্মদ খানের পোষ্যপুত্র ইকরাম-উদ-দৌলার বিয়েতে ১০ হাজার দিয়ে নাচের দলকে মুর্শিদাবাদে আনেন।

এই দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন মুন্নি বেগম। মুন্নীকে দলপ্রধান করে পুরো দলকে মাসোয়ারা দিয়ে মীর জাফর নিজ হারেমে রেখে দেন এবং স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও মীর জাফর পরে বিবাহ করেন মুন্নী বেগমকে। গ্রন্থে বলা হয়েছে,-‘মইজুদ্দীন মুহাম্মদ সামের ক্রীতদাস থেকে দিল্লির সুলতান পদে উন্নীত হন কুতুবদ্দীন আইবেক। তিনিই ভারতের প্রথম ক্রীতদাস সুলতান (পৃ.- ৫১)।’ গ্রন্থকার বলেছেন,-১৮৪৩ সালে সরকার আইন করে বল প্রয়োগে শ্রম বন্ধ করার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে দাসতন্ত্র বন্ধ করলেও ভিন্ন কায়দায় দাসত্ব চালু আছে বাংলাদেশসহ বিশ^ময়। মানুষের ওপর মানুষের এই যে শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতন, ঘুষ-দুর্নীতি-খুন ইত্যাদির শিকার তো মানুষই হচ্ছে মানুষের দ্বারা।
লেখক: উপ-রেজিস্ট্রার, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়।