মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ৭ চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
আমানুল হক আমান, বাঘা :
রাজশাহী জেলা সদর থেকে ৪৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাঘায় ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ। ১৫২৩-১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে (হিজরি-৯৩০) সুলতান নাসির উদ্দিন নসরাত শাহের সময়ে নির্মিত হয় এ মসজিদ।
মসজিদ নির্মাণকারী সুলতান নসরাত শাহ হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহের ছেলে। নির্মাণের পর বিভিন্ন সময় মসজিদের সংস্কার করা হয়। ১৮৯৭ সালে মসজিদের ছাদ ও গম্বুজগুলো ভেঙে গেলে নতুন করে সংস্করন করা হয়।
বাঘা মসজিদ ২৫৬ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। সমভূমি থেকে ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু করে মসজিদের আঙিনা তৈরি করা হয়েছে।
সজিদের উত্তর পাশের ফটকের ওপরের স্তম্ভ ও কারুকাজ ধ্বংস হয়ে গেছে। মসজিদে ১০টি গম্বুজ আছে। আর ভেতরে রয়েছে ছয়টি স্তম্ভ। মসজিদে চারটি মেহরাব রয়েছে, যা বিশেষ কারুকার্য খচিত। মসজিদের দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট, প্রস্থ ৪২ ফুট, উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। দেয়াল চওড়া ৮ ফুট, গম্বুজের ব্যাস ৪২ ফুট, উচ্চতা ১২ ফুট। চৌচালা গম্বুজের ব্যাস ২০ ফুট, উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট।
মাঝখানের দরজার ওপর ফার্সি ভাষায় লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। মসজিদটির গাঁথুনি চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত। মসজিদের ভেতরে ও বাইরের দেয়ালে মেহরাব ও স্তম্ভ রয়েছে।
মসজিদের চার দিক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের দু’দিকে দু’টি প্রবেশ দ্বার রয়েছে। মসজিদের ভেতরে-বাইরে সর্বত্রই টেরাকোটার নকশা বর্তমান। মসজিদের পাশে অবস্থিত বিশাল দীঘিও একটি দর্শনীয় স্থান। এ ছাড়া বাঘা মসজিদের পাশে রয়েছে একটি মাজার শরিফ।
বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের ছেলে নাসিরউদ্দীন নসরত শাহ জনকল্যাণার্থে মসজিদের সামনেই একটি দীঘি খনন করেন।
শাহী মসজিদ সংলগ্ন এ দীঘিটি ৫২ বিঘা জমির ওপর। দীঘির চার পাশে রয়েছে সারিবদ্ধ নারিকেল গাছ। প্রতি বছর শীতে এ দীঘি অসংখ্য অতিথি পাখির কলতানে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। বর্তমানে দীঘিটির চারটি বাঁধানো পাড় নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন রয়েছে জহর খাকী পীরের মাজার।
১৯৯৭ সালে মাজারের পশ্চিম পাশে খনন কাজের ফলে ৩০ ফুট বাই ২০ ফুট আয়তনের একটি বাঁধানো মহল পুকুরের সন্ধান মেলেছে। এই পুকুরটি একটি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অন্দরমহলের সাথে যুক্ত ছিল। তিন দিক থেকে বাঁধানো সিঁড়ির ভেতরে নেমে গেছে। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে অনেক পোড়ামাটির ফলক। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে একটু উঁচুতে নির্মিত একটি বিশেষ নামাজের কক্ষ আছে।
এ মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় প্রতি বছর ঈদুল ফিতরের দিন থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত মেলার আয়োজন করা হয়। মেলাটি ৫০০ বছরের ধারাবাহিকতায় আজো অব্যাহত রয়েছে। মসজিদটির ছবি ৫০ টাকা নোটে ও ১০ টাকার ডাক টিকিটে রয়েছে।
এদিকে নির্মিত প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন ৫০০ বছরের পুরনো বাঘা শাহী মসজিদের শিলালিপিতে আমের টেরাকোটা অংকিত আছে।
অপর দিকে হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রহঃ) এর পুত্র হযরত শাহ আব্দুর হামিদ দানিশ মন্দ (রহঃ) মাজার সংলগ্ন হযরত জহর শাহ (রহঃ) এর মাজারের পাশে মোগল আমলের প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো নারী মসজিদ রয়েছে।
মসজিদের ভেতরে প্রবেশ পথের মূল দরজার উপরে ফারসী ভাষায় পাথরে খচিত শিলালীপি নিয়ে রয়েছে লোমহর্ষক ঘটনা। মসজিদটি বর্তমানে বিলুপ্তের পথে। মসজিদ দেখতে বছরজুড়ে এখানে আসেন পর্যটক ও দর্শনার্থীরা। তবে পর্যটকদের আকর্ষণ ধরে রাখা বা ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে টিকে থাকা এ স্থাপনা সংরক্ষণে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
৩ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের অবস্থান প্রায় ৩০ ফুট সুউচ্চ টিলার ওপর। বর্গাকার মসজিদটির দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট, প্রস্থ ১৩ ফুট। চারপাশের দেয়াল ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি চওড়া। উত্তর ও দক্ষিণ লম্বাকৃতির মসজিদের পুর্ব দিকে রয়েছে খিলান আকৃতির প্রবেশ পথ। মসজিদের ইট ধূসর বর্ণের। এ ইটের দৈর্ঘ্য ১০ ইঞ্চি, প্রস্থ ৬ ইঞ্চি এবং চওড়া দেড় ইঞ্চি। বর্তমান যুগের ইটের চেয়ে এর আকৃতি একেবারেই আলাদা। দর্শনার্থী ও নামাজিদের ওঠা নামার জন্য মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে প্রবেশ পথ।
ঐতিহাসিক তথ্য মতে, প্রায় ৫০০ বছর আগে ৫ জন সঙ্গীসহ সুদূর বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য বাঘায় এসেছিলেন হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রহঃ)। তিনি বসবাস শুরু করেন, পদ্মা নদীর কাছে কসবে বাঘা নামক স্থানে। আধ্যাত্মিক শক্তির বলে এ এলাকার জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারের ব্যাপক সাফল্য লাভ করেন। এ সময়ে শাহদৌলার অনেক অলৌকিক কীর্তি দেখে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা তাঁর কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়।
বাঘা ওয়াকফ এষ্টেটের দেয়া তথ্য মতে, হযরত শাহদৌলা (রহঃ) এর পুত্র হযরত শাহ আব্দুল হামিদ দানিশ মন্দ (রহঃ) এর মৃত্যুর পর তাঁর তৃতীয় পুত্র মাওলানা শাহ আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ) বাঘার খানকার দায়ীত্বভার গ্রহণ করেন। ওই সময় দিল্লি সম্রাট শাজাহানের প্রেরিত শাহী ফরমান যোগে ৪২টি মৌজা মাদদ মাস স্বরূপ দান লাভ করেন (১০৩০ হিজরী)।
তখন শালিমানা ছিলো ৮ হাজার টাকা। হযরত আব্দুল ওয়াহাবের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্রের মধ্যে হযরত শাহ মোহম্মদ রফিক (রহঃ) ১০২৮ হিজরী সনে ২০৩৭ আনা শালি আনার সম্পত্তি ওয়াকফ করেন। ওয়াকফ এষ্টেটের মোতয়াল্লি (৬ষ্ট রইশ) সাইজুল ইসলামের আমলে রইশ পরিবারের ও বাইরের পর্দানশিন মহিলাদের জন্য মসজিদ নির্মাণ করেন।
তারা এ মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে টিকে থাকা এ শৈল্পিক স্থাপনার শরীরজুড়ে এখন শুধুই অযতœ আর অবহেলার ছাপ। মসজিদের দেয়ালের কিছু কিছু অংশের পলেস্তারা ধসে পড়েছে। তবে বর্মমানে এ মসজিদে আর নামাজ আদায় হয় না।
ওয়াকফ এষ্টেটের বর্তমান মোতয়াল্লি খন্দকার মুনসুরুল ইসলাম রইশ বলেন,
প্রত্নত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক নিদর্শনের তালিকাভুক্ত করেছে। মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ ও পুরোনো নকশা অক্ষুণ্ন রেখে সংস্কারের দায়িত্ব এখন তাদের। মসজিদের ভেতরে প্রবেশ পথের উপরে ফারসী ভাষায় পাথরে খচিত শিলা লীপিটি চুরি হয়ে যায়। যারা এই চুরির সাথে জড়িত ছিল, কিছুদিন পর প্রথমত একজনের পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
পরে পাথরটি মসজিদের ভেতরে রেখে যায়। এরপরে আরো একজন একইভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। চিকিৎসায় পা কেটে ফেলেও ভালো হয়নি। পরে দু’জনই মৃত্যু বরন করেছে। তাদের জীবদ্দশায় পাথর চুরির লোম হর্ষক ঘটনা তাদের মুখ দিয়েই বেরিয়ে আসে।