শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।
রাশেদুল হক ফিরোজ, বাগমারা:
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থামছে না। তারা সভা-সমাবেশ ডেকে পরস্পরকে ‘অশ্লীল’ ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব গালমন্দের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। উৎসুক অনেকেই তাদের ডাকা সভা-সমাবেশে গালিগালাজের ভিডিও মুঠোফোনে খুঁজে বেড়ান। এ নিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীরা বিব্রত অবস্থায় পড়েছেন।
বাগমারা আ’লীগে এক পক্ষে আছেন উপজেলা সভাপতি স্থানীয় সংসদ সদস্য এনামুল হক। এই পক্ষের হয়ে আক্রমণাত্বক বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য দেন উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নরদাশ ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার আবুল এবং অপর পক্ষে রয়েছেন সংসদ সদস্যের বিরোধী তৃণমূল আওয়ামী লীগের ব্যানারে মনোনয়ন প্রত্যাশী পাঁচজন।
পাঁচজনের এই গ্রুপে নেতৃত্বে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাজশাহী বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাড. ইব্রাহিম হোসেন। তার সঙ্গে আছেন তাহেরপুর পৌর আ’লীগের সাধারন সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদ, কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা আ’লীগের উপদেষ্টা ড. পিএম সফিকুল ইসলাম, উপজেলা আ’লীগের সাবেক সভাপতি আবদুস সোবহান চৌধুরী ও জেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টু। এই পাঁচজন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৪ বাগমারা আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। এই গ্রুপ থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য এনামুল হককে বাদ দিয়ে যে কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়ে সভা সমাবেশ করে আসছে।
এই দুই পক্ষ পরস্পরকে গালিগালাজ করে সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে আসছেন। তারা উপজেলার গোয়ালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, রামরামা জলপাইতলা মোড়, হাট-গাঙ্গোপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, হামিরকুৎসা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, ভবানীগঞ্জ ডাক-বাংলো, শহীদ মিনার চত্বর, যোগীপাড়া ইউনিয়ন, নরদাশ ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে সভা-সমাবেশ করে একপক্ষ আরেক পক্ষকে গালিগালাজ করে আসছে।
দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১ জুলাই হতে প্রকাশ্য মঞ্চ হতে এই গালিগালাজ আরম্ভ হয়। ওইদিন উপজেলা পরিষদের ডাকবাংলো চত্বরে সংসদ সদস্যের বিরোধীরা তৃণমূল আওয়ামী লীগের ব্যানারে ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। একই দিনে ৫০ গজ দূরে শহিদ মিনার চত্বরে সংসদ সদস্যের অনুসারীরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের ব্যানারে পাল্টা আরেকটি ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠান দুটি থেকে পরস্পরকে গালিগালাজ করাসহ বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে বক্তব্য দেওয়া হয়। যদিও এই অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন না। এরপর নরদাশে সুবিধাভোগীদের নিয়ে এক সভায় সংসদ সদস্য এনামুল হক তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা ইব্রাহিম হোসেনকে ইঙ্গিত করে তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। অন্য বক্তারাও তৃণমূল আওয়ামী লীগের ওই নেতাকে কটাক্ষ করে অশালীন বক্তব্য দেন।
এদিকে চলতি বছরের ১৫ আগস্ট সংসদ সদস্যের অনুসারীরা উপজেলার হাটগাঙ্গোপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শোকসভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য এনামুল হক। তিনি ওই সভায় তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা ইব্রাহিম হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে বক্তব্য দেয়ার পাশাপাশি অতীত নিয়েও কটাক্ষ করেন। বক্তব্যে তৃণমূল আ’লীগের নেতাদের গায়েব করারও হুমকি দেন সংসদ সদস্য। এর ছয়দিন পরেই ২২ আগস্ট একই স্থানে পাল্টা আরেকটি সভার আয়োজন করে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। ওই সভায় গ্রুপের পাঁচ মনোনয়ন প্রত্যাশী ছাড়াও তাদের অনুসারী কয়েক হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার আবুল কে উদ্দ্যেশ্য করে কটাক্ষমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ ছাড়াও আপত্তিকর কথাবার্তা বলা হয়। এর পর উভয়পক্ষ গোটা উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে নিয়মিত সভা, সমাবেশ ডেকে গালিগালাজ করছেন। যেন উভয়পক্ষ গালিগালাজের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
এদিকে গোয়ালকান্দি ইউনিয়নে সমাবেশে উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক এমপি অনুসারী নরদাশ ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার আবুল তৃণমূল আ’লীগের অনুসারী গোয়ালকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন সরকারকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেন। এর প্রেক্ষিতে পরের সমাবেশে গোয়ালকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন সরকার তার বক্তব্যে গোলাম সারোয়ার আবুলকে তুলোধুনো করেন। আলমগীর সরকারের ওই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। এছাড়াও সাংসদ কে উদ্দ্যেশ্য করে উপজেলা আ’লীগের সাবেক সভাপতি আব্দুস সোবহান চৌধুরীর দেয়া গালিগালাজের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন পেইজে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব গালিগালাজের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় বিব্রত আ’লীগের সমর্থক সাধারণ ভোটাররা। সবচেয়ে বেশি গালিগালাজ করছেন এবং পাল্টা গালিগালাজের শিকার হচ্ছেন সংসদ সদস্যের অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নরদাশ ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার আবুল। তিনি প্রতিপক্ষের নেতাদের অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি দিয়ে চলেছেন বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ও দলীয় অনুষ্ঠানে। তেমনি তারও ব্যক্তিগত, রাজনীতি জীবনের বিভিন্ন দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে পাল্টা গালিগালাজ করছেন প্রতিপক্ষের নেতা গোয়ালকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন সরকার, শ্রীপুর ইউপি চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন মৃধা, যোগিপাড়ার সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, ছাত্রনেতা সাজেদুর রহমানসহ অন্যরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বলেন, এসব শব্দ সচরাচর মুর্খ লোকজনও ব্যবহার করেন না, যা করছেন দলীয় নেতারা। মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগ চালু করলেই ভিডিওগুলো আসছে। এলাকার শিশু থেকে শুরু করে সব শ্রেণির অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোন ব্যবহারকারীরা এসব বক্তব্য শুনছেন এবং ভিডিও দেখছেন।
এসব ব্যাপারে গালিগালাজে অংশ নেওয়া ও পাল্টা শিকার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার আবুল বলেন, যে ভাষায় গালিগালাজ ও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তা শোভনীয় নয়। তবে তিনিও প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতাদের গালিগালাজ করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, তারাতো প্রথমে শুরু করেছেন। তিনি তাদের গালিগালাজের পাল্টা জবাব দিচ্ছেন। আর যারা তাকে ও সংসদ সদস্যকে গালিগালাজ করছেন তারা দলীয় কোনো পদে নেই বলে জানান। তবে তিনি গালিগালাজ বন্ধ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন। তবে তিনি স্বীকার করেন, উভয়পক্ষের বড় নেতাদের উপস্থিতিতে এসব বক্তব্য দেওয়া হয়।
তৃণমূল আ’লীগ গ্রুপের নেতা রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বার এসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাড. ইব্রাহিম হোসেন বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে অশালীন বক্তব্যের শুরুটা সংসদ সদস্য ও তার অনুসারীরা করেছেন। তারা আমাদের তৃণমূল আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতার এলাকায় গিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে আসছেন। মান সম্মানও রাখছেন না। তারাও সমাবেশে ওইসব গালিগালাজের ও অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। তবে এটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাগমারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অনিল কুমার সরকার বলেন, এসব গালিগালাজ শোভনীয় নয়। গালিগালাজে বিব্রত উল্লেখ করে বলেন, আর কিছুদিনের মধ্যে সব বন্ধ হয়ে যাবে। কয়েকদিন আগে অনুষ্ঠিত একটি সভায় কোনো গালিগালাজ করা হয়নি।