সোমবার, ২৯ মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
গত মাসটি ছিল ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। সারা জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করেছে মহান ভাষা শহিদদের। ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতির জীবনের এক গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়। বাঙালি জাতির চেতনার বিকাশ ঘটেছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এর সাথে শুরু হয় নানা রকমের আন্দোলন সংগ্রাম। ওইসব আন্দোলন সংগ্রামের পথ বয়ে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং বাংলা শব্দের বুননে বাঙালি খুবই যতœশীল। বাংলা জনপদটি দীর্ঘ সময় বিদেশি শাসনের কবলে থাকায় বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে অনেক বিদেশি শব্দের। তার মধ্যে অনেক শব্দ বাংলা ভাষায় প্রচলিত শব্দে পরিণত হয়ে গেছে। বাংলা বানানের শুদ্ধতা এবং উচ্চারণের বিষয়টি নিয়ে সরব হন এদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী মহল ফেব্রুয়ারি মাস এলেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং বানানের শুদ্ধতার বিষয়টি নিয়ে তারা গণমাধ্যমগুলোতে আলোচনার ঝড় তুলেন। এ ধরনের বুদ্ধিজীবীদের আচরণ ও কথাবার্তা অনেকটা বসন্তের কোকিলের ন্যায়। ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই তাদের বাংলা ভাষার প্রীতি বেড়ে যায়, বছরের অন্য সময় যখন বাংলা ভাষা ভুল ব্যবহার হয় তখন তা নিয়ে তাদের কোন প্রকার কথা বলতে দেখা যায় না। ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং বর্তমানের ফেইস বুকে বিভিন্ন স্থানের সাইন বোর্ড বা ব্যানারের বাংলা বানানের অশুদ্ধতা নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ ধরনের গঠনমূলক সমালোচনা বাংলার ব্যবহারের শুদ্ধতা রক্ষায় গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে। এর ফলে বিভিন্ন সাইন বোর্ড, ব্যানার লিফলেট এর বানান এবং বাংলা ভাষা ব্যবহারে ব্যবহারকারীরা সতর্ক হয়। তবে সারা দেশের যতগুলি সাইন বোর্ড, ব্যানার বা বিলবোর্ড আছে ওই গুলোতে বাংলা শব্দ এবং ভাষার ব্যবহার কী পরিমাণে রয়েছে তা ভেবে দেখার প্রয়োজন। দেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমা বেসরকারি অফিস আদালতসহ সকল প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ড, বিলবোর্ড এবং ব্যানার লিখায় বাংলার ব্যবহার দিন দিন কমছে। দেশের খোদ রাজধানী থেকে শুরু করে, বিভাগীয় নগর, জেলা শহর, উপজেলা শহর ও ছোট ছোট পৌরসভাগুলোতে অবস্থিত বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ড ইংরেজি অক্ষরে এবং শব্দে লেখা। দেশের মানুষের কাছে ইংরেজি আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ইংরেজিতে লেখা বা অর্ধ শুদ্ধ ইংরেজি বলাতে অনেক মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এই কারণে বাংলার ব্যবহার যেমন কমছে আর তেমনিই অশুদ্ধ বাংলার প্রচলনটা বেড়ে যাচ্ছে। দেশের সাধারণত বেশির ভাগ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা হয়। আর যত কিঞ্চিত বাংলা শব্দ ব্যবহার করে বাংলা অক্ষরে লিখা যে সকল সাইন বোর্ড হয় তার বেশির ভাগই ভুলে ভরা। ব্যবহার না করার ফল এটা। আর বাংলার শুদ্ধতার বিষয়টি নিয়ে ভাবা হয় বছরে একবার। যেমন কোরবানীর ঈদে যখন গ্রামের বাড়ি যাই, তখন দেখা যায়, পশু জবাই করা এবং মাংস কাটার জন্য ঘরে রক্ষিত দা-ছুরিগুলো বের করা হয়। আর ওইগুলো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকার কারণে ধারালো থাকে না জং ধরে যায়। ফলে ওগুলোকে শান দিয়ে ধারালো করা হয়। কোরবানীর কাজ শেষ হলে আবার দা-ছুরি বিশেষ স্থানে রেখে দেয়া হয়। বর্তমানে বাংলা ভাষার উচ্চারণ ও বানান বিষয়ক শুদ্ধতা ও সর্বস্তরের বাংলার ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাস আসলে একটু আলাপচারিতা হয়। এটা সত্য যে, বাংলার ব্যবহার না থাকার কারণে এ ধরনের অশুদ্ধ বানানের শব্দগুলি বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি ও দেশীয় শিল্প কারখানাগুলির উৎপাদিত পণ্যের ব্রান্ডিং নামকরণও ইংরেজিতে। অথচ এই পণ্যগুলো বাংলাদেশের বাজারেই বিক্রি করা হয়। তাছাড়া এ সকল পণ্যের শো রুম বা বিক্রয় কেন্দ্রগুলির সাইন বোর্ডে কোম্পানির নাম ইংরেজিতেই লেখা হয়। পণ্যের গুণাগুন বা উৎকর্ষতা যে সঠিক তা প্রমাণ হয় ইংরেজি অক্ষরে পণ্যের নাম লিখার বদৌলতে এটা এ রকম ধারণায় পরিণত হয়েছে। এ রকম মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে এদেশের মানুষের মনে যা এখন মজ্জাগত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আর এর বদৌলতে সুকৌশলে বিদেশি ভাষা এবং সংস্কৃতি বাংলার সংস্কৃতিতে প্রবেশ করছে। ফেব্রুযারি মাস আসলেই শুদ্ধতার অভিযান চালালে কি শুদ্ধতা ফিরে পাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। বাংলা শব্দে কথা বলা এবং এর উচ্চারণ নিয়ে বর্তমানে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের সমস্যা। একটি নতুন শব্দ প্রায়শই শোনা যায় তা হলো ‘বাঙলিশ’, বাংলা এবং ইংরেজি শব্দের সমন্বয় ঘটিয়ে এমন কিছু বলা হয় যার মর্মার্থ বের করাটা দুসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। চ্যানেল সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করছে আরেকটি ভিন্ন ধর্মীয় স্টাইল তা হলো হিন্দি মিশ্রিত বাংলা বলার প্রচলন যা দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মুখেও শুনা যায়। বাংলা শব্দে এ ধরনের বাজে উচ্চারণ বর্জনের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এই ধরনের বিদেশি শব্দের প্রভাবমুক্ত করা বাদ দিয়ে প্রমিত বাংলার ব্যবহার করতে গিয়ে আঞ্চলিক শব্দগুলোর সমালোচনায় সরব হতে দেখা যায় অনেককেই। প্রাচীনকাল থেকে পূর্ব বাঙলা অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশে অঞ্চল ভেদে বাংলা শব্দের ব্যবহার অর্থগতভাবে পার্থক্য দেখা যায়। তাছাড়া একই বিষয়টি বুঝাতে অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন শব্দে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ নিজস্ব সংস্কৃতির বলয়ে তাদের ভাষায় কথা বলে থাকেÑ তাই স্বল্প আয়তনের বাংলাদেশেও বাংলা ভাষায় কথা বলার পার্থক্য দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত শব্দগুলো ওই স্থানের মাতৃভাষার রূপ। তাই প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত শব্দগুলোর প্রতি সকলের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। প্রমিত বাংলার ব্যবহারে আবশ্যকীয়তা আছে তবে আঞ্চলিক শব্দগুলোর অবলুপ্তি ঘটিয়ে নয়। আঞ্চলিক শব্দের অশুদ্ধতা দূর করার চেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার চালু করা। কোন ব্যক্তি তার আঞ্চলিক শব্দে কোন সাইন বোর্ড বা ব্যানার লিখলে তা ইংরেজি ভাষায় লিখা সাইনবোর্ডের চেয়ে অধিকতর শ্রেয়। কারণ সর্ব ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলা শব্দের অশুদ্ধতা দূর করা সম্ভব না। যে কোন বিষয় অনুশীলনের মাধ্যমে তার শুদ্ধরূপ লাভ করে। আমাদের দেশে ইংরেজি জানার প্রয়োজনীয়তা আছে তবে সেই জানাটা বাংলায় উপযোগী করে প্রকাশ করতে না পারাটা হলো জ্ঞানের বন্ধাত্ব। ইংরেজি ভাষায় আহরিত জ্ঞান বাংলা ভাষায় পরিবেশন করাটাই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একজন বাঙালির দায়িত্ব। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ প্রায় ৪৬ বছর। এই দীর্ঘ সময়েও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন না ঘটাতে পারায় দেশের উন্নয়নে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি সুযোগ করে দিয়েছে দুর্নীতির ও প্রতারণার। যেমন- দেশের প্রকৌশল অধিদপ্তরের ছোট ছোট প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করে থাকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে। দেশের প্রকৌশল অধিদপ্তরগুলোর আহবান করা দরপত্র বিজ্ঞপ্তিগুলো কোন সময় বাংলা, আবার কোন সময় ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়। তবে দরপত্রগুলোর যে শিডিউল বা কার্য সম্পাদনের বিস্তারিত বিবরণ ও দরদামের চুলচেরা বিশ্লেষণ লেখা থাকে যে ফর্মটিতে তা লেখা হয় ইংরেজিতে। দেশের স্থানীয় সরকার, পৌরসংস্থাসহ অন্যান্য প্রকৌশল দপ্তরগুলোর ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নকারী তালিকাভুক্ত ঠিকাদার বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উল্লিখিত বিষয়গুলির কতটুকু অর্থ বুঝতে পারে। ১ থেকে ১০ লক্ষ টাকা বা তার কিছু উর্ধ্ব টাকার ব্যয়ের প্রকল্পগুলোতে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদার বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বা কর্মচারীদের কি সেই কার্য সম্পাদনের বিস্তারিত দর বিবরণী বুঝার সক্ষমতা আছে কি ? আর এই বিষয়গুলি কি দেশের প্রকৌশ বিভাগগুলো কখনো ভেবে দেখেছেন। বৃটিশদের রেখে যাওয়া নিয়মে নিরন্তনভাবে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বিষয়টির স্বচ্ছতা বা অষ্পষ্টতা নিয়ে কারো কোন চিন্তা নেই। আহবান করা দর বিবরণী সম্পর্কে ধারণা থাক বা না থাক তারপরও ঠিকাদারা কাজ করে যাচ্ছে। ঠিকাদার বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে এ ধরনের কার্য সম্পাদনের চুক্তির স্বচ্ছতা কতটুকু আছে তা ভেবে দেখার প্রয়োজন। ফলে ছোট ছোট প্রকল্পগুলির অনিয়ম এবং দুর্নীতি দূর হয় না। এ সকল কাজে ইংরেজি ব্যবহারে ফলে তৃণমূল পর্যায়ে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। রাজশাহী মহানগরীর একটি ঘটনা- জনৈক ব্যক্তি একটি ডেভলপার কোম্পানির সাথে মাসিক কিস্তিতে ফ্লাট কিনতে চুক্তি করে। প্রথমে তিনি বুকিং মানি হিসাবে একটি নিদির্ষ্ট পরিমাণের টাকা জমা দিয়ে ফ্লাট বুকিং দেন। অবশিষ্ট টাকা তিনি মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করবেন। চুক্তির শর্তানুযায়ী তিন বছর মাসিক কিস্তি পরিশোধ করে তিনি ফ্লাটটি সাফ কবলা করে নিবেন কোম্পানির কাছ থেকে। তার সাথে কোম্পানির এই চুক্তিটি হয় ২০১০ সালে। কিন্তু তিন বছর পার হওয়ার পরও তিনি ফ্লাটটি বুঝে নিতে পারছেন না। কারণ ভবনটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। কোম্পানির সাথে যে চুক্তিটি হয়েছিল তা শর্তাবলি লিখা হয় ইংরেজিতে, ফ্লাট ক্রেতা সকল শর্তাবলির অর্থ বুঝতে পারেনি। ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তেও তিনি কোম্পানির বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছেন না। যেমন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট, জীবন বিমার পলিসি ( কোন কোন কোম্পানির), মোবাইল সিম কেনা একল ক্ষেত্রে ইংরেজিতে ব্যবহৃত ফরমটি সাধারণ মানুষ কতটুকু বুঝতে পারে। তাছাড়া দেশের পুঁজি বাজারের সকল ফরম এবং কার্যসম্পাদনের ভাষা ইংরেজি। এ সকল ক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যবহার কতটা যুক্তিযুক্ত?
ভাষার মাস এলেই বাংলা বানানের বা উচ্চারণের শুদ্ধতা খোঁজা শুরু হয়। কিন্তু সর্বগ্রাসী ইংরেজির ব্যবহার দেশময় যে প্রতারণার ফাঁদ এটে রেখেছে তা থেকে মুক্তির পথ বের করার পদক্ষেপ নেয়াটাই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলার বানান বা তার উচ্চারণ তখনই শুদ্ধরূপ লাভ করবে যখন সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার শুরু হবে। বাংলার অনুশীলনবিহীন তার শুদ্ধতার বিকাশ ঘটবে না তাই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা জরুরি।
লেখক:- কলামিস্ট